একটি প্রতিবেদন
শরদিন্দু উদ্দীপন
পরিচালক, জয় ভীম ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক
সাম্প্রদায়ীক শক্তির বাড়বাড়ন্ত দেখে, মানবতার চরম অপমান দেখে রবীন্দ্রনাথ তাঁর
পরিশেষ কাব্যে ‘ধর্মমোহ” নামক কবিতায় লেখেন;
“ধর্মের নামে
মোহ যারে এসে ধরে
অন্ধ সে জন মারে
আর শুধু মরে।
নাস্তিক সেও পায়
বিধাতার বর,
ধার্মিকতার করে
না আড়ম্বর।
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,
শাস্ত্র মানে না, মানে মানুষের ভালো”।
শ্রদ্ধা করিয়া জ্বালে বুদ্ধির আলো,
শাস্ত্র মানে না, মানে মানুষের ভালো”।
ভারত
বিভাজনের আগে যে উন্মাদেরা অবিভক্ত বাংলার আকাশ, বাতাস এবং পরিবেশকে বিষাক্ত
করেছিল, যে ধর্ম উন্মাদনা ছড়িয়ে দেশকে শ্মশান-গোরাস্থানে পরিণত করেছিল তা আজ আরো
করাল আকার ধারণ করে সমগ্র ভারতের ছড়িয়ে পড়েছে। ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে জাতপাতের
ভেদ ভাব। কেন্দ্রে এক মনুবাদী সরকার কায়েম হওয়ার পরে এই উন্মাদনা এক ভয়াবহ
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের আকার ধারণ করে কেড়ে নিচ্ছে রোহিত, নাজিব, মুথু কৃষ্ণান,
পায়েল তাড়ভি, ওঙ্কার বারিদাবাদের মত প্রতিভাবান গবেষকদের প্রাণ। অসহিষ্ণুতার
হিংশ্র বুলেট থামিয়ে দিচ্ছে, দাভলকর, কালবুর্গী, পানসারে এবং গৌরী লঙ্কেশদের
প্রতিবাদী কলম। ধর্মের, গোরক্ষার নামে খুন করা হচ্ছে আকলাখ, জুনায়েদ, আফরাজুল এবং
তাবরেজকে। নৃশংস ভাবে ধর্ষণ করা হচ্ছে আসিফা, সুলতানা, কুশমণ্ডির আদিবাসী বোন তথা
এসসি এসটি ওবিসি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু নারীদের।
এ রাজ্যেও ক্রমাগত ভাবে এই উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ছে। জাতপাতের কারণে মোহিত মণ্ডলকে প্রেসিডেন্সী কলেজ ছেড়ে দিতে হয়েছে। জাতপাতের কারণে সরস্বতী কেরকেট্টাকে তাঁর নিজের দপ্তরের মধ্যে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। জাতপাতের কারণে মেদিনীপুরের রুইদাস সমাজের মানুষদের সামাজিক বয়কটের শিকার হতে হয়েছে। আর এই ধর্মীয় উন্মাদনার মধ্য দিয়ে খুন হয়ে যাচ্ছে দলিত-আদিবাসী এবং মুসলিম ঘরের সাধারণ মানুষ। খুন হচ্ছে দলিত-বহুজন এবং খুন করছে দলিত-বহুজন সমাজের মানুষ। আর পিছন থেকে মারার জন্য এবং মরার জন্য ইন্ধন জুগিয়ে যাচ্ছে মনুবাদী, ব্রাহ্মন্যবাদী শক্তি। যে রামনাম ধর্মীয় চেতনার এক গভীর উপলব্ধি হিসেবে কাজ করত আজ তা সন্ত্রাসবাদের উন্মত্ত শ্লোগানে রূপান্তরিত হয়ে দাঙ্গা এবং গণহত্যার প্রেক্ষাপট তৈরি করছে।
এই ধর্মীয় উন্মাদনা দেশের প্রগতির পথে ভয়ঙ্কর বাঁধা। দেশের ভবিষ্য নির্মাণের বড়
অন্তরায়। মানবতার পক্ষে এ এক চরম গ্লানি। এমন কলঙ্কিত উন্মাদনা কোন রাষ্ট্রের
পক্ষে মঙ্গল নয়। একে প্রশমিত না করতে
পারলে অচিরেই দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে।
দলিত
–আদিবাসী সমাজের মধ্যে এই বার্তা ছড়িয়ে দিতে, তাঁদের অধিকার এবং কর্তব্য বোধের বিকাশ
ঘটিয়ে বাবাসাহেব আম্বেদকরের প্রদর্শিত পথে আদর্শ ভারত নির্মাণের জন্য লাগাতার
কর্মশালার আয়োজন করে চলেছে জয় ভীম ইন্ডিয়া নেটওয়ার্ক। এমনই এক কর্মশালা অনুষ্ঠিত
হয় ২৯শে জুন, ২০১৯ নদিয়া, জেলার চাকদা, ব্লকের কাশিমপুর গ্রামে। আর এই মহান
কর্মসূচী সুচারু ভাবে রূপায়ন করার জন্য পবিত্র ঈদগাহের ময়দান খুলে দিয়ে ঐতিহাসিক
দৃষ্টান্ত স্থাপন করল কাশিমপুর ঈদগাহ কমিটি।
এদিন
জাতপাত এবং ধর্মের অসহিষ্ণুতার বলি, চুনি কোটাল, রোহিত ভেমুলা, ওঙ্কার বারিদাবাদ,
নাজিব জং, গৌরী লঙ্কেশ, তাবরেজ এবং পায়েল তাড়ভি প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলী এবং শপথ
নিয়ে কর্মশালার কাজ শুরু হয়। সঙ্গীত পরিবেশন করেন রাজি পাড়া সারণা প্রার্থনা সভার
সদস্যগণ।
সভার
শুরুতে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট সমাজ সেবী,
জামাত-এ-হিন্দ’এর প্রাক্তন সভাপ্তি মহঃ নুরুদ্দীন সাহেব। তিনি পরিষ্কার করে বলেন,
আজ যে ভাবে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করা হচ্ছে তা ব্রাহ্মন্যবাদের ক্ষমতা ধরে
রাখার এক সুচতুর কৌশল। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা জানে তাঁরা সংখ্যায় নগণ্য। তাই বহুজন
সমাজের মধ্যে হাজার হাজার বিভাজন ঘটিয়ে, ছোঁয়াছুঁয়ি ভেদভাব ঘটিয়ে নিজেদের প্রভুত্ব
বজায় রেখেছে। জাতের সঙ্গে জাতের বিবাদ, পাড়ায় পাড়ায় গণ্ডগোল, জমি নিয়ে সংঘর্ষ,
মন্দিরে ঢুকতে গেলে দলিতকে হত্যা, এনআরসি’র নামে এমন
ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করা জাতে মানুষ সন্ত্রস্ত এবং নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।
দুঃখের
বিষয় ব্রাহ্মন্যবাদের এই ভেদভাব মুসলিম সমাজের মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। কাবাগৃহে মুসলিম
রমণীরা নির্বিঘ্নে নামাজ পড়তে পারে কিন্তু ভারতের মসজিদেও নারীদের ঢুকতে দেওয়া হয়
না। এগুলি চরম অন্যায়। কোরানের কোথাও এমন নির্দেশ করা হয়নি। বাংলার মুসলমান চণ্ডাল
জাতির অখণ্ড অংশ। মাননীয় শরদিন্দু উদ্দীপনের সাথে আমি সহমত। তিনি নানা জায়গায়
লিখেছেন যে, ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ভেদভাবের কারণেই এই চণ্ডাল জাতির বিশাল অংশ ইসলাম
গ্রহণ করেন। ইসলামে ভেদভাব থাকলে কোনদিনই চণ্ডাল সমাজ তা গ্রহণ করত না।
তিনি আরো জানান যে এই সব গোঁড়ামি ধ্বংস হতে পারে শিক্ষার মাধ্যমে। বাবাসাহেব আম্বেদকর যথার্থ অনুধাবন করেছিলেন মানুষ শিক্ষিত না হলে এইসব চালাকি ধরতে পারবে না। শিক্ষাই মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করবে।
তিনি আরো জানান যে এই সব গোঁড়ামি ধ্বংস হতে পারে শিক্ষার মাধ্যমে। বাবাসাহেব আম্বেদকর যথার্থ অনুধাবন করেছিলেন মানুষ শিক্ষিত না হলে এইসব চালাকি ধরতে পারবে না। শিক্ষাই মানুষকে সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করবে।
কবি এবং সাংবাদিক মোক্তার হোসেন জানান যে, ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। বাবাসাহেব আম্বেদকর তাদেরকে যে সক্ষমতার চাবিকাঠি দিয়ে গেছেন তা প্রসারিত না করে তাদেরকে চতুর্বর্ণের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের বোঝানো হচ্ছে যে, জাতপাত হল পূর্ব জন্মের পাপ। দলিত আদিবাসীরা তাঁদের পূর্বজন্মে পাপ ভোগ করছে। সম্প্রীতি কাকে বলে ব্রাহ্মণেরা জানেন না। এরা বুঝতে পারছে যে বাবাসাহেব আম্বেদকরের প্রদর্শিত পথে দলিত-বহুজন মানুষ একত্রিত হচ্ছে। জেনেটিক ভাবে আদিবাসী-মূলনিবাসীরা যে এক তার আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আমার মনে হয় না অবিভক্ত ভারতের নাগরিক হিসেবে ওপার বাংলার নমশূদ্ররা নাগরিকত্ব চাইলে এখানকার মুসলমানেরা তার বিরোধিতা করবেন। আমরা এমন বাংলা গড়তে চাই যেখানে ভাগিদারী অনুপাতে একজন এসসি হবেন মূখ্যমন্ত্রী, একজন মুসলিম হবেন উপমূখ্যমন্ত্রী। একজন আদিবাসী হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী। আমরা এমন ভারত চাই যেখানে ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে আর কোন রোহিতকে হত্যা করা হবে না। আর কোন আসিফাকে ধর্ষণের শিকার হতে হবে না। জাতি নয়, ধর্ম নয়, রাজ্য নয়, রাষ্ট্র নয় গোটা পৃথিবী সব মানুষ হবে আমার আপন জন। আমরা নিশ্চিত বাবাসাহেব আম্বেদকরের নির্দেশিত পথে এই মুক্তি আসবে।
বিশিষ্ট
সমাজ সেবী তাপস কান্তি বিশ্বাস বলেন, বাবাসাহেবের চিন্তাধারাকে ছড়িয়ে দিতে গেলে
আগে জেনে নিতে হবে এই মহান মানুষটি কে? এরপর তিনি প্রগতিশীল আধুনিক ভারত গড়ে তোলার
জন্য বাবা সাহেব আম্বেদকরের নানা অবদান তুলে ধরেন। কর্মশালার মূল উদ্দেশ্যের সাথে
সম্পর্ক রেখে বক্তব্য রাখেন কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল, অভিজিৎ সরকার, পরেশ দেবনাথ, রূপা
খান চক্রবর্তী এবং দেবাংশু সরকার। বক্তারা প্রত্যেকেই দলিত-বহুজন সমাজের উপর
ব্রাহ্মণ্যবাদী নানা আক্রমণের কাহিনী তুলে ধরেন। তাঁরা দাবী করেন যে এই ধরণের
কর্মশালা যত বেশী হবে মানুষ তত সচেতন হবেন।
রূপা খান বলেন যে।বাবাসাহেব আমাদের সমস্ত অধিকার দিয়ে
গেছেন। শুধু অধিকার অধিকার বলে চেঁচালে হবে না, আধিকার কেড়ে নিতে হবে। মোদি সরকার
সংবিধানকে মানছেন না। বিগত পাঁচ বছরে প্রতি পদে পদে নিয়ম ভেঙ্গে দেশকে নৈরাজ্যের
দিকে নিয়ে গেছে। মেয়েদের উপর বলাৎকারের পরিমাণ বাড়িয়ে তুলেছেন। তাঁদের মধ্যে ভয়
ঢুকিয়ে দিচ্ছেন যাতে তাঁরা গৃহের কোনে আটকা থাকে। এই সমস্ত ভয় থেকে বেরিয়ে আসতে
হবে দেশের নাগরিকদের। মানুষকে সঠিক ভাবে শিক্ষা দিতে পারলেই তাঁরা এই উন্মাদদের
বুঝিয়ে দিতে পারবেন হিংসা নয়, দাঙ্গা নয় পরস্পরের সবস্থানের মধ্যেই গড়ে উঠবে
ভবিষ্যতের ভারত।
জয় ভীম ইন্ডিয়া নেটওয়ার্কের পরিচালক শরদিন্দু উদ্দীপন জানান, যে ভাবে ধর্মীয়
আবেগকে উস্কানি দিয়ে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা হচ্ছে তাকে শুধু রাজনৈতিক ভাবে
মোকাবেলা করা যাবে না। কেননা রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ভাবে এই ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে
সিদ্ধান্ত নিলে তাঁরা ধর্ম বিপন্ন বলে দোহাই পাড়তে থাকবে। এদেরকে মোকাবিলা করতে
হবে সংস্কৃতি এবং সমাজ সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে। তবে এই আন্দোলন হতে হাবে
সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দলের প্রভাব মুক্ত হয়ে। বাংলার বহুজন সমাজ সামাজিক এবং
সাংস্কৃতিক আন্দোলন শুরু করলে এই অন্ধ উন্মত্তা আচিরে ধ্বংস হয়ে যাবে। বাংলা কলুষ
মুক্ত হবে।
No comments:
Post a Comment