Pages

Monday 23 August 2021

বাংলার আদিবাসী-১

 #SC_ST_OBC আমরা সবাই #আদিবাসী

সম্প্রতি আদিবাসী পরিচয় নিয়ে বেশ কিছু জনজাতির মধ্যে নানা ধরণের বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এই বিতর্ক নিরসন করার জন্যই এই তথ্য ভিত্তিক লেখা। আশাকরি এই তথ্যগুলি আদিবাসী-মূলনিবাসী বহুজন আন্দোলনে সহায়ক হয়ে উঠবে।
বাংলার আদিবাসী-১
নৃতত্ত্ববিদেরা মেনে নিয়েছেন যে ভারতের জনাধারের প্রথম সোপানটি নির্মাণ করে নেগ্রিটো জন। উত্তর_পূর্বের আন্দামান থেকে আসাম এবং দক্ষিনের পেরাম্বকুলাম, আন্নামালাই অঞ্চলের পুলায়ান জাতির মধ্যে এই নেগ্রিটো রক্ত প্রবাহ এখনো বর্তমান।
হাটন সাহেব, বিরজাশঙ্কর গুহ, হারানচন্দ্র চাকলাদার, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, তারকচন্দ্র রায়চৌধুরী, গেইট এবং রিজলি সাহেবদের নরতাত্ত্বিক গণনা থেকে জানা যায় যে বিহারের রাজমহল পাহাড়ের আদিম অধিবাসীদের মধ্যেও কিছু কিছু মানুষের মধ্যে এই নেগ্রিটো জনের রক্ত প্রবাহ রয়েছে। বাংলার পশ্চিম প্রান্তে বাগদী এবং সুন্দরবন অঞ্চল থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত তটভূমি সংলগ্ন মৎসজীবীদের মধ্যে নেগ্রিটো জাতির দেহ বিশিষ্ট লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ নিম্নবঙ্গের নদীনালা, খালবিল ঘেরা জনপদগুলি যারা গড়ে তোলেন তাঁরা এই নেগ্রিটো জনের প্রতিনিধি।
"নিম্নবর্ণের বাঙালী এবং বাংলার আদিম অধিবাসীদের ভিতর যে জনের প্রভাব সব চেয়ে বেশি, নৃতত্ত্ববিদেরা তাহাদের নামকরণ করিয়াছেন আদি-অস্ট্রেলীয় (proto-Australoid)। তাহারা মনে করেন যে এই "জন" এক সময়ে মধ্য-ভারত হইতে আরম্ভ করিয়া দক্ষিণ-ভারত, সিংহল হইতে একেবারে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।" (রায়/দেজ পাবলিশিং/১৩৫৬/৩৩পাতা)
বঙ্গদেশের ৩৬ জাতিঃ
খ্রীস্টীয় ত্রয়দশ শতকে দুটি গ্রন্থে বাংলার আদিম অধিবাসীদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই দুটি গ্রন্থ হল বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ। সংস্কৃত সাহিত্যের ১৮টি পুরাণের মত এই দুইটি পুরাণের লেখকও কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস! অনুমান করা হয় এই দুটি গ্রন্থই রাঢ়দেশে রচিত। বৃহদ্ধর্মপুরাণ ব্রাহ্মণ ছাড়া বাংলার অধিবাসীদের যে তালিকা দিয়েছে তা নিচে সংযুক্ত করা হলঃ
১) উত্তম সংকর বিভাগঃ করণ( সৎশুদ্র), অম্বষ্ঠ( বৈদ্য), উগ্র, মাগধ, গান্ধিক, বণিক, শঙ্খ বণিক , কাসারি, কুমোর , তাঁতি, কামার, গোয়ালা, দাস( চাষি), রাজপুত, নাপিত, মোদক, বারুজীবী, সূত্রধর (ছুতার), মালাকার, তাম্বুলি এবং তৌলিক।
২) মধ্যম সংকর বিভাগঃ তক্ষক, রজক, স্বর্ণকার, স্বর্ণবণিক, আভীর, তেলি, ধীবর, শৌণ্ডিক( শুঁড়ি), নট, শাবক, শেখর ও জালিক।
৩) অন্তজ বা অধম সংকরঃ মলেগ্রহী, কুড়ব, চণ্ডাল, বড়ুর, চর্মকার, ঘণ্টজীবী, ডোলাবাহী, মল্ল ও তক্ষ।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ রাঢ়দেশে রচিত হলেও কেন বঙ্গদেশের জাতি তালিকায় শবর, সাঁওতাল, ভূমিজ, পাহাড়িয়া প্রভৃতি কৌম জাতির উল্লেখ করা হলনা তা জিজ্ঞাসু জনের কাছে এক বিস্ময় বটে! সম্ভবত ঘোরতর জাতি বিদ্বেষের জন্যই গ্রন্থকার এই জাতিগুলির অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। কারণ আর্যাবর্ত এবং অন্যান্য প্রদেশগুলির মতই বৃহৎবঙ্গের জনবিন্যাস, ভাষা, সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে ব্রাহ্মণবাদের বিজয়কেতন উড়ানোই ছিল তাঁদের আসল উদ্দেশ্য।
হান্টার কমিশনের রিপোর্টঃ ত্রয়দশ শতকে বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে শবর, ভুমিজ, মালে, মুন্ডা ও সাঁওতালদের উল্লেখ না থাকলেও ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত হান্টার কমিশনের রিপোর্টে এই কৌম্য জাতিগুলির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এই রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, বীরভূম, সিংভূম, ধলভূম সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় সাঁওতাল, মুন্ডা, জাওরা পাহাড়িয়া সহ অসংখ্য আদিবাসী সমূদয়ের নিবাস ছিল। ১৭৭০-১৭৯০ সালের খরা ও মন্বন্তরের জন্য এই আদিবাসী সমুদায় রাজমহল পাহাড়ের দিকে আসতে শুরু করে। এই আদিবাসী সমুদায়ের মধ্যে সাঁওতালরা ছিল সব থেকে শক্তিশালী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ। বড়লাট বেন্টিংক পাহাড়িয়াদের দমন করার জন্য রাজমহল পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে সাঁওতালদের বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। হান্টার উল্লেখ করেছেন যে ১৭৭০ থেকে শুরু করে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত “দামন-ই কোহ” তে বা রাজমহাল পাহাড়ের "আঁচল" ঘিরে এই মাইগ্রেশন চলে এবং প্রায় ১৫০টি সাঁওতাল গ্রামের পত্তন হয়।

বাংলার কৌম্য জাতির নৃতাত্ত্বিক গণনাঃ
উনবিংশ শতকের শেষ ভাগে বাংলার আদিম আদিবাসীদের নিয়ে একটি নৃতাত্ত্বিক গবেষণা শুরু হয়। এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন বিরজাশঙ্কর গুহ, হারানচন্দ্র চাকলাদার, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, তারকচন্দ্র রায়চৌধুরী, গেইট এবং এইচ এইচ রিজলি।
এই গবেষকদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ডঃ ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত সাঁওতাল, ভূমিজ, বাউরী, বাগদী, লোহার, মাঝি, তেলি, সুবর্ণ এবং গন্ধ বণিক, ময়রা, কলু, তাঁতি, মাহিষ্য, তামলি, নাপিত এবং রজকদের নিয়ে গবেষণা করেন।
রিজলি সাহেব সদগোপ, রাজবংশী, মুচি, মালী, কৈবর্ত, গোয়ালা, চণ্ডাল, বাউরী, বাগদী এবং মুসলমানদের নিয়ে গণনা করেন। ১৮৯২ সালে প্রকাশিত হয় রিজলি সাহেবের বিখ্যাত গ্রন্থ "The Tribes and Castes of Bengal"। নৃতাত্ত্বিক গবেষণার এই গ্রন্থে পরিষ্কার করে উল্লেখ করা হয়েছে যে ব্রাহ্মণ ছাড়া এই বাংলার সমস্ত কৌমজাতিগুলিই অস্ট্রিক, দ্রাবিড় এবং মঙ্গোলয়েড জনজাতির অংশ। এঁদের মধ্যে উত্তম সংকর জাতি বা
সৎ শূদ্র জাতি করণ(কায়স্থ) এবং বদ্যি জাতিও ভারতের বহুজন সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আর্যপূর্ব ভারতের আদিবাসীদের এখন নানা ক্যাটেগোরিতে ভাগ করা হয়েছে। এই ক্যাটেগোরিগুলি হলঃ 1) SC/ST এবং 2) OBC। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে MBC বা মোস্ট ব্যাকোয়ার্ড ক্লাস হিসেবে যারা তালিকায় যুক্ত হয়েছেন তারাও ভারতের আদিবাসী। তথ্য সূত্রঃ ১) রায়/ বাঙ্গালীর ইতিহাস/ দেজ পাবলিশিং/১৩৫৬
২) সুর/বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন/ সাহিত্য লোক
৩) সেন/বৃহৎ বং/দেজ পাব্লিশিং/১৩৪১
৪) Risley/ The Tribes and Caste of Bengal/1892
৫) শাস্ত্রী/ বৌদ্ধ গান দোহা
৬) বন্দ্যোপাধ্যায়/বাংলা সাহিত্য প্রসঙ্গে