Pages

Tuesday 29 June 2021

অবৈধ অনুপ্রবেশকারী –এক নিপাট ষড়যন্ত্র

 

শরদিন্দু উদ্দীপন, কোলকাতা

 ২০১৬ সালে বিজেপি সরকারের আনা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের উপর তৈরি  হল  জয়েন্ট পার্লামেন্ট্রি  কমিটির বা জেপিসি'র একটি রিপোর্ট। বিজেপি পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়েই  ৭ই জানুয়ারী, ২০১৯ লোকসভা এবং রাজ্য সভার উভয় কক্ষে পেশ করল এই রিপোর্ট। এই রিপোর্টে দাবী করা হল যে, বিভিন্ন সংগঠন, এনজিও, জ্ঞানীগুণী মানুষের বিচার, বিবেচনা সম্বলিত ৯০০০ মেমোরান্ডাম গ্রহণ করার পর এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে জয়েন্ট পার্লামেন্ট্রি  কমিটির চেয়ারপার্সন রাজেন্দ্র আগরওয়াল জানালেন যে এই কমিটি রিপোর্ট রচনার জন্য তিনটি শিক্ষামূলক ভ্রমণ করা হয়েছে এবং অভিবাসী, এনজিও, জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে স্থানীয় স্তর থেকেই প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে কমিটির প্রতিনিধিরা ২০১৬ সালের ১৮ থেকে ২০শে ডিসেম্বর রাজস্থানের যোধপুর এলাকার তথ্য সংগ্রহ করেছেন, ২০১৭ সালের ১৮ থেকে ২০ এপ্রিল আহমেদাবাদ এবং রাজকোট ভ্রমণ করেছেন এবং ২০১৮ সালের ৭ থেকে ১১ই মে গুয়াহাটি, শিলচর এবং শিলং ক্ষেত্র সমীক্ষা করেছেন অর্থাৎ এই কমিটি নাগরিকত্ব আইনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সেকশন -২ এর ক্লজ (i) এবং ক্লজ (ii) সংশোধনের ক্ষেত্রে যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর (Illegal migrant)  ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তাঁদের চিহ্নিত করার জন্য পশ্চিমবঙ্গকে বাদ রেখেছেন যেহেতু ভারতের সব রাজ্যে এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে Intelligence Bureau (IB) এবং Research and Analysis Wing (RAW) এর সাহায্য নেওয়া হয়েছিল তাতে নিশ্চিত করে বলা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গে কোন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর অস্তিত্ব নেই এই তথ্য জয়েন্ট পার্লামেন্ট্রি  কমিটি জানতেন

অবৈধ অনুপ্রবেশকারী প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের নাম নেই কেন তার জবাবে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও বলেছিলেন যে, কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং তৃণমূল সরকার পশ্চিমবঙ্গের সকলকেই নাগরিকত্ব দিয়ে দিয়েছেন কোন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী তালিকা পশ্চিমবঙ্গে নেই

 তবে কাঁদের জন্য ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনা হল?

এই প্রশ্নে জয়েন্ট পার্লামেন্ট্রি  কমিটি তার রিপোর্টে উল্লেখ করলেন, “আমাদের সংগৃহীত নথি অনুসারে  সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৩১,৩১৩ জন ( হিন্দু-২৫৪৪৭, শিখ-৫৮০৭, খ্রীস্টান৫৫, বুদ্ধিস্ট-২ এবং পারসি-২) ব্যাক্তি আছেন যারা ধর্মীয় নিপীড়নের জন্য তাঁদের দেশ থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁরা ভারতের নাগরিকত্ব  পাবার জন্য দাবি করেছেন এবং আবেদন করেছেন। দাবি অনুসারে তাঁদেরকে দীর্ঘমেয়াদী ভিসা প্রদান করা হয়েছে এবং এই মানুষেরাই সুবিধা পাবেন।   

কেন মাত্র এই ৩১,৩১৩ জনকে সুবিধা দেবার জন্য ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনা হল? এই প্রশ্নের উত্তরে আইবি এর ডিরেক্টর পরিষ্কার খোলসা করলেন যেঃ “হ্যা, এঁরাই সুবিধা পাবেন, কারণ এঁরা দাবী করেছেন এবং আবেদন করেছেন।“          

এর পরে আইবি এর ডিরেক্টর দেশের অন্যান্য মানুষের ক্ষেত্রে খোলসা করে বললেন যেঃ   


“আরো অনেক মানুষ থাকতে পারেন এবং তাঁরা হয়ত বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে নিয়েছেন। তাঁদের হয়ত পাসপোর্ট, রেশন কার্ড আছে। অন্য আরো সমস্ত ডকুমেন্ট হয়ত তাঁরা পেয়ে গেছেন এবং হয়ত ইতিমধ্যেই তাঁরা তাঁদের নাম ভোটার তালিকায় নথিবদ্ধ করে নিয়েছেন। বাস্তবিক ক্ষেত্রে অবশ্যই তাঁরা এই দেশের নাগরিক। যদি কেউ অবৈধ উপায়ে এই সকল প্রমানাদি সংগ্রহ করে থাকেন তবে তা খুঁজে বার করার জন্য ট্রাইব্যুনাল আছে। সেটা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। এই বিল তাঁদের জন্য যারা আবেদন করেছিলেন এবং যারা দাবী করেছিলেন যে ধর্মীয় নিপীড়নের জন্য তাঁরা তাঁদের দেশ থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।“       

অর্থাৎ একদিকে তিনি বিভিন্ন উপায়ে নাগরিকত্ব অর্জনকারী মানুষদের আশ্বস্ত করলেন অন্য দিকে তাঁরা অবৈধ উপায়ে এই নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন কি না তা ট্রাইবুনাল খুঁজে বার করবে বলে আতংকের খাঁড়া ঝুলিয়ে রাখলেন!   

অনুপ্রবেশকারী বলে কাঁদের টার্গেট করেছিল বিজেপি?

এই হাড় হীম করা নিষ্ঠুর চক্রান্তের খবর মতুয়া সমাজ এখনো বুঝতে পারছে না! তাঁদের মধ্যে কিছু নেতা এমএলএ, এমপি হবার স্বপ্নে এমন বিভোর হয়ে আছেন যে তাঁরা জাতির গলায় এনআরসির ফাঁস লাগিয়ে বিজেপি এবং আরএসএস এর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে চলেছেন। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বিজেপির টিকিট কিনছেন। কেউ কেউ আবার  আম্বেদকরবাদী মুখোশ চড়িয়ে অনবরত দেশভাগের বলি মানুষদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এবং সরাসরি বিজেপির তোলা “অবৈধ অনুপ্রবেশকারী” তত্ত্বকে মান্যতা দিয়ে  প্রচার করে চলেছেন! এই সুচতুর সুবিধাবাদীর দল জাতির আবেগ কাজে লাগিয়ে দু’একটি সেমিনার করে মতুয়াদের এমন ধোঁকা দিয়ে চলেছেন যে সুধী সমাজ এই হাড় হীম করা চক্রান্তের টিকিটিও ধরতে পারছেন না!  

কী ছিল এই চক্রান্ত? রোহিঙ্গাদের সাথে কেন জুড়ে দেওয়া হয়েছিল ২ কোটি বাংলাদেশীর  নাম? এটা কি শুধু রাজনৈতিক শ্লোগান না মানুষকে বেঘর, বেনাগরিক করার নীল নকশা তার উপরেই এখন আলোকপাত করতে চাই।   

১৯/০৭/২০১৬ তারিখে বিজেপি সরকার লোক সভাতে, ভারতের নাগরিকত্ব  আইন-১৯৫৫ এর দ্বিতীয়  অধ্যায়ের সেকশন -২ এর ক্লজ (i) এবং ক্লজ (ii) সংশোধনের জন্য বিল আনলেন। এই বছরের ১৮ই ডিসেম্বর থেকে ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)  এবং রিসার্স এন্ড আনালিসিস উইং(র) এর সহযোগিতায় শুরু হয়ে গেল অবৈধ অনুপ্রবেশকারী (Illegal migrant) চিহ্নিত করণের অভিযান। এই অভিযানে  অবৈধ অনুপ্রবেশকারী (Illegal migrant) চিহ্নিতকরণে জন্য ভোটার তালিকা, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, পাসপোর্ট প্রভৃতি   যে যে মাপকাঠি রাখা হয়েছিল তার ভিত্তিতে ৩১,৩১৩ জন মানুষের নাম নথিভুক্ত করা হয়। এই তালিকার বাইরে আর কেউ আছে কিনা তাঁদের খুঁজে বার করার জন্য ট্রাইব্যুনালকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়।  

২০১১ সালের সেনসাস, ২০১৫ সালের এনপিআর, ২০১৬ সালের হাউজহোল্ড সার্ভে, আইবি রিপোর্ট এবং রিসার্স এন্ড আনালিসিস উইং(র) এর অনুসন্ধান থেকে জানা যায় যে পশ্চিমবঙ্গবাসীদের অধিকাংশের কাছেই এই প্রমানপত্র এবং নথি আছে। এখানে কেউ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও ঘোষণা করেন যে মতুয়া, নমশূদ্র এবং অন্যান্যরা সবাই ভারতের নাগরিক। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি এবং কংগ্রেসও এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর তত্ত্ব খারিজ করে দেয়।

দুর্জনের ছলের অভাব হয়না। অসমে এই চাতুরিতে বিজেপি সফল। তাই অসমের আদলে ট্রাইব্যুনাল এবং সুপ্রিমকোর্টকে সামনে রেখে পরিকল্পিত হল এক বীভৎস ষড়যন্ত্র! ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের সামনে রেখে মতুয়া এবং নমশূদ্রদের চিহ্নিত করার জন্য এই জাল ছড়িয়ে দেওয়া হল। হিন্দু-মুসলিম অসহিষ্ণুতাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য রোহিঙ্গাদের সামনে রাখা হল যাতে ধর্মপ্রাণ মতুয়াদের মধ্যে দেশ বিভাজনের নিদারুন যন্ত্রণাকে চাগিয়ে দেওয়া যায় এবং ধর্মের আফিংয়ে  উন্মত্ত করে নির্বিঘ্নে এই চিহ্নিতকরণের কাজ সমাপ্ত করা যায়।  

১২ই ডিসেম্বর ২০১৯। “দি গেজেট অফ ইন্ডিয়া”তে প্রকাশিত হয় “নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন-২০১৯”। মতুয়ারা জানতেও পারেননা যে এই সংশোধনী আইনের কোথাও তাঁদের নাগরিকত্ব দেবার প্রতিবিধান রাখা হয়নি । তবুও রটিয়ে দেওয়া হয় যে, মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেবার জন্য এই সংশোধনী আইন পাশ করা হয়েছে। রুলস প্রকাশিত হলে নিজেকে শরণার্থী হিসেবে ঘোষণা করে আবেদন করলেই মতুয়ারা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন।

 মতুয়ারা বেজায় খুশি। “নাগরিকত্ব পাইয়া গিছি” বলে পান চিবোতে শুরু করলেন লোককবির দল। ইতিমধ্যেই তাঁরা ঢোল, কাঁসি বাজিয়ে দিল্লীর যন্তরমন্তরে বিজেপির প্রশংসায় ধুয়াগান পরিবেশন করে এসেছেন। সোহাগে ঢলে পড়েছেন বিজেপি সাংসদদের গায়। ইতিহাসে নাম লেখাতে ছুটে এসেছেন তোষামুদের দল। দুই বাহু উত্তোলন করে ডাংকা, কাঁসি বাজিয়ে তাঁরা অমিত শাহের প্রশংসায় বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। “হরিবোল” ভুলে জয়শ্রীরাম ধ্বনি দিতে দিতে আবেগমথিত হয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে, বিজেপির আগে কোন সরকার দেশভাগের বলি উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেবার কথা ভাবেনি। বিজেপি একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিল। জয় শ্রীরাম!    

শুরু হয়ে গেল শরণার্থী চিহ্নিতকরণের নতুন অধ্যায়। সুবোধ বিশ্বাসের নেতৃত্বে ১৮জন বিজেপি সাংসদকে রাজকীয় সম্বর্ধনা দেওয়া হল। মতুয়াদের শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিতকরণের  জন্য সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করার জন্য আসরে নেমে পড়লেন বিজেপি সাংসদ এবং মতুয়া মহাসংঘের সভাপতি শান্তনু ঠাকুর। শান্তনু ঠাকুরকে যথাযথ সঙ্গত দিলেন সাংসদ জগন্নাথ সরকার, বর্তমান হরিণঘটা বিধান সভার এমএলএ অসীম সরকার, বর্তমান কল্যাণী বিধান সভার এমএলএ অ্যাডভোকেট অম্বিকা রায় এবং আরো অনেকে। শান্তনু ঠাকুর নির্বাচনী জনসভায় ঘোষণা করেন যে, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ড বা পাসপোর্ট নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। মতুয়া কার্ডই নাগরিকত্বের প্রমাণ। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে এবং সংবাদ পত্রে এই খবর প্রচারিত হয়। সহজ সরল মতুয়ারা এই কার্ড পাবার জন্য ঠাকুরনগরে ভীড়  করতে শুরু করে। এই কার্ড পাবার হিড়িক এমন বেড়ে যায় যে বহু জেলার বহু শহরে অফিস খুলে এই মতুয়া কার্ড বিতরণ করা হয়। জানিনা শান্তনু ঠাকুরদের কাছ থেকে কত লক্ষ মতুয়া কার্ড সংগ্রহ করেছেন। এই কার্ডের তালিকা বিজেপি মারফৎ ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা Intelligence Bureau (IB) এবং Research and Analysis Wing (RAW) হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে কিনা তাও জানিনা! যদি সত্যি তুলে দেওয়া হয় তার কী পরিণতি হতে পারে তা এবার অনুধাবন করুন!

 ১৯/০৭/২০১৬ তারিখে লোক সভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পেশ করার সাথে সাথে বিজেপি সাংসদ অ্যাডভোকেট অশ্বিনী উপাধ্যায় সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা {No(s).924/2017} দায়ের করলেন। রোহিঙ্গা খোঁজার অছিলায় বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে বের করে ভারত থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য আবেদন করলেন। ঠিক একই ভাবে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে অসমে মুসলমান এবং বাংলাদেশীদের খোঁজার নাম করে এনআরসি করার দাবী করেছিলেন সর্বানন্দ সোনোয়াল(Sarbananda Sonowal vs Union Of India & Anr on 12 July, 2005)। আসামে এনআরসি এর নামে মতুয়া, নমশূদ্র, আদিবাসী এবং মুসলিমদের কী দশা হয়েছে তা আমরা জানি।      

 অ্যাডভোকেট অশ্বিনী উপাধ্যায় এই জনস্বার্থ মামলায়  দাবী করেছেন যে, “বিদেশী আইন- ১৯৪৬ “ এর অধীনে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলিকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা ব্যবহার করে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা এবং তাড়িয়ে দেবার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আশংকার বিষয় যে বিপুল পরিমাণে মায়ানমার এবং বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী ভারতের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে ঢুকে এখানকার জনবিন্যাসের উপর শঙ্কা তৈরি করছে এবং ভয়ঙ্কর ভাবে রাষ্ট্রের একতা এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে তুলেছে। ল’কমিশনের ১৭৫তম প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীরা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এই দেশের বিশাল অঞ্চল দখল করে আছে। এই অবৈধ দখলদারী কেবল মাত্র আমাদের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছেনা, এটা ভারতের মানুষের বাঁচার অধিকার এবং স্বাধীনতার অধিকারকে বিঘ্নিত করছে।

এই মামলায় বর্ণনা করা হয়েছে যে, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের জন্য আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, মিজোরাম এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলাগুলির জনসংখ্যা এমন হারে বেড়ে গেছে যা ভারতের গড় জনসংখ্যার থেকে অনেক বেশি। এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের জন্যই আসামের মূলনিবাসীরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে যেমনটি ঘটেছে ত্রিপুরা এবং সিকিমে। এই ভয়ঙ্কর বিষয়কে সবাই প্রাদেশিকতার সাথে গুলিয়ে দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করছেন।  

এই মামলায় আরো বলা হয়েছে যে, রোহিঙ্গিয়া এবং বাংলাদেশীরা হাওয়ালার মাধ্যমে টাকা এনে নানা ধরণের দেশ বিরোধী কার্যকলাপ করার চেষ্টা করছে এবং জাল/অবৈধ উপায়ে ভারতীয় প্রমাণপত্র যেমন প্যানকার্ড, ভোটারকার্ড সংগ্রহ করছে।

 অ্যাডভোকেট অশ্বিনী উপাধ্যায় এই মামলার শেষে সেই সব ট্রাভেল এজেন্ট, সরকারী চাকরিজীবী যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের প্যানকার্ড, আধারকার্ড, রেশনকার্ড, পাসপোর্ট এবং ভোটারকার্ড পেতে সাহায্য করছেন তাঁদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আদালতে আবেদন করেছেন।

২০১৭ সালেই হাড়িকাঠ সাজিয়ে রেখেছিল বিজেপি। পরিকল্পনা অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের তিন বেঞ্চের সিজেআই এসএ বোবদে, জাস্টিস এসএস বোপন্না এবং ভি রামসুব্রমনিইয়ান এর মত বিচারকেরাও তৈরি ছিলেন।

ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সহ আর ৪টি রাজ্যে নির্বাচনের নির্ঘণ্ট জানিয়ে দেওয়া হল। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, করোনা নিয়ন্ত্রণের অপারদর্শিতা, কৃষিনীতি, শিক্ষানীতি সব বিসর্জন দিয়ে নাগরিকত্ব পাওয়ার আবেগ বাড়িয়ে তোলা হল মতুয়াদের মধ্যে। তাঁরা বিপুল উৎসাহে বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আনার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। সারদা, নারদা, রোজভ্যালির  কাঁদা, ইডি, সিবিআই’এর প্রতিনিয়ত ভ্রূকুটি থেকে রক্ষা পাবার জন্য বিজেপির পবিত্র গঙ্গাজলে অবগাহন করতে ছুটে এল তৃণমূলের নামি দামী বহু নেতা-নেত্রী। ৮ দফায় ভাগ করে দীর্ঘায়ীত করা হল পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভা নির্বাচন। রাজ্য দখলের দামামা বাজিয়ে দিলেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ সহ বিজেপির সমস্ত উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। এঁরা কোভিড নিয়ন্ত্রণের কথা  উপেক্ষা করে জাতীয় স্তরের সমস্ত কর্মসূচীকে বন্ধ রেখে বাংলায় ঘাটিগেড়ে বসে নির্বাচনকে একেবারে যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বলিউড, টলিউডের চিত্রতারকা সহ সমস্ত পোষা মিডিয়াগুলি বিজেপির বাংলা দখল নিয়ে এতটাই নিশ্চিত ছিল যে ফল প্রকাশের আগেই সম্ভাব্য মূখ্যমন্ত্রী নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল। বাংলায় গৈরিক ঝড় উঠবে। স্বাগত জানাতে বাঁধা হল বিশাল তোরণ। 

২৭শে মার্চ ভোট শেষ হবে। ২রা এপ্রিলে হবে বিশাল উত্থান। আইবি, সিবিআই এবং রিসার্স এন্ড আনালিসিস উইং এমনই সঙ্কেত দিতে শুরু করল। এমনই এক মহেন্দ্রক্ষণে ২০১৭ সালের পড়ে থাকা মামলাতে শান দেবার জন্য ২৬শে মার্চ সুপ্রিমকোর্টে রিমাইন্ডার দিলেন বিজেপির সাংসদ অশ্বিনী উপাধ্যায়। দাবী রাখলেন অবিলম্বে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে রোহিঙ্গিয়া সহ সমস্ত বাংলাদেশীদের চিহ্নিত করতে হবে এবং দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে এদের তাড়িয়ে দিতে হবে।  

২রা এপ্রিল, ২০২১ একটু বেলা গড়াতেই বোঝা গেল বাংলার সচেতন জনগণ বিজেপির হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করার জন্য তৃনমূলকেই আবার বিপুল ভাবে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আসছেন। ফল প্রকাশের প্রবণতা থেকে বোঝা গেল যে আদিবাসী এবং মুসলিম ভোটের জোরেই রক্ষা পেল বাংলা। এই জাগ্রত মানুষেরাই বিজেপির পরিকল্পিত সিএএ-২০১৯, এনপিআর এবং এনআরসি মরণ ফাঁদ রুখে দিল। এই জাগ্রত মানুষেরাই নিশ্চিত মরণ ফাঁদ থেকে রক্ষা করলেন মতুয়া এবং নমশূদ্রদের। এঁরাই ট্রাইবুনালের মাধ্যমে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করার ষড়যন্ত্র কার্যত ভোঁতা করে দিল। এক অনিশ্চিত দুর্ভোগের হাত থেকে মতুয়ারা বেঁচে গেলেন। একেবারে ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলে গেল নির্ঘাত মরণ। মতুয়ারা এর পরেও বিজেপি ঘনিষ্ঠতা না কমালে, বিজেপিকে বিষাক্ত বর্জ্য হিসেবে পরিত্যাগ করতে না পারলে তাঁদের মরণ কেউ আটকাতে পারবেনা।