Pages

Friday 11 April 2014

নারীর অধিকার ও বাবা সাহেব ডঃ বি আর আম্বেদকর

লিখেছেন ঃ কৃষ্ণা মণ্ডল বিশ্বাস           

“একজন বালিকা বা যুবতী বা বৃদ্ধা গৃহে স্বাধীন ভাবে কিছু করবেনা”। স্ত্রীলোক বাল্যে পিতার বশ্য থাকবে, যৌবনে স্বামীর অধীনে, স্বামী প্রেতলোক প্রাপ্ত হলে পুত্রের অধীনে থাকবে। কোন পরিস্থিতিতে নারী স্বাধীন থাকবে না’।
 (মনু স্মৃতি, ৫/১৪৭-১৪৮)
অথবা “নারী, বৈশ্য এবং শূদ্রগণ পাপ যোনিতে জন্ম”। (গীতা, ৯/৩২)
“ঢোল গাওয়ার পশু শূদ্র নারী
ইয়ে সারে তদন কী অধিকারী”। (রামচরিত মানস, তুলসী দাস)
“নারী নরকের দ্বার” অথবা “নারীর অধিকার কেবল সন্তান জন্মানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে”.
ভারতীয় নারীদের উপর এমন অনুশাসনের পারম্পরিক বোঝা নিশ্চিত ভাবেই নারীকে সম্মানিত করেনি বরং নারীর আত্ত মর্যাদা, আত্ত পরিচয় ও ব্যক্তিত্বকে শাসক ও পুরোহিততান্ত্রিক সংস্কারের বেড়াজালে অবরুদ্ধ করা হয়েছে। পতির পূন্যেই সতীর পুণ্য এমন আপ্ত বাক্যের আবেগে নারীকে মোহাবিষ্ট করে রাখা হয়েছিল বহুকাল। বোঝানো হয়েছিল এতেই নারীর মঙ্গল। এটাই নারীর ইহকাল ও পরকাল। এই কুটিলতা ও ছলনার ভুল ভুলাইয়াতে পড়ে নারী তার অস্তিত্বটাই হারিয়ে ফেলতে বসেছিল। ভুলতে বসেছিল সে মানবী। সার্বিক মানবাধিকারের অর্ধেক দাবীদার। সৃষ্টির অর্ধেক রূপকার। বিবর্তনের ইতিহাসে যা কিছু নিদর্শন তার বিনম্র সহচারী।
পুরুষ ও পুরোহিতের এমন ছলনার মোহে সে ভুলে গিয়েছিল সব। যার জন্যই নারী পরিণত হয়েছিল দাসী, বাদী ও ভোগের সামগ্রিতে। বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ এবং অকাল বৈধব্য ও সতী প্রথার মতো অসংখ্য কুসংস্কারের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল নারীর মাথায়। ঈশ্বরের নামে, ধর্মের নামে নারীকেই বলির যূপকাষ্ঠে চড়ানো হয়েছিল। বাঙলায় পাল যুগ অবসানের পর থেকে ব্রটিশ পূর্ব ভারতের এটাই ছিল অমোঘ বিধান।
নারীদের চেতন অবচেতন মনের মধ্যে এখনো এই কুসংস্কারের জঞ্জাল রয়েগেছে।
আমরা উৎকণ্ঠার সাথে লক্ষ্য করছি যে, ভোগবাদী ছলনা ও প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে বহু নারী তাদের দেহ সৌন্দর্য কে বাজারের পণ্য হিসেবে বিক্রি করে অর্থ উপার্জন করছে। ব্যবসাদারেরা বিজ্ঞাপনে, টিভি সিরিয়ালে, সিনেমাগুলিতে নারীদেহের খোলাবাজার বসিয়ে প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে অস্ত্র তুলে দিচ্ছে।
কিন্তু শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে সেই মহামানব কে আমার ভক্তি পূর্ণ প্রনাম জানাচ্ছি যিনি পুরোহিততন্ত্র ও ভোগবাদী এই চিন্তাগুলিকে আবর্জনা হিসেবে প্রত্যাখ্যান করতে বলেছিলেন। তিনি পরম পূজনীয় বাবা সাহেব ডঃ ভীমরাও রামজী আম্বেদকর।
“আমরা অতি শীঘ্রই সেই শুভদিন দেখব এবং আমাদের উন্নয়ন আরো গতিশীল হবে যদি পুরুষের সাথে সাথে আমরা নারী শিক্ষায় মনোযোগী হই। নারী সমাজ কতটা এগোতে পারল সেই নিরিখেই আমি সমাজের অগ্রগতির পরিমাপ করি। একটি নারী শিক্ষিত হলে একটি পরিবার ও সুশিক্ষিত হয়”। ......
১৯২০ সালে মূখনায়ক ও ১৯২৭ সালে ‘বহিষ্কৃত ভারত’এ প্রকাশিত এই যুগান্তকারী বিবৃতির মধ্য দিয়েই মনুবাদী শাসনব্যবস্থার অচলায়তন পাহাড়গুলিকে ভাঙতে শুরু করলেন একালের বোধিসত্ত্ব বাবা সাহেব ডঃ বিআর আম্বেদকর। অথচ এই নারী সত্তাকে অবদমিত, অপমানিত ও শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছিল যুগের পর যুগ।
নারীদের অধিকার ও আত্মমর্যাদা বিকাশের ক্ষেত্রে তিনি তাঁর ভাবগুরু মহাত্তা জ্যোতি রাও ফুলের পদাঙ্ক অনুসরণ করলেন। যেভাবে মহাত্তা জ্যোতি রাও ফুলে স্ত্রী সাবিত্রী ফুলেকে শিক্ষিতা করে তুলেছিলেন এবং ভারতবর্ষে নারী আন্দোলনের এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন, সেই ভাবেই বাবা সাহেব তার স্ত্রী রমাবাই আম্বেদকরকে সভানেত্রী হিসেবে সামনে রেখে মহিলা সংঘ গড়ে তুলেছিলেন। এই মহিলা সংঘের নেতৃত্বেই নাসিকে কলরাম মন্দিরে প্রবেশের সত্যাগ্রহ পালিত হয়েছিল। অধিকাংশ নারীকে বন্দী করা হয়েছিল। নির্মম আচরণ করা হয়েছিল তাদের সাথে। পুরুষের সাথে রাখা হয়েছিল জেলখানায়। কিন্তু নারীরা তাতে দমে না গিয়ে আরো বিপুলভাবে আম্বেদকরের আন্দোলনে সামিল হতে থাকেন। তিনি নারীদের এমনভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন যে এক প্রেস বিবৃতিতে রাধাবাই ভাদালে বলেছিলেন, “ চূড়ান্ত ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে একশবার মরা ভাল। আমরা আত্তবিসর্জন দেবো কিন্তু ছিনিয়ে নেবো আমাদের কাঙ্ক্ষিত জয়”।
বাবা সাহেব সেই আন্দোলনে বেশি উৎসাহিত বোধ করতেন যা নারীদের দ্বারা পরিচালিত। তিনি উল্লেখ করতেন যে নারীরা যদি জীবনের সকল কাজে উৎসাহ বোধ করে তবে তা সামাজিক পুনর্গঠনে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হবে। সামাজিক উৎপীড়ন বন্ধ করার জন্য নারীরাই সর্বশ্রেষ্ঠ চালিকা শক্তি। তিনি নারীদের পুরুষকে স্বামী না ভেবে বন্ধু ভাবতে এবং তার সাথে সমান চারিত্রিক সক্ষমতা রাখতে উৎসাহিত করতেন। তিনি মনে করতেন যে, নারীরা এই গুণগুলি অনুসরণ করলে তারা আত্তপরিচয় ও আত্তমর্যাদা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
১৯২০ সালে মূখ নায়ক পত্রিকা প্রকাশনার মধ্য দিয়ে বাবা সাহেব আম্বেদকর তাঁর আন্দোলন সূচনা করেন। ১৯২৭ সালে তিনি প্রকাশ করেন বহিষ্কৃত ভারত। এই পত্রিকা গুলির মাধ্যমে তিনি দলিত সমাজের সমস্যাগুলি ও লিঙ্গ সমতার উপর বিশেষ জোর দেন। পুরুষের সাথে সমান দক্ষতায় সমান ক্ষমতা অর্জন করার উপরেই তিনি গুরুত্ব দেন। নারীর সম্পত্তির অধিকার ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে তাঁর অনলস প্রয়াস বিশ্বের সনামধন্য নারীবাদীদেরও উৎসাহিত করে। নেশা বা মাদক দ্রব্য গ্রহণের বিপক্ষে বম্বে বিধান সভায় তিনি বক্তব্য রাখেন। তিনি বলেন যে মনোবিজ্ঞানের মতে নেশাই পারিবারিক কলহের অন্যতম কারণ। এতে নারী পুরুষের আভ্যন্তরীণ সখ্যতা ও সহনশীলতা ধ্বংস হয়ে যায়। তিনি উল্লেখ করেন যে, নারীদের এমন পোশাক পরা সমীচীন নয় যা তাঁর নারী সত্ত্বাকে অপমানিত করে।
খসড়া সংবিধানে তিনি এমন কিছু প্রস্তাব রাখেন যা নারীর কল্যাণ ও সামাজিক অধিকার সুনিশ্চিত করবে। সংসদে তিনি মেটারনিটি বেনিফিট বিল ও নারীর সম্পত্তির অধিকারের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে হিন্দু কোড বিল উপস্থাপন করেন। জহরলাল নেহেরু সহ অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের কাছ থেকে এই বিল প্রবল বাঁধার সম্মুখীন হয়। নারীদের অধিকার আদায়ে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের এমন অনীহা দেখে তিনি ব্যথিত হন এবং মন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। শুধু মাত্র নারীদের ক্ষমতায়নের জন্য এমন আত্তত্যাগ ইতিহাসের এক বিরল বিরলতম ঘটনা।
জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে তদারকি সরকার হিন্দু কোড বিল স্বীকার না করলেও ভারতের প্রথম আইন মন্ত্রী ও ভারতীয় সংবিধানের রচয়িতা হিসেবে তিনি নারীর অধিকারকে সাংবিধানিক হিসেবে কার্যকর করেন তোলেন। মনুস্মৃতিতে যেভাবে নারীকে দাসী, বাদী, নির্বোধ হিসেবে অবজ্ঞা করা হয়েছিল, বিদ্যা, শিক্ষা, অস্ত্র ধারণ ও সম্পত্তি থেকে বহিষ্কৃত করা হয়েছিল সংবিধানের রূপকার হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে মূলত মনুর বিধানকে একেবারে অকেজো করে দিলেন। নারীদের পূর্ণ মানবী হয়ে ওঠার জন্য তিনি সংবিধানের নানা অধ্যায় রচনা ও নিজে আইন মন্ত্রী হিসেবে সেই অধ্যায় গুলিকে মান্যতা দিয়ে নারীর অধিকারকে শুধু প্রাসঙ্গিক নয় ভারতীয় নারীকে বিশ্ব মানবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে তুললেন।
নারীদের পর্যাপ্ত ভাগীদারীর জন্য সংবিধানের মধ্যে যে যে ধারাগুলি তিনি সংযোজিত করেছিলেন তার কিছুটা এখানে সংযোজিত হলঃ
অধ্যায় ১৪ ঃ সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সুযোগের সমানাধিকার।
অধ্যায় ১৫ ঃ লিঙ্গ বৈষম্যের উপর নিষেধাজ্ঞা।
অধ্যায় ১৫(৩) ঃ নারীদের উপর ভেদবাবের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা।
অধ্যায় ৩৯ ঃ জীবিকা নির্বাহের সমান অধিকা ও সমান কাজের সমান বেতন।
অধ্যায় ১৪ ঃ কার্যক্ষেত্রে মানবীক পরিবেশ ও মাতৃত্বকালীন ছুটি।
অধ্যায় ২৪(৩ডি), (৩টি) এবং (৩ আর) ঃ পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থায় মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ।
নারীদের এবং দুর্বলতর সমাজের স্বাধিকারের এই অদম্য লড়াইতে তিনি ছিলে দৃঢ় চিত্ত, দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সম্ভবত একলব্যের ভুলের কাহিনী থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন তিনি। তাই ছিলেন সদা সতর্ক এবং অক্লান্ত। একক ভাবেই ভেদ করেছিলেন মনুবাদীদের চক্রব্যূহ। লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও নিপীড়িতদের সার্বিক উত্থানের সমস্ত সম্ভাবনা নিশ্চিত করেছিলেন সংবিধানের বিভিন্ন অধ্যায়ে। ভোগবাদী অর্থনীতির ফাঁদে পড়ে আজ সমস্ত পৃথিবীর মানুষ বিকল্প কল্যাণকারী ব্যবস্থার সন্ধান শুরু করেছে আর প্রবলভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছেন বাবা সাহেব এবং তার ভাগীদারী অর্থনৈতিক বিধান। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ম্যান অব দ্য মিলেনিয়াম খেতাব, অক্সফোরড ইউনিভার্সিটির ১০০০ বছরের শ্রেষ্ঠ মনিষী ও সিএন,আইবিএন আয়োজিত গ্রেটেস্ট ইন্ডিয়ান খেতাব তার ক্রমবর্ধমান গ্রহণযোগ্যতা প্রমানিত হয়েছে। আমরা আরো বেশি সংবদ্ধ হলে তার প্রদর্শিত পথেই ভারত তথা পৃথিবীর সার্বিক কল্যাণ সূচীত হবে।
জয় ভীম, জয় ভারত।

1 comment:

  1. খুব ভালো লেখা। বাবা সাহেব প্রকৃতই মহামানব। উনি না থাকলে আজ ভারতবর্ষের বর্তমান ইতিহাস অন্য হত।

    ReplyDelete