“বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও ” ভারতের একটি রাষ্ট্রীয় যোজনা। নিশ্চিতরূপে নারীর জীবনকে সমৃদ্ধ এবং সুরক্ষিত করে একটি মজবুত ভারত গড়ে তোলাই এই যোজনার লক্ষ্য। নারী যাতে সুশিক্ষিত হয়ে যোগ্যতর ভারতমাতা হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সে দিকেও নিশ্চিতভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এই যোজনায়। সর্বোপরি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে শিক্ষিত মায়ের উপযুক্ত সন্তানদের উপর যাতে তারা দেশের প্রয়োজনে “ভারতমাতা কী জয়” ধ্বনি তুলে গর্বের সাথে দেশপ্রেম ব্যক্ত করতে পারে এবং দেশের অখণ্ডতা ও সংস্কৃতি রক্ষা করার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকে।
পাশাপাশি এটাও ভেবে
দেখার বিষয় যে ভারতরাষ্ট্র যেন এমন কোন উৎসবকে স্বীকৃতি না দেয় যেখানে কোন কল্প কাহিনীর আধারে “হোলী” নামে কোন নারীর
নৃশংস খুন ধর্মীয় আবেগে জারিত হয়ে জনমানসে
সংক্রামিত হয়ে যায় এবং মিলনের আনন্দকে ম্লান করে দেয়। একদিকে “ভারত মাতা কী জয়” অন্যদিকে “হোলি হ্যায়”
নামক মাতৃ হত্যার উন্মত্ত উল্লাস এক সঙ্গে চলতে পারে কী!
মূলত কয়েকটি গ্রন্থের
উপর ভিত্তিকরে গড়ে উঠেছে হোলী নামে অসুর নারী হত্যার বেলাগাম এই উৎসব। দন্ডিনের সংস্কৃত
নাটক দশকুমারচরিতে হোলির উল্লেখ আছে। রাজা হর্ষবর্ধনও তার রত্নাবলী নাটকে হোলি
উৎসবের কথা উল্লেখ করেছেন। বিশেষত হোলিকার উপকথা বর্ণিত হয়েছে গুপ্ত আমলে তৈরি ভগবৎ
পুরাণে এবং এই কাহিনীটিই উত্তর ও পূর্ব ভারতে সর্বাধিক প্রচলিত কাহিনী। মুঘলদের হারেমের
নানা মিনিয়েচারে হোলি উৎসবকে চিত্রিত করে তোলা হয়েছে।
পৌরাণিক কাহিনী
অনুসারে হোলীকাঃ
বুড়ীর ঘর জ্বালানোর মধ্য
দিয়ে সূচনা হয় হোলী উৎসবের? কোথাও একে বালা হয় নেড়া পোড়ানো, কোথাও বলা হয় হোলিকা
দহন। কিন্তু কে এই হোলিকা ? কেন তাকে এখনো রাষ্ট্রীয় ঘৃণায় দহন করা হয়? কেন তার রক্তের
প্রতীক হিসেবে আবির খেলা করা হয়?
এর উৎস খুঁজে পাওয়া
যাবে ভগবৎ পুরাণের হিরন্যকাশ্যপ কাহিনীতে।
হিরন্যকাশ্যপ এক পরাক্রমী অসুররাজা ছিলেন। পুরাণে তাকে অহংকারী এবং লোভী হিসেব বর্ণনা করা হয়েছে। এই হিরন্যকাশ্যপের ছেলে প্রহ্লাদ ছিল বিষ্ণু
বা নারায়ণ ভক্ত। বিষ্ণু অসুর রাজাদের প্রতিপক্ষ। নিজের ছেলে প্রহ্লাদ বিষ্ণু ভক্ত
হওয়ার কারণে হিরন্যকাশ্যপ তাকে হত্যা করার জন্য নানা কৌশল ব্যবহার করেন। পুরাণে আরো
বলা হয়েছে যে হিরন্যকাশ্যপের বোন হোলিকা ছিলেন মায়াবিনী রাক্ষসী। তাকে আগুনে পোড়ানো
যেত না। প্রহ্লাদকে মারার উপায় হিসেবে হিরণ্যকাশ্যপের আদেশে হোলীকা তাকে কোলে নিয়ে
আগুনে প্রবেশ করে। দেবশক্তির প্রভাবে এবং নারায়ণের নামের গুনে প্রহ্লাদ আগুন থেকে বেরিয়ে আসে কিন্তু হোলিকা জ্বলে
খাক হয়ে যায়। এই ভাবে হোলিকার মৃত্যু হলে দেবকুল উল্লাসে মত্ত হয়ে ওঠে। হোলীকার চিতাভষ্মের উপর রচিত হয় হোলী উৎসব।
লোক কাহিনী অনুসারে হোলীকাঃ
পুরাণ কাহিনীতে যে
হোলীকাকে রাক্ষসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছ লোককাহিনী সেই হোলীকা মহীয়সী নারী হিসেবে বর্ণীত হয়েছে্ন। ভারতবর্ষের বিশাল অংশের
জনপুঞ্জের লোকাচারে এই হোলীকাকে মাতা জ্ঞানে পূজা করা হয় এবং তার মৃত্যু দিবসকে
শোক দিবস হিসেবে স্মরণ করা হয়। এই লোকাচার বা পরবের সাথে যে ব্রতকথা যুক্ত আছে
তা পুরাণ কাহিনীর মতই আর একটি মাইথলজী। এই মাইথলজীও আর্য এবং অনার্য সংঘাতের
প্রেক্ষাপটে রচিত। এখানে বর্ণীত হয়েছে যে, প্রাচীন কালে সুর বা দেবতা এবং অসু্রের যুদ্ধ
ছিল নিত্যকার ঘটনা। দেবতারা জম্বূ দ্বীপের
দিকে অগ্রসর হলে প্রবল পরাক্রান্ত রাজা হিরন্যকাশ্যপ তার মাতৃভূমি রক্ষা করার জন্য রুখে দাঁড়ায়। হিরন্যকাশ্যপের ভাই হিরন্যক্ষ
ছিলেন আরো দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। ঘটমান এক যুদ্ধের সময় দেবতাঁদের সেনাপতি বরাহের রূপ ধারণ করে হিরন্যক্ষকে হত্যা করেন।
দেবকুল হিরন্যকশ্যপকে বেদ, বিধি, শৌচাচার মেনে
নিয়ে বশ্যতা শিকার করতে চাপ দিতে থাকে। তারা হিরন্যকাশ্যপকে শর্ত পাঠায় যে হিরন্যকাশ্যপ যদি ব্রাহ্মণদের যজ্ঞ করার অধিকার, ট্যাক্স,
জমি, খাদ্য শস্য, গরু, মদ এবং যুবতী নারী পাঠায় তবে তাকে যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হবে
না। হিরন্যকাশ্যপ এই অমর্যাদাকর শর্ত পরিত্যাগ করে নিজের মাতৃভূমি
রক্ষা করার জন্য প্রবল
প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তিনি যখন সৈন্য শিবিরে ছিলেন তখন দেবরাজ ইন্দ্র ঝটিতি হিরন্যকাশ্যপেরর রাজধানী
আক্রমণ করে এবং গর্ভবতী রাজমহিষী কায়াধু(কাপারু)কে অপহরণ করে নিয়ে যান। নারদ বহু কৌশলে
রাজমহিষীকে রক্ষা করেন এবং তাঁকে নিজের আশ্রমে
নিয়ে আসে। নারদের আশ্রমেই জন্ম হয় প্রহ্লাদের এবং ছোটবেলা থেকেই প্রহ্লাদ দেবতাদের
ভক্ত হয়ে ওঠে। রাজা হিরণ্যকাশ্যপ এক ঝটিতি আক্রমণে রাজমহিষী কায়াধু এবং রাজপুত্র প্রহ্লাদকে উদ্ধার
করে হিরণ্যপুরীতে নিয়ে আসেন কিন্তু শিশু প্রহ্লাদের দেবপ্রেম দেখে চিন্তিত হয়ে
পড়েন। রাজা নিজের বোন হোলীকাকে প্রহ্লাদের শিক্ষিকা হিসেবে নিযুক্ত করেন যাতে সে
প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারে এবং দেবতাদের প্রভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারে।
হোলীকা ছিলেন বিদুষী। জনকল্যাণকারী ভূমিকার জন্য
প্রজাপুঞ্জের কাছে তিনি ছিলেন মাতৃসম।
প্রহ্লাদকে
দেবপ্রেমে আচ্ছন্ন করে হিরণ্যপুরীতে ঢুকে পড়ে দেবকুল। সুযোগ বুঝে তাঁদের সেনাপতি
নরসিংহের ছদ্মবেশ ধারণ করে রাজা হিরণ্যকাশ্যপকে হত্যা
করেন এবং প্রহ্লাদকে সিংহাসনে বসিয়ে কার্যত রাজ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে ফেলে।
প্রহ্লাদ একটু পরিণত
হলে হোলীকা তাঁকে সত্য ঘটনা খুলে বলেন এবং প্রহ্লাদকে দেবতাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করেন।
প্রহ্লাদও পিতা হিরন্যকাশ্যপের পথ
অবলম্বন করে দেবতাদের উপহার দেওয়া বন্ধ করে দেন। রাজ্যের মধ্যে যজ্ঞ নিষিদ্ধ করেন।
ভূমি, মদ এবং যৌনাচারের জন্য যুবতী নারী দেওয়া বন্ধ করে দেন।
গুপ্তচর মাধ্যমে দেবতারা
জানতে পারেন যে হোলীকার পরামর্শেই প্রহ্লাদ এই নীতি ঘোষণা করেছেন। তারা বুঝতে
পারেন হোলীকা জীবিত থাকলে প্রহ্লাদ কখনোই দেবতাদের বশীভূত হবে না। দেবতারা হোলিকাকে
বন্দী করেন। তাঁকে কারারুদ্ধ করে খাদ্য এবং পানীয় বন্ধ করে দেন। দিনের পর দিন
খাদ্যের জন্য চিৎকার করতে থাকেন হোলীকা। তার আর্ত চিৎকার আকাশ বাতাস ব্যথিত করে
তোলে। মাতৃসম হোলীকার এই নিদারুণ কষ্টের কথা শুনে প্রজারা খাদ্য এবং পানীয় নিয়ে প্রহ্লাদের
কাছে ছুটে যান। জনবল দেখে প্রহ্লাদ নিজের সৈন্যের সাহায্যে হোলিকাকে মুক্ত করেন। কিন্তু
সেই রাতেই ব্রাহ্মনেরা তাঁকে ছিনিয়ে নিয়ে একটি খোলা মাঠে গাছের খুঁটির সাথে বেঁধে ঘাস
পাতা দিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলে। অসহায় নারীপুরুষ তাদের সম্মানীয় মাতার এই নিদারুণ পরিণতি
দেখে শোকে বিহ্বল হয়ে কাঁদতে থাকে।
লোকায়ত সংস্কৃতির
মধ্যে এই পুরাতনী বার্তা গভীর ভাবে প্রথিত হয়ে আছে। জনগণ হোলীকার এই মৃত্যু দিনকে শোক দিবস হিসেবে পালন করার এক পরিক্রমা শুরু করে। তারা চিতা জ্বালিয়ে তার উপর গোলাপ জল ছিটিয়ে মূলনিবাসীদের প্রাচীন সভ্যতা ও ধম্ম রক্ষা করার জন্য রাজা হিরণ্যকাশ্যপ এবং হোলীকার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। এই শোকপালনরে অনুষ্ঠানের একটি পারম্পরিকতা তৈরি হলে বামুনেরা গুপ্ত
যুগে কাল্পনিক বিষ্ণুর নরসিংহ অবতারের কাহিনী তৈরি করে প্রাচীন ঐতিহাসিক তথ্য ধ্বংস করে দেয়। মূল ভারতীয় মহান অসুর রাজাদের
অশুভ শক্তির প্রতীক সাজিয়ে পুরাণ কাহিনী গড়ে তোলে।
একেবারেই যুক্তি বুদ্ধি বা ইতিহাসের তোয়াক্কা না করে ভারতের পূর্বতন এবং বর্তমান সরকার যে ভাবে পুরাণ কাহিনীকে ভিত্তি করে কিছু রাষ্ট্রীয়
উৎসবের দিন ধার্য করেছেন তা সত্যিই হাস্যকর। এই উৎসবগুলি এবং তার থেকে উতসারিত আবেগ বা অজ্ঞতা ভারতের প্রগতির পক্ষে এক বড় অন্তরায়। বিশেষ করে হোলী উৎসবের মত নারী হত্যার এক বিশাল আয়োজন “বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও” উদ্দেশ্যকে ম্লান করে “বেটি মারো, বেটি পোড়াও” এর বার্তাকেই অনেক বেশি প্রাধান্য দেয়।
এই বার্তাটি আরো প্রবল হয়ে ওঠে ২০১৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর নিজের বাড়ীর সামনে আততায়ীদের হাতে গৌরী লঙ্কেশের নিহত হওয়ার ঘটনায়। গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যুর পরে ব্রাহ্মন্যবাদী শিবির উল্লাসে ফেটে পড়ে। স্মৃতি ইরানীর পার্শ্বচর ব্রাহ্মনবাদী শিবিরের আইটি সেক্টরের কিছু কর্মীরা যেভাবে গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যুতে আনন্দে ফেটে পড়ে এবং তার বিরুদ্ধে বিষ ঢালতে থাকে তাতে প্রমানিত হয় কোন নারী ব্রাহ্মনবাদ বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করলে তাকে হত্যা করা হয় এবং তার রক্ত নিয়ে হোলী খেলতে দেবশিবির এখনো পিছপা হয় না।
এই বার্তাটি আরো প্রবল হয়ে ওঠে ২০১৭ সালের ৫ই সেপ্টেম্বর নিজের বাড়ীর সামনে আততায়ীদের হাতে গৌরী লঙ্কেশের নিহত হওয়ার ঘটনায়। গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যুর পরে ব্রাহ্মন্যবাদী শিবির উল্লাসে ফেটে পড়ে। স্মৃতি ইরানীর পার্শ্বচর ব্রাহ্মনবাদী শিবিরের আইটি সেক্টরের কিছু কর্মীরা যেভাবে গৌরী লঙ্কেশের মৃত্যুতে আনন্দে ফেটে পড়ে এবং তার বিরুদ্ধে বিষ ঢালতে থাকে তাতে প্রমানিত হয় কোন নারী ব্রাহ্মনবাদ বিরোধী ভূমিকা গ্রহণ করলে তাকে হত্যা করা হয় এবং তার রক্ত নিয়ে হোলী খেলতে দেবশিবির এখনো পিছপা হয় না।
Nice information.
ReplyDeleteok
ReplyDeleteভারতের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ঘাটন এবং ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী কদর্য সংস্কৃতির মুখোশ উন্মোচনই এই সময় এর প্রথম কর্তব্য।
ReplyDeleteএই সত্য ইতিহাসের বেশি বেশি করে প্রচার হওয়া দরার। বহুজন সমাজ আর কতদিন ব্রাহ্মণ্যবাদের গোলামি করবে?
ReplyDelete