Pages

Sunday, 4 March 2018

বসন্ত বাতাসে সই গো…




ফাগুণ আসে শিমূলের ডালেপলাশের বনে আর কৃষ্ণচূড়ার শাখায় শাখায়। ফাগুণ আসে শাল- মহুলের পাতার ফাঁকে। ফাগুণ আসে মৌমাছিদের পাখায় পাখায় আর ভ্রমরের গুঞ্জরনে। ফাগুণ আসে বলেই মনের বনে হিন্দোল তোলে দক্ষিণা বাতাস। ফাগুণ আসে বলেই দুরন্ত যৌবন ঝুমকো লতার ফাঁক  দিয়ে বন্ধুর বাড়ির বন্ধ দরজায় আঘাত হানে। জানিয়ে দেয় বসন্ত এসে গেছে।



বিবর্তনের কোন বাঁকে এসে কবে কোন শিকারী পুরুষ বনের গুঞ্জাফুল তুলে  তার প্রেয়সীর খোঁপায় গুঁজে দিয়ে নিজেকে পুরুষ হিসেবে আবিষ্কার করেছিল জানি না। শুধু বুঝতে পারি প্রকৃতির এই গুঞ্জরিত ফুল-ফলের সমাবর্তনে পাখির কলতানের সাথে সাথে আমাদের আদিম পিতা-মাতার কণ্ঠেও ভেসে উঠেছিল জীবনের গান। বসন্ত তাই জীবনেরই অগ্রদূত। মধুর মিলনই  জীবনের যথার্থ অভিব্যক্তি।



নানা উপচারে বসন্ত উৎসবঃ 
 

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নানা নামে বসন্তকে স্বাগত জানানো হয়। নানাবিধ উপচারে বরণ করা হয় তাকে। সুইজারল্যান্ডে বসন্তকে স্বাগত জানানো হয় “বুগগ দহন” (burning of Boogg) এর মধ্য দিয়ে। বুগগ আসলে শীত মানবের (snowman) প্রতীক। শীতের চাদর সরিয়ে ফেলে গাছে গাছে ফুল ফুটতে শুরু করলে বুগগকে দহনের পালা শুরু হয়। খোলা মাঠে কাঠ দিয়ে চিতা সাজিয়ে শীত মানবের পুতুল পোড়ানো হয়। চলে নাচ গান আর পানের আসর।  



পোল্যান্ডে এই উৎসবকে বলা হয় “মার্জানা ভাসান”। এই পরবের অঙ্গ হিসেবে খড় দিয়ে বানানো হয় একটি পুতুল। এক বিপুল উৎসের মধ্য দিয়ে এই নদীতে ভাসিয়ে দিয়ে শীতের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। তারপর চলে বসন্তকে স্বাগত জানানোর নাচ গান।


জাপানে এই উৎসবের নাম “হানামী” (Hanami)। চেরী ফুল(জাপানী ভাষায় সাকুরা) এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। জাপানের মানুষেরা সাকুরা বা চেরীফুল ফোটার সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য নির্জন প্রান্তরে চলে যায়। অথবা নদীর বুকে নৌকা ভাসিয়ে চুপচাপ অনুভব করে চেরীফুলের সমারোহ। এই নির্জনতা তাঁদের জীবনে বয়ে আনে এক নতুন উপলব্ধি। হানামী জাপানী জনগণের কাছে জীবনের মূল্যায়নের কাল।

ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে বসন্ত উৎসবঃ

ভারতের নানা প্রদেশে বসন্তকে নানা উপায়ে নানা নামে আবাহন করা হয়।  অস্ট্রিক জাতি সমূহের কাছে এই পরব বাহা নামে পরিচিত। বাহাআসলে ফুলের পরব। শাল ফুল বা সারজোমএই পরবের অগ্রদূত। শাল গাছ আদিবাসী জীবনের এক পবিত্র চিহ্নও বটে। আদিবাসীদের পবিত্র থান  যা জাহের থান নামে পরিচিত সেখানে এই শাল গাছকে উর্বরতার প্রতীক হিসেবে পূজা করা হয়। শাল গাছ  দ্বারা পরিবৃত জাহের থানটির বিভিন্ন  কোনে অবস্থান করে বিভিন্ন বোঙ্গা। এদের মধ্যে জাহের আইয়োবা ধারতি মাতা প্রধান। তার নামেই পরিচিত এই থানটি। থানটি সাঁওতাল, কোল, মুন্ডা, হো, বীরহড়, চোড়ে প্রভৃতি জনজাতির আচার, বিচার সংস্কৃতির  কেন্দ্রস্থল। শালের জঙ্গলে পাতার ফাঁকে ফুলের প্রকাশ ঘটার সাথে সাথেই কুলী কুলী (পাড়ায় পাড়ায়) গীত হতে থাকে একটি সেরেং (গান)ঃ 
বাহা বোঙ্গা মুলু এনা
সারজোম দারে রে বাহা বোঙ্গা মুলুএনা ……”
অথবা
বাহা
বোঙ্গা পিরিল পিরিল চান্দোয় মোলোঃএন।

বাহা জতে পুরুই পুরুই দিশৌম পুলুকএন।

হালায় দালায় বাহাএনা সারি সারজমদারে।

পেরেচ গেলেএনা খোদে মাতকম।
(চাঁদের উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে ফুলের রানী প্রকাশ হল। ফুলে ফুলে ভরে গেল সমগ্র  দেশ। থোকায় থোকায় ফুটে উঠল শাল গাছের ফুল। মহুয়ার ফলে গাছ ভরে উঠলো।



এই সারজোমের বার্তা পেলেই  গ্রামের মাঝি, গড়েৎ, পারানিক, জগমাঝি, নাইকে, কুডামনাইকে সকলে মিলিত হয়ে একটি দিন নির্ধারণ করেন রাতে জাহের থানে হয় জাগরণ পরের দিন ভোর হলে গ্রামের যুবকেরা তুলে আনে শালগাছের ফুল পলাশের জঙ্গল যেন আগুনের পারা শাল, পলাশ, শিমুল, মহুল ফুলে তুলে এনে গ্রামের নাইকের(পুরোহিত) কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় নাইকে সেই  ফুল গ্রামের একজন নারীর হাতে তুলে দেন। গ্রামের নারী সেই ফুল তার কাপড়ের ভাঁজে সংগ্রহ করেন। মেয়েরা মাঝি, নাইকে এবং তাঁদের পারিষদবর্গকে   “লোটাদা” (জল দিয়ে পা ধুইয়ে দেন) করেন এই  ফুল উপহার একটি  বার্তা বহন করে সমস্ত নারী পুরুষ ফুলের উতসবে শামিল করে তোলে একজন অবিবাহিত যুবক তার কাঁধে করে জল বহন করে নিয়ে আসেন এবং সেই জল নারীদের মাথার উপর দিয়ে সিঞ্চন করে দেওয়া হয়। সংগৃহীত ফুলগুলি মেয়েরা খোঁপায় এবং যুবকেরা কানের পাশে গুঁজে নেয়।
জাহের থানে তৈরি হয় তিনটি খড়ের ঘর  এই তিনটি খড়ের ঘর তিন প্রধান বোঙ্গার জন্য এই তিন প্রধান হলেন জাহের এঁরা, মারাংবুরু এবং পরগণাবঙ্গা  গ্রামের নাইকে বা পুরোহিত পরিস্কার ধুতি পরে  জাহের থানে যান হাতে কাঁসার থালাতে থাকে গোবর, সিঁদূর, কলা, ধূপ আর নতুন নতুন ফুল। নাইকে নিজেই গোবর দিয়ে জাহের থান লেপ করেন তারপর সেখানে শুরু হয়  পূজা পূজা সেরে নাইকে গ্রামে ফিরে আসে



গ্রামের ছেলেরা যায় শিকারে। সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসে তাঁরা। তারপর সবাই মিলে নাইকের বাড়িতে জমায়েত হয়। সেখানে  শুরু হয়  নাচ-গান
“কাড়া কাডায় জবে আকান গাং নাইরে,

গাং নাইরে হালে জোড়া সামুদ্রে।।“

তুংদার বা মাদলে বাজতে থাকে
 “দা দা দাতালারে বাহু তিং ।
 “আর টমাকের বা ধমসা বোল তোলে হুগডা গুডাং

 এই যুগল বন্দীর তালে নাচতে নাচতে আবার তাঁরা ফিরে আসে জাহের থানে। জাহের থানের তিন প্রধান বোঙ্গার কাছে নাইকে নিবেদন করেন তাঁদের জীবনের সুখদুঃখের কাহিনী। কামনা করা হয় তাঁরা যেন পর্যাপ্ত বৃষ্টি পায়। যেন সোনার ফসলে তাঁদের শস্যগোলা ভরে ওঠে।

এক সময় বিদায় জানানো হয় তিন বোঙ্গাকে। গভীর রাত পর্যন্ত চলে নাচ, গান আর পানের আসর।   

কুড়মী, ওরাও, পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা আবার এঁকে শারুল পরব হিসেবে পালন করে। গড়াম থানকে কেন্দ্র করে চলে নানা ব্রতাচার।কাঠি আর পাতা নাচের ছন্দে  আনমনে শরীর দুলতে থাকে। মাদল, ধমসা আর শানাইয়ের সুরে সুর মিলিয়ে চলে ঝুমর গানঃ
“ধনি খোঁপা বান্ধে চাঁপা ফুলে
শাল মহুলের ফাঁকে কুহুকুহু ডাকে
ধনির পা জোড়াতে তাল খুলে...।“



ওঁরাও রমণীর কন্ঠে ধ্বনিত হয় মন কেমন করা গানঃ
“মুড়ে বান্ধে রঙ্গিল ফিতা
ঘেচায় রে গেন্দা মালা
গড় রুমঝুম ঘুঙ্গুরা বাজেলা
মন কিসান কারেলা”।



ভোজপুরী, মৈথিলীতে বসন্ত উৎসবকে বলা হয় ফাগুয়া। কোথাও এঁকে বলা হয় রঙ্গোলী। মহারাষ্ট্রে এই পরবকে বলা হয় শিগমা। গোয়া এবং কোঙ্কণ অঞ্চলে এটিকে আবার বলা হয় শিগমো। কেরালায় এই উৎসবকে বলা হয় মনজলকুলী বা হলুদ স্নান। তামিলনাড়ুতে বলা হয় “পাঙ্গুনি উত্থিরাম”। জনপুঞ্জের এই সমস্ত উৎসবের মধ্যে রয়েছে প্রেম, প্রীতি, ভালবাসা এবং ভ্রাতৃত্বের নিবিড় বন্ধ।                

বসন্ত উৎসবের এমন আনন্দঘন লোকাচারের মধ্যে “হোলী” একেবারেই বেমানান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাই হোলী উৎসবের পরিবর্তে শুরু করেছিলেন বসন্ত উৎসব।  “বাহা” পরবকে গভীর ভাবে অধ্যয়ন করে উত্তরণ ঘটিয়েছিলেন মধুর বসন্তের এক মিলনের উৎসবে। তাঁর গভীর প্রেমের বার্তা ছড়িয়ে পড়েছিল আশ্রমিকদের মধ্যেও। যে আবির এবং রং বসন্ত উৎসবে ব্যবহার করা হত তা তৈরি হত পলাশ, শিমূল এবং নানা রঙের ফুল ও পাতা থেকে। বসন্তকে এক মিলনের কাল হিসবে বর্ণনা করে কবি রচনা করেছিলেন একাধিক গান।
“ওরে গৃহবাসী
খোল দবার খোল লাগল যে দোল
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল
দ্বার খোল দ্বার খোল”।
অথবা
মধুর বসন্ত এসেছে আমাদের মধুর মিলন ঘটাতে...।।
বসন্তের এই মিলন মধুর আহ্বান সৃষ্টির এক অমোঘ বার্তা। বাসন্ত আসলেই এখনো ক্ষেতের আলে দাঁড়িয়ে বিরহী পুরুষ গেয়ে ওঠে ঃ


“বসন্ত বাতাসে সইরে বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে”...(ফকির আব্দুল করিম)। 


     
  

No comments:

Post a Comment