Pages

Sunday 18 October 2020

গাসি : একটি চন্ডাল খাদ্য উৎসব

গাসী ঃ একটি চন্ডাল খাদ্য উৎসব  


“ আশ্বিন মাসে রান্ধেবাড়ে কাতি মাসে খায়, যে বর চায় বুড়ি সেই বর পায়”। (প্রচলিত গাসির ছড়া)

ছড়াটি থেকে সহজে অনুমিত হয় যে “গাসি’ উৎসবটি একটি খাদ্যের উৎসব। এই উৎসবের বিশেষত্ব হল যে, খাবারগুলি আশ্বিন মাসের শেষ রাতে রান্না করা হয় এবং কার্ত্তিক মাসের সকালে তা খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। খাবারের মধ্যে থাকে পান্তা ভাত, কড়কড়া ভাত আর কলমিশাকের ঘণ্ট। বেলে শাক, লাউশাক, কুমড়ো শাক, ডাটাশাক, কাঁটা নটেশাক সব মিলিয়ে পাঁচ অথবা সাত ধরণের শাক ভাঁজা। পুঁটি মাছ, পোনা মাছ অথবা ইলিশ মাছ ভাঁজা। আলু, কুমড়ো, মিষ্টি আলু, পুঁইশাক মিলিয়ে ঘ্যাট। ভোর হবার আগেই মায়েরা রান্নার রান্নার কাজ শেষ করেন। পরের দিন অরন্ধন।
পান্তা ভাত, অথবা কড়কড়া ভাতের পাশাপাশি মেয়েরা তৈরি করে নানা ধরণের পিঠে। ‘গাসি’তে কলা পাতার মধ্যে তাল পিঠে বেশ জনপ্রিয়। তেলে ভাঁজা পিঠের মধ্যে তৈরি হয়, তালবড়া, কলাবড়া এবং চান্দোসা। ভাপা পিঠের মধ্যে সাঁচপিঠে এবং পুলি বিখ্যাত। ভাঁজা পিঠের মধ্যে পাটিসাপ্টাই প্রধান। দুধ এবং গুড়ের মধ্যে ভেজানো পিঠে এবং পায়েস তো থাকেই। এই পরবের সব থেকে উল্লেখযোগ্য খাবারটি হল “তালের আটির শাঁস”।
চন্ডালের ‘গাসি পরব’ এর সাথে “কাক ব্রতের” একটি সম্পর্ক আছে। বাড়ীর গৃহিণী এবং মেয়েরা মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে আলোকিত করেন আনাচ কানাচ। ভোর হবার আগেই চণ্ডাল গৃহিণী “গাসি পরবের’ সমস্ত খাবারের একটু একটু অংশ কলাপাতায় সাজিয়ে পুকুর ঘাট কিংবা সমাধির পাশে একটি নিকোনা জায়গায় রেখে দাঁড়কাক’কে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেন। দাঁড়কাককে খাবার দেবার আগে তিনি “বাবা কালাচান’ বলে তিনবার হাঁক পাড়েন। দাঁড়কাক খেতে আসলে দূর থেকে তাকে প্রনাম করে বাড়ী ফিরে আসেন চণ্ডাল রমণীরা। চন্ডালেরা মনে করেন যে দাঁড়কাক বা কালাচান হল তাদের সমাজের দূত। এরাই সময় কালে শুভ এবং অশুভ সংবাদের সংকেত বয়ে আনে। চণ্ডাল রূপকথায় জানা যায় যে বাংলার সওদাগরদের “মধুকরের” মাস্তুলের উপর বসে এই দাঁড়কাকই এক সময় দিশা দেখাত। আগাম বিপদের বার্তা বা নতুন দেশের খবর এনে দিত এই দাঁড়কাক। ঝড় তুফানে নোকাডুবি বা কারো মৃত্যু হলে নিমেষের মধ্যে বার্তা পৌঁছে দিত এই দাঁড়কাক। চন্ডাল বাড়িতে কোন ভোজসভা বা উৎসবের জন্য রান্না করা খাবার সর্বপ্রথম দাঁড়কাককে খাওয়ানোর নিয়ম এখনো প্রচলিত আছে।
একই ভাবে আর একটি কলাপাতায় গাসির সব খাবার সাজিয়ে রাখা হয় উঠোনের মাঝখানে। একটি বড় বাটিতে বেটে রাখা হয় হলুদ এবং নিমপাতা। পাতার উপরে রাখা হয় কাঁচা তেঁতুল পোড়া এবং একটু সর্ষের তেল। কলার ডগায় সর্ষের তেলের প্রদীপ জ্বেলে কাজল পাড়িয়ে রাখা হয়।
“গাসি পরবে” ছোট-বড় সকলের অংশগ্রহণটিও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। এই দিন ভোর রাতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদেরও ঘুম ভেঙ্গে যায়। তারা আনাচে কানাচে ঘুরে ঘুরে ঘরের বেড়াতে লাঠির আঘাত করে ছড়া কাটেঃ
এই বাড়ীর ইন্দুর বান্দর ওই বাড়ি যা
মনার’মা’র (কোন একজনের নাম) চাল ধান খুটে খুটে খা’।
অথবা
“মশা রে মশা কান খোলশা
কানে বাঁধা দড়ি
সব মশা উড়ে যা
পাচির মা’র বাড়ি”।
ছোটদের এই মশা, মাছি, ইন্দুর-বান্দরের উপর বীরত্বের পরেই তারা উঠানে চলে আসে। সারা গায়ে মেখে নেয় কাঁচাহলুদ এবং নিমপাতা বাটা। মিনিট পাঁচেক পরে পুকুর, নদী বা কোন জলাশয়ে গিয়ে ভাল করে স্নান করে নেয় তারা। বড়রাও নিমপাতা গায়ে মেখে স্নান সেরে নেয়। স্নান শেষে ভিজে শরীর নিয়েই চলে আসে উঠানে রাখা কলাপাতার কাছে। কলাপাতায় রাখা পোড়া তেঁতুল এবং একটু সর্ষের তেল ঠোঁটে এবং পায়ের গোড়ালিতে মেখে নেয়। চোখে লাগায় কাজল। চণ্ডাল সমাজের বিশ্বাস এই “গাসির স্নান” থেকেই তারা “গাসুয়া” বা অপরিচ্ছন্নতা এবং রোগজীবানুর সংক্রমণ থেকে মুক্তি পায়।
তালের আটির শাঁস দিয়ে শুরু হয় খাওয়ার পালা। তারপর পিঠে, পুলি, পায়েস এবং সব শেষে শাকভাঁজা, ঘণ্ট এবং মাছভাঁজা দিয়ে পান্তাভাত। এ বাড়ি, ও বাড়িতে খাওয়ার ধুম।
মিলনের এম মাধুর্য আজ নানা কারণে ফিকে হয়ে গেছে। দেশভাগ, বিচ্ছিন্নতা এবং দুর্গাপূজা, কালীপূজার মত ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যবাদ বাংলার শ্যামল শোভন উৎসবগুলিকে আগাছা-পরগাছার আচ্ছাদিত করে ফেলেছে। বাঙালী সম্বিৎ ফিরে পেলেই আবার এক কল্যাণকারী সমাজ গড়ে তুলতে পারবে।

( লেখাটি নৃতাত্ত্বিক কাঞ্চন মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত Food & Power Expression of Food-Politics in South Asia গ্রন্থে Food Tradition of Chandal Community/ Chapter 15/298/ 2020 এ প্রকাশিত হয়েছে।)
ছবি সূত্র ঃ
১) সমীরণ বিশ্বাস
২) স্মৃতিকণা হাওলাদার
৩) অ্যাডভোকেট উৎপল বিশ্বাস, বাংলাদেশ
৪) ২) Food & Power/ Kanchan Mukhopadhyay