“গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সমস্ত সরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সরস্বতী পূজা সহ সমস্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধ হোক”
এই আবেদন বেশ জোরাল ভাবে উঠে আসছে। আবেদনটি বহুজন সেবিত দেশের পক্ষে একটি মঙ্গল বার্তা। ভারতীয় যুক্তিবাদী সমিতির পক্ষ থেকেও সোস্যাল মিডিয়ায় অনুরূপ একটি আবেদন রাখা হয়েছে যা'তে বলা হয়েছে যে ভারত নামক রাষ্ট্রে সরকারী প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজা করা গণতন্ত্রের পক্ষে সমীচীন নয়। এতে একদিকে যেমন প্রবল সাড়া পাওয়া গেছে অন্যদিকে গেল গেল রব তুলে আক্রমণে নেমে পড়েছে নামে বেনামে কিছু ব্রাহ্মন্যবাদ প্রেমী বন্ধুরা। তারা কেউ কেউ যুক্তিবাদীদের কম্যুনিস্ট রাজনীতির বাইপ্রোডাক্ট বলছেন, কেউ বলছেন এরা ইসলামিক এজেন্ট। কেউ কেউ আবার সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে যুক্তিবাদীদের হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে সরস্বতী পূজা বন্ধ করার পিটিশন দাখিল করার হুমকি দিচ্ছেন। অর্থাৎ সব মিলিয়ে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধর্মাচরণের বাইরে রাখা হবে কি হবে না তা নিয়ে একটি দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সামাজিক ক্ষেত্রে এই দ্বন্দ্বটিও কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। আসলে দ্বন্দ্বই হল নির্মাণের আসল কারিগর।
আমারা জানি যে, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপায়ী’র সময়ে এই “সরস্বতী মন্ত্রকে” সরকারী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলক করার প্রয়াস শুরু হয়েছিল। মুরলী মনোহর যোশী’র নেতৃত্বে জ্যোতিষ চর্চাকেও ঢোকানোর চেষ্টা হয়েছিল বিজ্ঞান বিষয়ক পাঠ্য সূচীতে। আর অবশ্যম্ভাবী ভাবে রাষ্ট্র জুড়ে উঠেছিল বিতর্কের, নিন্দার ঝড়। আন্তর্জাতিক ভাবে ভারত সরকারের এই প্রয়াস হাস্যকর পর্যায়ে পরিগণিত হয়েছিল। বর্তমান বিজেপি সরকার এমন কোন অধ্যাদেশ না করলেও নানা ভাবে সেই পুরানো আফিং পরিবেশনের চেষ্টা হচ্ছে। মাননীয় প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর মোদি পর্যন্ত সার বেঁধে স্কুলের ছাত্র ছাত্রীদের সূর্য প্রনাম ও সরস্বতী মন্ত্র শেখানর তালিম দিয়ে চলেছেন। আর সে কারনেই বিতর্ক দানা বেঁধে উঠছে। প্রশ্ন উঠছে সরকারের অভিসন্ধি নিয়ে। প্রশ্ন উঠছে সরকারের পলিসি ও আদর্শ নিয়ে।
সরস্বতীকে নিয়ে এত টানাটানি কেন?
আমাদের প্রশ্ন কেন বিজেপি সরকার যখন যখন ক্ষমতায় আসে তখন দেবী সরস্বতীকে নিয়ে এত টানাটানি শুরু হয়? কেন হরিয়ানা, পাঞ্জাব বা রাজস্থানের কোথাও খোঁড়াখুঁড়ি করে জল বেরিয়ে এলে সরস্বতী নদীর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে বলে প্রচারের ঢাক পিটোতে শুরু করে? কেন তারা নাসার বিজ্ঞানীদের দিয়ে আবছা ছবি (যার অধিকাংশ ফটোশপে বানানো) তুলে “সরস্বতী নদীর” অস্তিত্ব প্রমান করতে চায়? এর মূলে আছে রহস্যময় ব্রাহ্মন্যবাদ। মিথ এবং ফিউশন। যা বর্তমান বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদের অভিঘাতে অস্তিত্বের সংকটেন পড়েছে।
এপর্যন্ত আবিষ্কৃত সভ্যতাগুলি থেকে যে নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে ব্রাহ্মন্যবাদী মিথ, ফিউশন এবং পৌরাণিক কাহিনীর কোন সমর্থন পাওয়া যায়নি, বরং এই কাহিনিগুলির বাস্তবাতা এমন হাস্য রসের খোরাক জোগাচ্ছে যে ব্রাহ্মন্যবাদ বিলুপ্ত হয়ে যাবার ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছে।
রাজনীতি তাই ব্রাহ্মন্যবাদের শেষ আয়ুধ। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে শাসন দণ্ডের মাধ্যমে মিথ এবং ফিউশনগুলি টিকিয়ে রাখা। ধর্মীয় পাচনে জারিত করে মিথগুলিকে পারম্পরিক করে তোলা। ভুত-প্রেত, আত্মা-পরমাত্মা, দেব-দেবী, অলৌকিক শক্তির উপর বিশ্বাস জাগিয়ে তোলা। প্রচারের ঢাক পিটিয়ে ধর্মীয় বিশ্বাসগুলিকে গণ-হিস্টেরিয়ার স্তরে নিয়ে যাওয়া এবং মানুষে মানুষে বিভেদের বিষ ছড়িয়ে যাতে ব্রাহ্মন্যবাদ কায়েম রাখা। কেননা, সাম-দাম–দণ্ড–ভেদ এবং মিথের উপরই ব্রাহ্মন্যবাদ প্রতিষ্ঠিত। বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদ প্রসারিত হলে ব্রাহ্মন্যবাদ ধ্বংস হয়ে যায়।
কে এই সরস্বতী ?
বেদের কিছু শ্লোকে সরস্বতী নদীর উল্লেখ আছে। দেবী হিসেবেও বর্ণিত হয়েছেন সরস্বতী।
अम्बितमे नदीतमे
देवितमे सरस्वति
|
– Rigveda 2.41.16
– Rigveda 2.41.16
Best Mother, best of Rivers, best of Goddesses,
Sarasvatī, We are, as ’twere, of no repute and dear Mother, give thou us
renown.
अपो अस्मान मातरः शुन्धयन्तु घर्तेन नो घर्तप्वः पुनन्तु |विश्वं हि रिप्रं परवहन्ति देविरुदिदाभ्यः शुचिरापूत एमि ||
– Rigveda 10.17
May the waters, the mothers, cleanse us,
may they who purify with butter, purify us with butter,
for these goddesses bear away defilement,
I come up out of them pure and cleansed.
–Translated by John Muir
আভিধানিক পরিভাষাঃ
সরস্বতীকে কখনো কখনো সারসবতী” হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ তিনি সার(গুন)+ স্বতি (নিজের) বা
নিজের গুনে গুণান্বিত। সংস্কৃত পরিভাষায় সরস্বতী শব্দকে সরস+বতী বা জলপূর্ণ নদী
হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কোথাও সরস্বতীকে “ব্রাহ্মী” বা ব্রহ্মার কন্যা আবার কোথাও তাঁকে “ব্রাহ্মণী” বা ব্রাহ্মার
স্ত্রী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কোথাও “নারায়ণী” বা নারায়ণ ওরফে
বিষ্ণুর স্ত্রী আবার কোথাও তিনি “ভগবতী” “ভারতী” হিসেবে বর্ণীত হয়েছেন।
কোথাও তিনি উন্মুক্ত বক্ষ (কুঁচযুগ শোভিতা) আবার কোথাও তিনি “শ্বেতবসনা”। তিনি হংসাসনা,
পুস্তকহস্তে এবং বীনাবাদনী।
তার ধ্যানমন্ত্রঃ
“ওঁ তরুণ শকল মিন্দোর্ব্বিভ্রতি শুভ্র কান্তি,
কুচভরণমিতাঙ্গি সন্নিষন্না সিতাব্জে,
নিজকর কমলোদ্যল্লেখনী পুস্তকশ্রীঃ
সকল বিভবসিদ্ধৈ পাতু বগ্দেবতা
নমঃ”।
নমস্কারমন্ত্রঃ
জয় জয় দেবীচরাচরসারে, কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে।
বীণাপুস্তকরঞ্জিত হস্তে , ভগবতী ভারতী দেবী নমস্তে॥
ওঁ সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যেকমললোচনে,
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যাং দেহী নমোহস্তুতে॥
সরস্বতীর জন্ম
কাহিনীঃ
মিশর, গ্রীক, রোমান, অশিরিয়ান
পৌরাণিক কাহিনীর চরিত্রগুলির মতোই ব্রাহ্মন্য সাহিত্যের চরিত্রগুলিও হেয়ালী এবং
স্ববিরোধিতায় পরিপূর্ণ। বিশেষত এই চরিত্রগুলির জন্ম কাহিনী এমন “অসম
যৌনাচারে” ভরা যে তা বর্তমান নীল
ছবিকেও হার মানাতে পারে। বিশেষত ব্রাহ্মন্যবাদী দেব দেবীর জন্ম কাহিনীগুলি এমন কুরুচিপূর্ণ, অশ্লীল এবং অনৈতিকতায় পরিপূর্ণ ধ্বংস করে দিতে পারে মানবিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা
বোধ। সরস্বতীর জন্ম কাহিনী এবং জীবন কাহিনীও এই অবৈধ এবং অসম যৌনাচারের সমন্বয়ে
গড়া। কয়েকটি বিশেষ পুরাণে সরস্বতীর জন্ম কাহিনী পাওয়া যায়। এদের মধ্যে বিশেষ ভাবে Aitreay Brahman III : 33 // Satapatha Brahman 1 : 4 : 7 : 1ff // Matsya Puran III : 32ff // Bhagabati Puran III : 12 : 28ff উল্লেখযোগ্য। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণেও শ্রী কৃষ্ণের (বিষ্ণু) জিহ্বা থেকে সরস্বতীর জন্ম দেখানো হয়েছে।
সরস্বতী পুরাণ মতেঃ
স্বমেহন বা হস্তমৈথুন করতেন ব্রহ্মা। হস্তমৈথুনের পর
নির্গত বীর্য তিনি একটি পাত্রে জমা করতেন। একদিন
ঊর্বশীকে দেখে কামাতুর হয়ে
পড়েন। অভ্যাস
বশত হস্তমৈথুন করে সেই পাত্রে রাখেন এবং
সেখানেই সরস্বতীর জন্ম হয়। তাই সরস্বতীর কোন মা নেই।
আর একটি সূত্র থেকে পাওয়া যায়, ব্রহ্মার বীর্যে মাটির পাত্রে জন্ম হয় ঋষি অগস্ত্য এবং পরে অগস্ত্য
জন্ম দেন সরস্বতীর। এই সূত্র অনুযায়ী সরস্বতী একদিকে ব্রহ্মার নাতনি।
পিতা ব্রহ্মা ও কন্যার অবৈধ যৌনতাঃ
নিজের কন্যার রূপ দেখে ব্রহ্মা যৌন লালসায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। তাঁকে
বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করতে ছুটে আসে। সরস্বতী পিতার কামাতুর দৃষ্টি থেকে পরিত্রান
পাবার জন্য চতুর্দিকে ছুটে বেড়ান কিন্তু পিতা তাঁকে চতুর্মুখ দিয়ে আকর্ষণ করতে থাকে।
শেষ পর্যন্ত হার মানে সরস্বতী। পিতার বাহুবন্ধনে ধরা দেন। তারা একটি গুহায় প্রবেশ
করে। ১০০ বছর ধরে পিতা ব্রহ্মা কন্যা সরস্বতীকে ধর্ষণ করে এবং সেই অবৈধ সঙ্গমের
ফলে স্বয়ম্ভূমারু’র (মনু) জন্ম হয়।
অন্য আর একটি সূত্র থেকে পাওয়া যায় যে ব্রহ্মা ও সরস্বতীর অবৈধ যৌন মিলনের
ফলে একটি সন্তান মনু এবং একটি কন্যা শতরূপার জন্ম হয়।
নিজের পুত্র মনু’র সাথে সরস্বতীর যৌনতাঃ
মৎস পুরাণে উল্লেখ আছে যে পিতা ব্রহ্মার যৌনাচারে ক্ষিপ্ত হয়ে সরস্বতী
তাঁকে পরিত্যাগ করেন এবং পুত্র মনুকে নিয়ে পালিয়ে যায়। যাবার আগে তিনি ব্রহ্মাকে অভিসম্পাত
করেন যে পৃথিবীতে কোথাও তিনি পূজিত হবেন না। বেশ কিছু পুরাণ বর্ণনা করেছে যে এই
সরস্বতী তার নিজের ছেলে মনুকে বিয়ে করেন এবং তাদের প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ নামে দুই পুত্র ও আকুতি, দেবাহুতি
ও প্রসুতি নামে তিন কন্যার জন্ম হয়।
ব্রহ্মবৈবর্ত
পুরাণে সরস্বতীকে চঞ্চল, কলহপ্রিয়া এবং কামার্ত নারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
এখানে বলা হয়েছে যে, এই দেবী জন্মের পরের থেকেই জন্মদাতা(বিষ্ণু)র প্রতি অতিশয় কামার্ত
হয়ে পড়েন। বিষ্ণুর শয্যায় লক্ষ্মীকে দেখে ঝগড়া শুরু করেন। দুই সতীনের ঝগড়া এমন
পর্যায়ে পৌঁছায় যে বিষ্ণু এদের অভিশাপ দিয়ে স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে দেয়। বিষ্ণুর
অভিশাপে সরস্বতী নদী হয়ে যায় এবং লক্ষ্মী নদীর পাড়ে গাছ হয়ে যায়। বিষ্ণু শিবকে এ
কথাও জানায় যে এই দুই নারীর কারণে পৃথিবীও যৌনতা ও কলহপূর্ণ হবে। ওখানকার শান্তি
বিনষ্ট হবে।
মহান গীতাতেও “নারী, বৈশ্য এবং শূদ্রগণ পাপ যোনিতে জন্ম” বলে সমস্ত অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করে রেখেছে। (গীতা, ৯/৩২) এমনকি তুলসীদাস রামচরিত মানস রচনা কালেও পূর্বজ গণের পথ অনুসরণ করে নারীকে পশুর সমান উল্লেখ করেছিলেন।
সরস্বতী মিথ কতটা
যুক্তিযুক্ত ?
প্রখ্যাত অধ্যাপিকা সুকুমারী
ভট্টাচার্য মনে করেন যে, বেদ রচনার কাল ছিল খ্রিষ্ট পূর্ব চতুর্থ শতক থেকে
খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতক পর্যন্ত। একালের প্রায় প্রত্যেক ঐতিহাসিকও এই মত সমর্থন
করেন। বিশেষত পুরাণ কাহিনীগুলি যে গুপ্ত যুগের কাহিনী তা সকলে মেনে নিয়েছেন। গুপ্ত
যুগের আগে মৌলিক দুটি গ্রন্থ আমরা দেখতে পাই যেখানে নারীকে সমস্ত অধিকার থেকে
বঞ্চিত করা হয়েছিল। এই দুটি গ্রন্থ হল চাণক্যের অর্থশাস্ত্র (খ্রীস্ট পূর্ব
দ্বিতীয়শতক) এবং ভৃগুর মনুস্মৃতি (খ্রীস্ট
পূর্ব ১৮৫ সাল)। এদের মধ্যে মনুস্মৃতি স্পষ্ট করে নির্দেশ করেছিল যে,
147.
By a girl, by a young woman, or even by an aged one, nothing must be done
independently, even in her own house. “একজন বালিকা বা যুবতী বা বৃদ্ধা গৃহে স্বাধীন ভাবে কিছু করবেনা”।। (মনু স্মৃতি, ৫ অধ্যায়)
148. In childhood a female must be subject to her
father, in youth to her husband, when her lord is dead to her sons; a woman
must never be independent.
স্ত্রীলোক বাল্যে পিতার বশ্য থাকবে, যৌবনে স্বামীর অধীনে, স্বামী প্রেতলোক প্রাপ্ত হলে পুত্রের অধীনে থাকবে। কোন পরিস্থিতিতে নারী স্বাধীন থাকবে না’। (মনু স্মৃতি, ৫ অধ্যায়)
স্ত্রীলোক বাল্যে পিতার বশ্য থাকবে, যৌবনে স্বামীর অধীনে, স্বামী প্রেতলোক প্রাপ্ত হলে পুত্রের অধীনে থাকবে। কোন পরিস্থিতিতে নারী স্বাধীন থাকবে না’। (মনু স্মৃতি, ৫ অধ্যায়)
150. She must always be cheerful, clever in (the
management of her) household affairs, careful in cleaning her utensils, and
economical in expenditure. সে সকল সময় ঘরকন্নার
কাজে, থালা বাসন পরিষ্কার করা এবং আর্থিক অপচয়ের ক্ষেত্রে যত্নবান হবে (মনু স্মৃতি, ৫ অধ্যায়)
মহান গীতাতেও “নারী, বৈশ্য এবং শূদ্রগণ পাপ যোনিতে জন্ম” বলে সমস্ত অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করে রেখেছে। (গীতা, ৯/৩২) এমনকি তুলসীদাস রামচরিত মানস রচনা কালেও পূর্বজ গণের পথ অনুসরণ করে নারীকে পশুর সমান উল্লেখ করেছিলেন।
“ঢোল গাওয়ার পশু শূদ্র নারী
ইয়ে সারে তদন কী অধিকারী”।
ইয়ে সারে তদন কী অধিকারী”।
অর্থাৎ
ভারতীয় নারীরা খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে মুঘল আমল পর্যন্ত সমস্ত অধিকার থেকে
বঞ্চিত ছিল। সরস্বতী নামে কোন আর্য নারীর পক্ষেও বিদ্যার্জন ছিল একেবারেই নিষিদ্ধ।
নিদেন পক্ষে তিনি ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে, এঁটো বাসন মেজে অবসর সময়ে তানপুরা বাজিয়ে
স্বামীর মন জয় করে শয্যা সঙ্গিনী হয়ে যৌনতা উপভোগ করতে পারতেন। গণ্ডা গণ্ডা সন্তান
ধারণ করতে পারতেন। বিদ্যালয়ে গিয়ে, বিদ্যা অর্জন করে মহীয়সী হওয়া তার পক্ষে কোন
ভাবেই সম্ভব ছিলনা।
তবে কে এই মহীয়সী
?
প্রশ্নটি
স্বাভাবিক এবং অনিবার্য। কবে থেকে ভারতীয় নারীরা শিক্ষার অধিকার অর্জন করল? কে সেই
মহীয়সী যিনি প্রবল ব্রাহ্মন্যবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ভারতীয় নারীদের মানবিক
মর্যাদা দিলেন? কে সেই নির্ভীক নারী যিনি নারীকে ভোগের সামগ্রী থেকে আলোকময়ী করে
তোলার জন্য শ্লোগান তুললেন, “হাম ভারত কি নারী হ্যায়, ফুল নাহি চিঙ্গারী হ্যা”?
তিনি মা সাবিত্রী
ফুলে। মহামানব জ্যোতি রাও ফুলের সহধর্মিণী। সমগ্র এশিয়ার প্রথম শিক্ষিকা। আধুনিক
কবিতার জননী। ১৮৪৭ সালে তিনি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মা সগুনা ছিলেন তার অন্যতমা
সহযোগী। ১৮৪৮ সালে পুনের বিদেওয়াড়ায় বালিকা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসবে
দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৫২ সালের ১৬ই নভেম্বর শিক্ষা ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখার
জন্য ফুলে দম্পতিকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করা হয়। মা সবিত্রী ফুলেকে সর্বশ্রেষ্ঠ
শিক্ষিকা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৮৮০ সালে জ্যোতি রাও ফুলে হান্টার কমিশনের
বিশেষ পরামর্শদাতা হিসবে নিয়োজিত হলে মা সাবিত্রী ফুলে ভারতের সমস্ত মানুষের জন্য
শিক্ষার দ্বার খুলে দেবার পরামর্শ দেন। হান্টার কমিশন এই প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং
পরবর্তী কালে তা ভারত শাসন আইনে গৃহীত হয়। মা সাবিত্রী ফুলের ইংরেজি কবিতা
সংগ্রহের একটি কবিতা এখানে সংযোজিত করা সমীচীন মনে করি।
Go, Get Education
Be self-reliant, be industrious
Work, gather wisdom and riches,
All gets lost without knowledge
We become animal without wisdom,
Sit idle no more, go, get education
End misery of the oppressed and
forsaken,
You’ve got a golden chance to learn
So learn and break the chains of
caste.
Throw away the Brahman’s scriptures
fast.
— Poem by Savitribai Phule (More
poems at Poems by Savitribai Phule)
১৮৯৭
সালের ১০ই মার্চ প্লেগ রোগীদের মধ্যে কাজ করতে করতে তিনি মারা যান। তাই ভারতবর্ষের
সার্বজনীন শিক্ষার জন্য যদি কোন মহামানব বা মহামানবীকে পূজা করতে হয় তবে অবশ্যই এই
পূজা গ্রহণের যোগ্য অধিকারী ফুলে দম্পতী। বিশেষ করে মা সাবিত্রী ফুলে।
পরিশেষঃ
এতক্ষনে সরস্বতী
সম্পর্কে আমরা নানা তথ্য পাওয়ার পর নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছি যে ব্রাহ্মনেরা কোন
মহিমায় ভূষিত করে এই বিদ্যার দেবী বা বিদ্যেধরীকে সৃষ্টি করেছেন। এটাও পরিষ্কার হয়ে
গেছে যে, এই বিদ্যেধরীর পূজা বা প্রচারের সাথে ব্রাহ্মন্যবাদের আসল দর্শন লুকিয়ে আছে যে ব্রাহ্মন্য
দর্শন সম্পূর্ণ ভাবে কল্পকাহিনী ও হেয়ালীর উপর প্রতিষ্ঠিত। মেহেরগড়, হরপ্পা,
মহেঞ্জোদড়ো, ধলাভিরা, কালিবঙ্গান, লোথাল, গঙ্গারিডি, পাণ্ডুরাজার ঢিবি বা নাগা
সভ্যতা নিয়ে বিজ্ঞান ভিত্তিক গবেষণা যত এগোচ্ছে ততই শঙ্কিত হয়ে উঠছে ব্রাহ্মন্যবাদ।
অগত্যা বেদের কাল্পনিক কাহিনীর উপর ভিত্তি করে টিকে থাকার এই শেষ প্রচেস্টা। স্কুল
কলেজ বা সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলিতে সরস্বতী পুজা বন্ধ হয়ে গেলে মরণাপন্ন
ব্রাহ্মন্যবাদ তো আর্ত চিৎকার করবেই।
সাবিত্রী ফুলের জন্মদিনকে আমাদেরকে চেতনার উৎসব হিসাবে পালন করা শুরু করতে হবে । আপনার এই তথ্যে বহুল লেখাটি অনেকভাবে আমার কাজে আসবে । সাবিত্রী ফুলের কবিতা দারুণ ভাবে অনুপ্রেরণা দিল । আর একটি অভিমত, শুধু একটি নির্দিষ্ট পূজার সময় সেই পূজার বিরোধিতা করা আমাদের যে রেওয়াজটা হয়েছে তাকে আমার মতে ভালোয় মনে হয়, তবে আরো ভালো হত এখন যদি দূর্গা পূজা, বা অন্যান্য পূজার অসারতা তুলে ধরা যেতো । আমি বলতে চাইছি বিদ্রোহ করলে আমাদের কে সব সময় সব ব্যাপারে করতে হবে ।তাহলে চেতনা বিস্তার ফলপ্রসূ হবে খু তাড়াতাড়ি ।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল। ধন্যবাদ দাদা
ReplyDeleteভন্ডদের গালে সপাটে চড়!!!!!!! খুবই দরকার।
ReplyDeleteআমি এই লেখা টি গত সরস্বতী পূজায় পড়েছি
ReplyDeleteমা সরস্বতী বলে কেউ কোপায় না , গুলি চালায় না, উগ্রবাদী সংগঠন বানায় না এই যা স্বস্তি । ওই সমস্ত বিষয় নিয়ে
ReplyDeleteলেখার মত সৎ সাহস আছে কি?
অামার ধর্ম সনাতন ঔঁ, নামে একটি Website অাছে সব উওর পেয়ে যাবেন।
ReplyDeleteঅসাধারণ তথ্যবহুল লেখা।।
ReplyDeleteলেখাটিকে ছড়িয়ে দিন বহুজন। এই তথ্যগুলি দীর্ঘদিন জমে থাকা মনের জঞ্জাল অনেক সাফ করে দেবে।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ স্যার। এরকম তথ্য দেওয়া জন্য।
ReplyDeleteকু সংস্কার থেকে মুক্তি চাই
ReplyDelete