Pages

Wednesday, 10 February 2016

শহীদ তিলকা মাঝি : শরদিন্দু উদ্দীপন





দেলায়া বিরিদ পে দেলায়া তিঙ্গুন পে”
“শালা দ্যাশ আমার, মাটি আমার
তঁরা আমার মা কে কাড়েছিস
আমরা তদের জিউ লিয়ে ছাড়ব” ...
আমরা সিধু আমরা কানু, যেখানে মাটি লালে লাল, দেবব্রত সিংহ, পৃঃ ১৬

বাবা তিলকা মাঝিকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অনিবার্য ভাবে এসে গেল তার যোগ্যতম উত্তরসূরি সন্তান সম সিধু-কানুর কথা। কেননা সিধু-কানু’র “হুলমাহা” এবং বাবা তিলকা’র “শালগিরা” ছিল একই সুরে বাঁধা মূলনিবাসী ভূমিপুত্রদের হৃতসম্মান পুরুদ্ধারের লড়াই। বিদেশী বনিক এবং দিকু মহাজনদের বিরুদ্ধে নিজেদের সংস্কৃতি  রক্ষার অদম্য লড়াই।

পলাশী যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের পর রবার্ট ক্লাইভ ১৭৬৫ সালে মুঘল সম্রাট সাহ আলমের কাছ থেকে বাংলা- বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানি লাভ করেন।  (see also AHOI, Ch.5, section: Robert Clive and the Diwani of Bengal ) কোম্পানি আবার রাজস্ব আদায় করার জন্য ছোটবড় জমিদারদের উপর দায়িত্ব তুলে দেয়। এই নব্য জমিদারেরা কোম্পানির সৈন্যবল কাজে লাগিয়ে অত্যাচারী হয়ে ওঠে, তাতে মূলনিবাসি আদিবাসী সমুদায়ের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয় এবং এই অসন্তোষ শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহতে পরিণত হয়। শুরু হয় স্বাধিকার অর্জনের লড়াই। ১৭৭১ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত এই লড়াইতে যে বিদ্রোহী নওজোয়ান রবিনহুডের মত নিজেদের স্বাধিকার রক্ষা করার জন্য প্রবল পরাক্রান্ত ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও জমিদারদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিলেন তিনি লোকপ্রিয় আদি বিদ্রোহী জাওরা/জৌরা/সৌরা পাহাড়িয়া। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধের প্রথম সেনাপতি। হাসতে হাসতে ফাঁসিকাষ্ঠে বলিদানের প্রথম শহীদ, লোকপ্রিয় তিলকা  মাঝি।

কথিত আছে যে, বাবা তিলকা মাঝি ১৭৭৮ সালে পাহাড়িয়া সর্দারদের নিয়ে কোম্পানী, সামন্ত জমিদার এবং মহাজনদের  বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন।  এই যুদ্ধে বাবা তিলকার সাথে যুক্ত হন সর্দার রমনা আহাড়ি, পাকুড় আমড়া পাড়া অঞ্চলের কারিয়া পুজহর, সিঙ্গারসি পাহাড় নিবাসী সর্দারেরা। ১৭৭৮ সালে তিলকা মাঝি ১৩০০ ধনুর্বিদ গেরিলা যোদ্ধা নিয়ে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রামগড় ক্যাম্প  কবজা করে নেয়। ক্লাইভ লয়েডকে হত্যা করে এবং কোম্পানির ট্রেজারি লুঠ করে জনগণের মধ্যে বন্টন করে দেয়।

হাঁসি হাঁসি চড়ব ফাঁসিঃ  
১৭৮৪ সালে আয়ারকুটের নেতৃত্বে বিশাল সেনাবাহিনী গিয়ে তিলকার গেরিলা সেনাদের পরাজিত করে এবং তিলকা মাঝিকে গ্রেপ্তার করে। ইংরেজ সেনারা বাবা তিলকা  মাঝিকে ঘোড়ার সঙ্গে বেঁধে টানতে টানতে ভাগলপুর শিবিরে নিয়ে আসে। এই নির্মম ভাবে তাঁকে নিয়ে আসা সত্ত্বেও পাহাড়িয়া যোদ্ধাকে জীবিত থাকতে দেখে ইংরেজরা বিস্মিত হয়। রক্তে ভেসে যাওয়া শরীর তখন বন্ধন মুক্ত হবার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছিল। লাল চোখ থেকে বেরিয়ে আসছিল তীব্র জ্যোতি। ভয়ে কম্পিত ইংরেজেরা তড়িঘড়ি ভাগলপুর চৌরাস্তার পাশে অবস্থিত একটি বিশাল বটগাছের ডালে তিলকা মাঝিকে ফাঁসি দিয়ে দেয়। ফাঁসির আগে তিলকার গলা থেকে গুঞ্জরিত হয় একটি পাহাড়িয়া সুর, “হাঁসি হাঁসি চড়ব ফাঁসি’ যাতে বীর জোয়ানরা দেশ রক্ষার যুদ্ধে ফাঁসিকেও ভয় না পায়। এইগান পরবর্তী স্বাধীনতা যোদ্ধাদেরও অনুপ্রাণিত করে। দেশের আবালবৃদ্ধবণিতাদের মধ্যেও দেশপ্রেমের বার্তা বয়ে নিয়ে যায়।                 
বাবা তিলকা মাঝির “শালগিরা” সম্পর্কে তেমন কোন ঐতিহাসিক দলিল দস্তাবেজ না থাকলেও ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত হান্টার কমিশনের রিপোর্টে এই লড়াইয়ের প্রেক্ষাপটটি পাওয়া যায়।  হান্টার সাহবে লিখেছেন যে, সাঁওতাল, মুন্ডা, জাওরা পাহাড়িয়া সহ অসংখ্য আদিবাসী সমূদয় বীরভূম, সিংভূম, ধলভূম সহ বিস্তীর্ণ এলাকার আদি নিবাসী ছিল। ১৭৭০-১৭৯০ সালের মন্বন্তরের সময় এই আদিবাসী সমুদায় রাজমহল পাহাড়ের দিকে আসতে শুরু করে। এই আদিবাসী সমুদায়ের মধ্যে সাঁওতালরা ছিল সব থেকে শক্তিশালী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ। ইংরেজরা পাহাড়িয়াদের দমন করার জন্য রাজমহল পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে সাঁওতালদের বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। এ যেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার নীতি। ভাইয়ে ভাইয়ে লড়িয়ে দেবার পলিসি। হান্টার উল্লেখ করেছেন যে ১৭৭০ থেকে শুরু করে ১৮৪৭ সালের “দামিনী কোহ” পর্যন্ত এই মাইগ্রেশন চলে এবং প্রায় ১৫০টি সাঁওতাল গ্রামের পত্তন হয়।  এই ভাবে পাহাড়িয়াদের আধিপত্য নষ্ট করে দেবার পর এই অঞ্চলের নাম হয় সাঁওতাল পরগণা।
১৭৭৯ সালের নভেম্বর মাসে ভাগলপুরের জেলা কালেক্টর অগাস্টাস ক্লেভল্যান্ড (Augustus Cleveland) ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে পাহাড়িয়া আদিবাসীদের সংস্কৃতি এবং স্বাধিকার রক্ষার জন্য একটি প্রস্তাব পাঠান। তিনি ওনুরোধ করেন যেন হেস্টিংস এই পাহাড়িয়া জাতির উন্নয়নের জন্য কিছু অর্থ বরাদ্দ করেন। এই চিঠিতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আধিপত্য এই অঞ্চলের মানুষের সামাজিক স্থিতি ক্ষুন্ন করেছিল এবং ভেতর থেকে অসন্তোষ তৈরি হচ্ছিল।  

উল্লেখ থাকে যে সাঁওতাল আদিবাসীদের এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আসার আগে এটি ছিল পাহাড়িয়া রাজাদের শাসনে (দুমকা জেলার বড়তল্লীতে এখনো এই রাজাদের বংশধরেরা রয়েছেন)। এই পাহাড়িয়া আদিবাসীদের জাউরা/ ঝাওউরা/ সৌরা পাহাড়িয়া বলা হয়। এই জাউরা পাহাড়িয়ারা বীরের জাতি। বীর হড়।
তিলকার পরিচয় নিয়ে ধাঁধাঁঃ
নানা সূত্র থেকে পাওয়া যাচ্ছে যে ১৭৫০ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারীতে সিঙ্গারসি পাহাড়ের সুলতানপুর থানার তিলকা গ্রামে বাবা তিলকা মাঝির জন্ম হয়।     
বাবা তিলকা মাঝিকে নিয়ে বেশ কিছু সাহিত্য রচনা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রসিদ্ধ লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর “শালগিরার ডাকে” উপন্যাসটি উল্লেখযোগ্য। এই উপন্যাসে মহাশ্বেতা দেবী তিলকা মাঝিকে মুর্মু গোত্রের সাঁওতাল বলে উল্লেখ করেছেন।
হিন্দি উপন্যাসিক রাকেশ সিংহ তার উপন্যাস “হুল পাহাড়িয়া” তে তিলকা মাঝিকে জাওরা পাহাড়িয়া জাতি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
এস এম কলেজের রিডার রামন সিনহা “তিলকা মাঝি ভাগলপুর ইউনিভার্সিটি”র আওতাধীন একটি গবেষণা পত্রে দাবী করেছেন যে, জাওরা পাহাড়িয়া ইংরেজদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ আরম্ভ করার আগে তিলকা মাঝি নাম গ্রহণ করেন। তিনি বলেন যে, তিলকা মানে হল রক্ত চক্ষু মানুষ এবং মাঝি অর্থ হল গ্রাম বা গোষ্ঠীর প্রধান।
তিলকা মাঝির আত্তপরিচয় যাই হোক না কেন তিনি যে ব্রিটিশ উপনিবেশের বিরুদ্ধে আদি বীর যোদ্ধা এ বিষয় কারো দ্বিমত নেই। হাসতে হাসতে তার আত্তবলিদান পরবর্তীকালে সাঁওতাল বিদ্রোহ “হূলমাহা” এবং বীরসা মুন্ডার উলগুলানের আগুন উস্কে দিয়েছিল। এই আগুনের হলকা এত প্রখর ছিল যে, ১৮৯৪ সালে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাবা তিলকা মাঝির নামে একটি তাম্র মুদ্রা প্রচলন করে পাহাড়িয়া আদিবাসীদের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।    

আজ ১১ই ফেব্রুয়ারি বাবা তিলকা মাঝির ২৬৭তম জন্মদিন। সকল মূলনিবাসীর পক্ষ থেকে তাঁকে বিনম্র স্রদ্ধা জানাই।        
তথ্য সূত্র ঃ
·        যেখানে মাটি লালে লাল, দেবব্রত সিংহ
·        শালগিরার ডাকে, মহাশ্বেতা দেবী
·        Peoples of India, S.K. Singh
·         The Annals of Rural Bengal, Volume 1, 1868 By Sir William Wilson Hunter (page no 219 to 227)
·         Tilka Manjhi (Hindi) by Rajendra Prasad Singh : ISBN13: 9788190241938ISBN10: 8190241931, Publisher: Nayi Kitab, Publishing Date:2011
·         Bengal District Gazetteer 1910, Santhal Pargana Vol13, S.S Mouli

No comments:

Post a Comment