Pages

Wednesday 29 June 2016

হুল শেঙ্গেল

 হুল শেঙ্গেল




পাহাড় কেন ডাকে?

জ্যৈষ্ঠের কাঠ ফাটা রোদের পর আষাঢ়ের এক পশলা বৃষ্টি পেয়েই পাহাড়টা ডাকে! গম্ভীর এই ডাক!  ঝিম মারা গাছগুলি চমকে ওঠে।  একটা দমকা হাওয়ার মত খবরটা ছড়িয়ে যায় কুলি কুলি ডুংরিতে ডুংরিতে!

শালগিরা……শালগিরা।

সিধু মাঝি, কানু মাঝি শালগিরা পাঠিয়েছে।

পাতা সমেত ছোট শালের এই ডাল পৌঁছে গেছে ঘরে ঘরে।

তাই বুঝি পাহাড়টা আজ ডাকছে।

নিদারুন যন্ত্রণায়, আহত অভিমান নিয়ে আত্তসম্মান ফিরে পাবার জন্য অনবরত ডেকে চলেছে পাহাড়টা।
এই ডাক অবসম্ভাবী এক ঝড়ের বার্তা বহন করে টাইড়, বাইদ, বোহাল, কানালী পেরিয়ে ডুংরিতে ডুংরিতে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে।

পাহাড় ডাকছে......
আর বাঁশী
ফুঁকা মানুষগুলি, জোষ্ঠা রাতের তুংদা, টমাক বাজানো মানুষগুলি, ছেঁড়া টেনা পরা মানুষগুলি পাথর ভাঙ্গা গতর নিয়ে শার্দূলের মতো ক্ষিপ্রতায় কাঁড়বাঁশ, টাঙ্গি, তরোয়াল, বল্লম নিয়ে হাজির হচ্ছে ভগনা ডিহি গ্রামে। তাঁরা ধরে রাখতে চায় তাঁদের মাটি। তাঁরা ফিরে পেতে চায় জল-জঙ্গলের অবাধ অধিকার। তাঁরা প্রাণ দিয়ে আগলে রাখতে চায় তাঁদের লাই লাকচার, আড়িচালি।

ভগনা ডিহির সভায় পাহাড় ডাকা ক্ষোভ নিয়ে সিধু, কানু, চাঁদ, বৈরভ গর্জে উঠে বলেন, সুদখোর মহাজন এবং গোরা পল্টন আমাদের সব কিছু কেড়ে নিতে চায়। সাঁওতালদের সুখসাচ্ছন্দ দেখতে চায় না দিকু জমিদার। তাঁরা জোর করে আদিবাসীদের কাছে থেকে খাজনা আদায় করতে চাইছে। অন্যায় ভাবে আমাদের চুরির দায়ে অপরাধী করছে। প্রকাশ্যে অপমান করছে এবং জোর জবরদস্তি গরু, ছাগল, ভেড়া, মোষ কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। জমিদারের সঙ্গে জুটেছে পুলিশ, পাইক, পেয়াদা, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট। এরা সবাই মিলে আদিবাসীদের শেষ করে দিতে চায়। এটা চরম অন্যায়। আমরা স্ত্রী-পুত্রের জন্য, জমি-জায়গা বাস্তু-ভিটার জন্য, গো-মহিষ লাঙ্গল ধন-সম্পত্তির জন্য “হুল সেঙ্গেল” করতে চাই। আমরা আমাদের মান সম্মান এবং হৃতগৌরব ফিরে পেতে চাই।

Tuesday 28 June 2016

ব্রাহ্মণবাদীদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য আম্বেদকরঃ




গত ২৬শে জুন রাতের অন্ধকারে বুলডোজার লাগিয়ে সম্পূর্ণ চুরমার করে দেওয়া হয়েছে বাবা সাহেব আম্বেদকরের স্মৃতি বিজড়িত দাদারের বাড়িটি। যে বাড়ির প্রেস থেকে প্রকাশিত হত “মূকনায়ক” এবং “বহিষ্কৃত ভারত” নামে ঐতিহাসিক দুটি পত্রিকা। যে বাড়ি থেকে বাবা সাহেবে তাঁর সমস্ত আন্দোলন পরিচালনা করতেন। যে বাড়িতে গড়ে উঠেছিল দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সমন্বয়ে একটি বিরল লাইব্রেরী, সাংঠনিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে সেই বাড়িটিকেই চুরমার করে দিল মহারাষ্ট্রের বিজেপি শাসিত সরকার এবং তাদের বশংবদেরা।



 এই বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বাবা সাহেব “পাবলিক ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাষ্ট” গঠন করে তাদের হাতেই সমস্ত সম্পত্তি তুলে দেন। সাম্প্রতি এই ট্রাষ্টের পরিচালন সমিতিতে ঢুকে পড়ে আরএসএস এবং শিবসেনার কট্টর সমর্থকেরা। মধুকর কাম্বলে এবং রত্নাকর গাইকোয়াড় এই দলের পাণ্ডা। শোনা যাচ্ছে রামদাস আতাউলেও আছে এই আত্তহননের মূলে। এরাই তস্করদের ডেকে এনে নিজ গৃহের সুলুক সন্ধান দিয়েছে। সংস্কারের নামে বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলেছে এবং পুনরায় নির্মাণের নামে বাড়িটিকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেবার ষড়যন্ত্র করেছে। দলিত-বহুজন স্বাধিকার আন্দোলন, পশ্চিমবঙ্গের পক্ষ থেকে এই কাপুরুষ ষড়যন্ত্রকারীদের চরম ধিক্কার জানাচ্ছি।



এই বাড়িটি ধ্বংসের মধ্য দিয়ে প্রকাশ্যে এসে গেছে নরেন্দ্র মোদির দ্বিচারিতা। তাঁর বাবাসাহেব বন্দনা যে আসলে একটি সজানো নাটক তা ধরা পড়ে গেছে। মোদি যে ব্রাহ্মন্যবাদীদের “জাতি সাফাই”(ethnic cleansing) অভিযানের জন্য ঝাঁটা হাতে তুলে নিয়েছে তা পরিষ্কার হয়ে গেছে।             



ব্রাহ্মন্যবাদ ইতিহাস ভয় পায়। ঐতিহাসিক বস্তুতে তাদের গাত্রদাহ হয়, নৃতাত্ত্বিক বস্তুতে তাদের শিরঃপীড়া হয়, বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষায় তাদের জীনগত উত্তেজনা বাড়ে তাই এই বাড়িটি ছিল তাদের গাত্রদাহ, শিরঃপীড়া ও জেনেটিক অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দু। কেননা এই বাড়িতেই ছিল একটি বিরলতম লাইব্রেরী, বাবাসাহেবের অপ্রকাশিত ম্যানুস্ক্রিপ্ট, পুরানো অসংখ্য দলিল দস্তাবেজ। এই বাড়িতেই ছিল বাবাসাহেবের আন্দোলনের অসংখ্য ইতিহাস। আম্বেদকর দর্শনের মূলকেন্দ্র হিসেবে এই বাড়ির সঞ্চিত রসদ যে সকল প্রগতিশীল মেধাকে উদ্দীপনা যোগাচ্ছিল তা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছে ছিল অত্যন্ত অস্বস্তিকর শিরঃপীড়ার কারণ।



এছাড়া যে ভাবে আইটিআই, মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে আম্বেদকরবাদী সংগঠন বিপুল সাড়া জাগিয়ে ব্রাহ্মন্যবাদকে প্রতিহত করার জন্য নীল ঝান্ডা নিয়ে “ জয় জয় জয় জয় জয় ভীম” শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলছে তাতে এক অশনিসংকেত দেখতে পাচ্ছে ব্রাহ্মন্যবাদী মোড়লরা।

এই মোড়লরা পর্যুদস্ত বামপন্থীদের দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল। মার্ক্সবাদকে একটি পরিত্যক্ত বিদেশী মতবাদ বলে ছুড়ে ফেলার আহ্বান জানিয়ে পরিতৃপ্ত হয়েছিল, মার্ক্সবাদীদের অস্তিত্বহীনতা ও অকার্যকারিতা দেখে উল্লসিত হয়েছিল, তাদের মতবাদ ভারতরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহের সামিল বলে উচ্চকিত হয়ে কানাইয়া কুমার, অনির্বাণ, ওমর খলিদদের বিরুদ্ধে “সেডিশন” নামক সুদর্শনচক্রে শান দিতে শুরু করেছিল, তখনই বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় আম্বেদকর এবং তাঁর হাতে তৈরি ভারতের জাতীয় পতাকা। ব্রাহ্মনবাদীরা লক্ষ্য করেন যে অতিবাম ছাত্রছাত্রীরাও হাতে ত্রিবর্ণ পতাকা নিয়ে, রোহিত পোষাকে সজ্জিত হয়ে বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের ছবি উত্তোলন করে সিংহনাদে উচ্চারণ করছে “জয় ভীম”। অনুরণিত হচ্ছে, “জাতপাত কি টক্কর মে, জয় ভীম হামারা নারা হ্যায়, ব্রাহ্মনবাদ কি টক্কর মে, জয় ভীম হামারা নারা হ্যায়, পুঁজিবাদ কি টক্কর মে, জয় ভীম হামারা নারা হ্যায়, ফ্যাসিবাদ কি টক্কর মে জয় ভীম হামারা নারা হ্যায়”। ব্রাহ্মণ্যবাদীরা হতচকিত হয়ে পড়েন এই Paradigm Shift এর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে। ব্রাহ্মণ্যবাদীদের ঘোষিত মহাপ্রলয়ের তাণ্ডব নর্তনকে প্রতিহত করার জন্য যে আম্বেদকরবাদী মহাজনপ্লাবন প্রবল শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং তার ঘূর্ণাবর্তে একেবারে ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে সুদর্শন ও সেডিশনের ধার তা তারা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পেরেছে।



অন্যদিকে আম্বেদকরের ভাগীদারী দর্শন মেনে গুজারাটের প্যাটেলরাও এসসি কোটায় রিজার্ভেশনের দাবীতে স্তব্ধ করে দিচ্ছে রাম রথের চাকা। ধীরে ধীরে ওবিসি সমাজের ঘুমন্ত বিবেককে জাগিয়ে তুলছে আম্বেদকর। বিচ্ছিন্নতার ধোকাবাজী ছেড়ে নিজস্ব সংস্কৃতি রক্ষার জন্য তীব্র ভাবে এগিয়ে আসছে আদিবাসী রেজিমেন্ট। মুসলিমরাও আম্বেদকরের মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন তাদের হারিয়ে যাওয়া দলিত স্বভিমান। সার্বিক ভাবে সর্বসমাজের এই উত্থান ব্রাহ্মন্যবাদের কাছে ভয়ঙ্কর বিপদ বলে মনে হচ্ছে। তাই সরাসরি আম্বেদকরকেই আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্রাহ্মন্যবাদ।

সাম্প্রতি রোহিত আন্দোলনের অন্যতম মুখ মা রাধিকা এবং রোহিতের ছোট ভাই এক ভাব গম্ভীর পরিবেশের মধ্যে এই বাড়িতেই বুদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। শোষিত, নিষ্পেষিতের আশ্রয় হিসেবে এই বাড়িটির আরো একটি দিগন্ত উন্মোচিত হয় এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। তাই অবিলম্বে এই বাড়িটি চূর্ণ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
 
দাদারের এই আম্বেদকর ভবন গুড়িয়ে দেওয়া একটি সংকেত।


এর মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মন্যবাদীরা পরখ করে নিতে চাইছে দলিত-বহুজনের প্রতিক্রিয়া। পরখ করে নিতে চাইছে সর্বসমাজের গুনগত অবস্থান। এই ধ্বংসের সংকেতের জবাবে আমরা নিরবতা পালন করলে ওরা আবার সুদর্শনে শান দিতে শুরু করবে। চেপে বসবে শেষ নাগের পিঠে। শঙ্খে ফুঁ দিয়ে শুরু করে দেবে প্রলয় নাচন।



আসুন ভারতের হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের জন্য এই ভ্রষ্টাচারীদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলি। সর্বসমাজ ভাইচারা প্রতিষ্ঠা করি।


জয় ভীম, জয় ভারত
দলিত-বহুজন স্বাধিকার আন্দোলন, জিন্দাবাদ।