দেবেশ রায়: রোহিত ভেমুলার মৃত্যু
যে
একই
সঙ্গে
আমাদের
দেশব্যাপী নাগরিক
সমাজে
ও
রাজনৈতিক সমাজে
আলোড়ন
তৈরি
করছে—
এটা
দেশের
জনজীবনের পক্ষে
খুব
প্রয়োজনীয়।
কংগ্রেসের সহ–সভাপতি রাহুল গান্ধী এই কারণে দুবার হায়দরাবাদে গিয়েছেন ও রোহিতের মৃত্যুর বিরুদ্ধে ছাত্রদের সমাবেশে যোগ দিয়েছেন, এটাও দেশের জনজীবনের পক্ষে খুব প্রয়োজনীয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও এই কর্তব্য ছিল।
আসন্ন বাজেট অধিবেশনে লোকসভায় এ নিয়ে বিরোধী দলগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সমবেত হবে ও অন্তত চার জনের পদত্যাগ চাইবে— উপাচার্য আপ্পা রাও পোড়িলে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বন্ডারু দত্তাত্রেয়, সুশীল কুমার ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি— এটাও খুব প্রয়োজনীয়।
ইতিমধ্যে সর্বভারতীয় বিভিন্ন কাগজে ও ম্যাগাজিনে বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, এটাও খুব প্রয়োজনীয়।
একটা কথা কেউ কেউ তুলছেন যে এমন মৃত্যু নিয়ে ‘রাজনীতি–করা’ ঠিক নয়। তা হলে, ‘রাজনীতি’ কী নিয়ে ‘করা’ যাবে? শিডিউল কাস্ট জনগোষ্ঠীর একজন স্নাতকোত্তর ছাত্র, যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম স্তরের পদাধিকারীদের কাছ থেকে অপমান ও অন্যায় শাস্তির ফলে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়ে থাকেন— তা হলে সেটাকে রাজনীতির বিষয় করে তোলা ও প্রধান বিষয় করে তোলাই তো এই মুহূর্তের একমাত্র সামাজিক কর্তব্য। সুতরাং, রাজনৈতিক কর্তব্যও।
প্রচলিত পরিভাষায় নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক সমাজকে পরস্পরের পরিপূরক করে তোলাই তো স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন তৈরি করে তোলার একমাত্র ভিত্তি হতে পারে।
রোহিতের মৃত্যু ঘটেছে এমন একটা প্রাতিষ্ঠানিক নীতিহীনতার ফলে। তা দুর্নীতিই শুধু নয়, সংবিধান বিরোধী ও সাম্প্রদায়িক। বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকার এমন প্রতিষ্ঠান। রোহিতকে তো আর বাঁচিয়ে তোলা যাবে না। সেই কারণেই সরকারকে বাধ্য করতে হবে এমন আইন তৈরি করতে যাতে এমন মৃত্যু আর না ঘটে। সরকার ও পার্লামেন্ট সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। পার্লামেন্টই পারে আইন বদলাতে। দিল্লির গণধর্ষণে নির্ভয়ার মৃত্যু যেমন সরকারকে আইন বদলাতে বাধ্য করেছে। রোহিতের মৃত্যুর প্রতিবাদে যাঁরা হায়দরাবাদের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করছেন, তাঁদের একটি দাবি কিন্তু দলিতদের আত্মরক্ষা রুখতে ‘রোহিত আইন’ পাস করা।
এমন একটা দাবির দরকার পড়ল কেন?
কারণ বিদেশি ও স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিল রোহিত একজন ‘দলিত’ হতে পারেন কিন্তু তিনি সে শিডিউল কাস্ট নন।
এমন একটা কথা বলার দরকার হয়েছিল যেহেতু ‘দলিত’ পরিচয়টা সাংবিধানিক পরিচয় নয় কিন্তু ‘শিডিউল্ড কাস্ট’ একটি সাংবিধানিক পরিচয়। আমাদের একটা আইন আছে— শিডিউল্ড কাস্ট/উপজাতিদের ওপর অত্যাচার দমন আইন। এই আইনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের (পোড়িলে) বিরুদ্ধে পুলিসে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। উল্লিখিত বাকি তিনজনও এই ধারায় অভিযুক্ত।
এই ধারার অভিযোগ থেকে তাঁদের মুক্ত করার জন্য বিদ্যার্থী পরিষদ প্রথম থেকেই ভেমুলার জাতি–পরিচয় নিয়ে আক্রমণ শুরু করে। ভেমুলাকে হত্যা করেই তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি, তারা ভেমুলার জাতি–পরিচয়ও লোপাট করতে চায়। এই হিন্দু–সাম্প্রদায়িকরা রোহিত ভেমুলার মাকে ছেলের মৃত্যুর পর পারলৌকিক ক্রিয়াও করতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত রোহিতের মা ও পরিবার সাংবাদিক সম্মিলন করে জানান যে তিনি, রোহিতের মা, মালা— এই শিডিউল্ড জনগোষ্ঠীতে জন্মেছেন, তিনি বিয়ে করেন ভাদদেরা জনগোষ্ঠীর একজনকে। সেই স্বামী ২০ বছর আগে তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন ও রোহিতের মা মালা–জনগোষ্ঠীতেই এখন বসবাস ও জীবনযাপন করেন। বি জে পি, স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিদ্যার্থী পরিষদ যদি প্রমাণ করতে পারে যে রোহিত, ভাদদেরা জনগোষ্ঠীভুক্ত তাহলে ওই চার অভিযুক্ত ‘শিডিউল্ড কাস্ট/উপজাতিদের ওপর অত্যাচার দমন আইন’–এর আওতা থেকে ছাড় পেয়ে যাবেন। যেহেতু ভাদদেরা জনগোষ্ঠী শিডিউল্ড কাস্ট নয়। কিন্তু যদি রোহিত মালা–জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলে প্রমাণিত হন তা হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ওই ধারা প্রয়োগ করা হবে ও তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে। গুন্টুর জেলার এক তহশিলদারের দেওয়া জাতি–পরিচয় সার্টিফিকেটে রোহিতকে শিডিউল্ড কাস্ট বলে প্রমাণপত্র দেওয়া হয়েছে।
রোহিতের পরিচয়— শিডিউল্ড কাস্ট থেকে দলিতে বদলে দেওয়ার এই রাজনীতিতে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতীন গাডকারি ও বেঙ্কাইয়া নাইডু ও বীরেন্দ্র সিংরায়ও জড়িয়ে গেছেন।
হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের এটাই সমস্যা। তারা গান্ধীকে হত্যা করে। তারপর, খুনিকে দেবতা বানায়।
সেই কারণেই, হিন্দুদের অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা অনেক জটিল। আমাদের জাতীয় আন্দোলনে হিন্দু আর মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাতের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার চাপে হিন্দু সমাজের অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িকতাকে একটু কৌশলে আড়াল করে রাখা হত বটে কিন্তু কোনও সময়ই হিন্দুদের এই অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িকতার নিষ্পত্তি ঘটেনি। এমনকী গান্ধীজিও এই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর অস্পৃশ্যতা বিরোধী ও অন্যান্য সামািজক কর্মসূচিকে খুব একটা সফল করতে পারেননি।
হিন্দু ধর্ম বলে একটা কোনও নির্দিষ্ট সমাজ কোনও কালেই নেই। কতকগুলি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী নিজেদের হিন্দু বলত বটে কিন্তু নিজেদের মধ্যেই মারামারি করত। শৈব আর বৈষ্ণবদের মধ্যে তো সশস্ত্র দাঙ্গা হত। বৈষ্ণবদের এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আর এক সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা হত। আর, এই সব সম্প্রদায়ের ভিতর যথেষ্ট প্রকট অস্পৃশ্যতা ছিল। বস্তুত অস্পৃশ্যতা ও ছুঁতমার্গ হিন্দুধর্মের অন্তর্গত সম্প্রদায়গুলির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। তামিল ব্রাহ্মণ বাঙালি ব্রাহ্মণের ছোঁয়া খায় না।
শিক্ষাপ্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এই সব ধর্মাচার কমে আসছে বা কমে আসে, এমন ধারণাও ভুল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কোনও অব্রাহ্মণ বাড়িতে ভাত খেতেন না তো বটেই, জলও খেতেন না। ব্রাহ্মদের মধ্যেও ব্রাহ্মণ ব্রাহ্ম ও অব্রাহ্মণ ব্রাহ্মদের মধ্যে জাতিভেদ ছিল। ঠাকুরবাড়ির কোনও ছেলের বা মেয়ের কি সেকালে অব্রাহ্মণের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে?
বরং শিক্ষা, এক ধরনের নতুন কৌলীন্য তৈরি করে জাতিগত পুরনো কৌলীন্যকে নতুন শক্তিতে বীভৎস করে তোলে অনেক সময়। তার মানে এই নয় যে অশিক্ষা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তির দাওয়াই। তার মানে, অশিক্ষিত দরিদ্র তার জীবনযাপনের দায় থেকে অনেক সময় তাড়াতাড়ি সাম্প্রদায়িক সংস্কার ঝেড়ে ফেলতে পারে ও শিক্ষিত সম্পন্ন মানু্ষ তার শিক্ষা ও সম্পন্নতার জোরেই বেশি করে সাম্প্রদায়িক হতে চায়। রোহিত ভেমুলার মৃত্যুতে তা আরও একবার প্রমাণিত হল। তাঁর মৃত্যুর পরও উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদীদের রাজনৈতিক আচরণে তা আরও প্রমাণিত হচ্ছে। সম্ভবত ভবিষ্যতে আদালতে ও পার্লামেন্টে আরও বেশি প্রমাণিত হবে যে হিন্দুদের নিজেদের ভিতরকার সাম্প্রদায়িকতা কতটাই দৃঢ়মূল ও কতটাই নিষ্ঠুর।
পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক মেঘনাদ সাহা ছিলেন নিম্নবর্ণের সন্তান। তিনি স্কুলের পড়া শেষ করে কলকাতায় এলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে। তাঁর পরীক্ষার ফল এতই ভাল ছিল যে তাঁকে সবাই নামেই চিনত। থাকতেন হিন্দু হস্টেলে, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রাবাস। খাবার সময় যখন তিনি সবার সঙ্গে খেতে বসতেন তখন কিছু উচ্চবর্ণ আবাসিক ছাত্র তাঁর সঙ্গে খেতে বসতে আপত্তি করেন। এর প্রতিবাদে মেঘনাদের দুই সহপাঠী জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও নীলরতন ধর হিন্দু হস্টেল থেকে মেঘনাদকে নিয়ে বেরিয়ে যান ও সে–রাতটা রাস্তায় কাটিয়ে পরদিন নিজেরা একটা মেস তৈরি করেন। কালক্রমে এই তিনজনই তাঁদের বৈজ্ঞানিক গবেষণার জোরে পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক জগতে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন।
আজ রোহিতকে নিয়ে যে–সঙ্কট তৈরি হয়েছে প্রায় অবিকল তেমন সঙ্কটের সমাধান খুঁজছিলেন ১৯১৭ সালের স্যাডলার কমিশন। স্যাডলার কমিশন জানতে চাইছিলেন— স্কুল–কলেজে সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা ও ছাত্রাবাসে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ছাত্রদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে কী কী সঙ্কট তৈরি হয়, সে সম্পর্কে। মেঘনাদ সাহা উত্তর দিয়েছিলেন, তিনিও রোহিতের মতোই নিজেকে অনুন্নত বা শিডিউল্ড (তখন তো তেমন কোনও তালিকা তৈরিই হয়নি) বলতে চাইতেন না। তিনি নিজের পরিচয় দিতেন ডেমোক্রেটিক ক্লাস বলে। রোহিতও তো তাই বলতেন। মেঘনাদ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বিভিন্ন কলেজের হস্টেলগুলিতে আসলে কিছু উচ্চবর্ণ হিন্দু ছাত্রদের আধিপত্য চলে— ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য। ডেমোক্রেটিক শ্রেণীর (নিম্নবর্ণের) ছাত্রদের জায়গা মেলে না। পরীক্ষার ফল দেখে যদি নিতে বাধ্য হয় তা হলেও তাদের করুণা করা হয়। যদি একই ঘরে উভয় ধরনের (উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণ) ছাত্রকে থাকতে দেওয়া হয়, একই খাবার ঘরে তাদের খেতে দেওয়া হয় তাহলে, হতভাগা (নিম্নবর্ণের) ছেলেটিকে সেই ঘর থেকে বাইরে যেতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে তাকে আলাদা বসে খেতে হয়। এ–সব বহু ঘটনা আমার জানা।’
১৯১৭–র মেঘনাদ সাহা ও ২০১৬–র রোহিত ভেমুলার অভিজ্ঞতার কী আশ্চর্য মিল। কী আশ্চর্য মিল— প্রেসিডেন্সি কলেজ আর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণের মধ্যে। কলকাতা শহরে হিন্দু হস্টেলের নাম এখনও হিন্দু হস্টেল।
অধ্যাপক শ্যামল চক্রবর্তী তাঁর সাম্প্রতিক একটু লেখায় মেঘনাদ সাহার জীবনের এই বিশেষ দিকটির কথা বিস্তারিত করেছেন।
তফাত একটা ঘটেছে মনে হয়।
রোহিত ভেমুলাকে নিয়ে নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক সমাজ সারা দেশেই তৎপর হয়ে উঠেছে। ওই চারজনকে গ্রেপ্তার করতে হবে, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে ও নতুন আইন তৈরি করতে হবে। সেটা সম্ভবও মনে হচ্ছে।
http://aajkaal.in/editorial/editorial-front-page/%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%98%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a6-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%be-%e0%a6%93-%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%a4-%e0%a6%ad%e0%a7%87%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b2/
কংগ্রেসের সহ–সভাপতি রাহুল গান্ধী এই কারণে দুবার হায়দরাবাদে গিয়েছেন ও রোহিতের মৃত্যুর বিরুদ্ধে ছাত্রদের সমাবেশে যোগ দিয়েছেন, এটাও দেশের জনজীবনের পক্ষে খুব প্রয়োজনীয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলেরও এই কর্তব্য ছিল।
আসন্ন বাজেট অধিবেশনে লোকসভায় এ নিয়ে বিরোধী দলগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সমবেত হবে ও অন্তত চার জনের পদত্যাগ চাইবে— উপাচার্য আপ্পা রাও পোড়িলে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বন্ডারু দত্তাত্রেয়, সুশীল কুমার ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি— এটাও খুব প্রয়োজনীয়।
ইতিমধ্যে সর্বভারতীয় বিভিন্ন কাগজে ও ম্যাগাজিনে বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে, এটাও খুব প্রয়োজনীয়।
একটা কথা কেউ কেউ তুলছেন যে এমন মৃত্যু নিয়ে ‘রাজনীতি–করা’ ঠিক নয়। তা হলে, ‘রাজনীতি’ কী নিয়ে ‘করা’ যাবে? শিডিউল কাস্ট জনগোষ্ঠীর একজন স্নাতকোত্তর ছাত্র, যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম স্তরের পদাধিকারীদের কাছ থেকে অপমান ও অন্যায় শাস্তির ফলে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়ে থাকেন— তা হলে সেটাকে রাজনীতির বিষয় করে তোলা ও প্রধান বিষয় করে তোলাই তো এই মুহূর্তের একমাত্র সামাজিক কর্তব্য। সুতরাং, রাজনৈতিক কর্তব্যও।
প্রচলিত পরিভাষায় নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক সমাজকে পরস্পরের পরিপূরক করে তোলাই তো স্বাভাবিক ও সুস্থ জীবন তৈরি করে তোলার একমাত্র ভিত্তি হতে পারে।
রোহিতের মৃত্যু ঘটেছে এমন একটা প্রাতিষ্ঠানিক নীতিহীনতার ফলে। তা দুর্নীতিই শুধু নয়, সংবিধান বিরোধী ও সাম্প্রদায়িক। বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকার এমন প্রতিষ্ঠান। রোহিতকে তো আর বাঁচিয়ে তোলা যাবে না। সেই কারণেই সরকারকে বাধ্য করতে হবে এমন আইন তৈরি করতে যাতে এমন মৃত্যু আর না ঘটে। সরকার ও পার্লামেন্ট সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান। পার্লামেন্টই পারে আইন বদলাতে। দিল্লির গণধর্ষণে নির্ভয়ার মৃত্যু যেমন সরকারকে আইন বদলাতে বাধ্য করেছে। রোহিতের মৃত্যুর প্রতিবাদে যাঁরা হায়দরাবাদের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান করছেন, তাঁদের একটি দাবি কিন্তু দলিতদের আত্মরক্ষা রুখতে ‘রোহিত আইন’ পাস করা।
এমন একটা দাবির দরকার পড়ল কেন?
কারণ বিদেশি ও স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ প্রকাশ্যেই ঘোষণা করেছিল রোহিত একজন ‘দলিত’ হতে পারেন কিন্তু তিনি সে শিডিউল কাস্ট নন।
এমন একটা কথা বলার দরকার হয়েছিল যেহেতু ‘দলিত’ পরিচয়টা সাংবিধানিক পরিচয় নয় কিন্তু ‘শিডিউল্ড কাস্ট’ একটি সাংবিধানিক পরিচয়। আমাদের একটা আইন আছে— শিডিউল্ড কাস্ট/উপজাতিদের ওপর অত্যাচার দমন আইন। এই আইনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের (পোড়িলে) বিরুদ্ধে পুলিসে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। উল্লিখিত বাকি তিনজনও এই ধারায় অভিযুক্ত।
এই ধারার অভিযোগ থেকে তাঁদের মুক্ত করার জন্য বিদ্যার্থী পরিষদ প্রথম থেকেই ভেমুলার জাতি–পরিচয় নিয়ে আক্রমণ শুরু করে। ভেমুলাকে হত্যা করেই তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি, তারা ভেমুলার জাতি–পরিচয়ও লোপাট করতে চায়। এই হিন্দু–সাম্প্রদায়িকরা রোহিত ভেমুলার মাকে ছেলের মৃত্যুর পর পারলৌকিক ক্রিয়াও করতে দেয়নি। শেষ পর্যন্ত রোহিতের মা ও পরিবার সাংবাদিক সম্মিলন করে জানান যে তিনি, রোহিতের মা, মালা— এই শিডিউল্ড জনগোষ্ঠীতে জন্মেছেন, তিনি বিয়ে করেন ভাদদেরা জনগোষ্ঠীর একজনকে। সেই স্বামী ২০ বছর আগে তাঁকে ছেড়ে চলে গেছেন ও রোহিতের মা মালা–জনগোষ্ঠীতেই এখন বসবাস ও জীবনযাপন করেন। বি জে পি, স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ, বিদ্যার্থী পরিষদ যদি প্রমাণ করতে পারে যে রোহিত, ভাদদেরা জনগোষ্ঠীভুক্ত তাহলে ওই চার অভিযুক্ত ‘শিডিউল্ড কাস্ট/উপজাতিদের ওপর অত্যাচার দমন আইন’–এর আওতা থেকে ছাড় পেয়ে যাবেন। যেহেতু ভাদদেরা জনগোষ্ঠী শিডিউল্ড কাস্ট নয়। কিন্তু যদি রোহিত মালা–জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত বলে প্রমাণিত হন তা হলে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ওই ধারা প্রয়োগ করা হবে ও তাদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে। গুন্টুর জেলার এক তহশিলদারের দেওয়া জাতি–পরিচয় সার্টিফিকেটে রোহিতকে শিডিউল্ড কাস্ট বলে প্রমাণপত্র দেওয়া হয়েছে।
রোহিতের পরিচয়— শিডিউল্ড কাস্ট থেকে দলিতে বদলে দেওয়ার এই রাজনীতিতে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নীতীন গাডকারি ও বেঙ্কাইয়া নাইডু ও বীরেন্দ্র সিংরায়ও জড়িয়ে গেছেন।
হিন্দু সাম্প্রদায়িকদের এটাই সমস্যা। তারা গান্ধীকে হত্যা করে। তারপর, খুনিকে দেবতা বানায়।
সেই কারণেই, হিন্দুদের অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা অনেক জটিল। আমাদের জাতীয় আন্দোলনে হিন্দু আর মুসলিমদের সাম্প্রদায়িক সঙ্ঘাতের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার চাপে হিন্দু সমাজের অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িকতাকে একটু কৌশলে আড়াল করে রাখা হত বটে কিন্তু কোনও সময়ই হিন্দুদের এই অভ্যন্তরীণ সাম্প্রদায়িকতার নিষ্পত্তি ঘটেনি। এমনকী গান্ধীজিও এই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর অস্পৃশ্যতা বিরোধী ও অন্যান্য সামািজক কর্মসূচিকে খুব একটা সফল করতে পারেননি।
হিন্দু ধর্ম বলে একটা কোনও নির্দিষ্ট সমাজ কোনও কালেই নেই। কতকগুলি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী নিজেদের হিন্দু বলত বটে কিন্তু নিজেদের মধ্যেই মারামারি করত। শৈব আর বৈষ্ণবদের মধ্যে তো সশস্ত্র দাঙ্গা হত। বৈষ্ণবদের এক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আর এক সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা হত। আর, এই সব সম্প্রদায়ের ভিতর যথেষ্ট প্রকট অস্পৃশ্যতা ছিল। বস্তুত অস্পৃশ্যতা ও ছুঁতমার্গ হিন্দুধর্মের অন্তর্গত সম্প্রদায়গুলির প্রধানতম বৈশিষ্ট্য। তামিল ব্রাহ্মণ বাঙালি ব্রাহ্মণের ছোঁয়া খায় না।
শিক্ষাপ্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এই সব ধর্মাচার কমে আসছে বা কমে আসে, এমন ধারণাও ভুল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কোনও অব্রাহ্মণ বাড়িতে ভাত খেতেন না তো বটেই, জলও খেতেন না। ব্রাহ্মদের মধ্যেও ব্রাহ্মণ ব্রাহ্ম ও অব্রাহ্মণ ব্রাহ্মদের মধ্যে জাতিভেদ ছিল। ঠাকুরবাড়ির কোনও ছেলের বা মেয়ের কি সেকালে অব্রাহ্মণের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে?
বরং শিক্ষা, এক ধরনের নতুন কৌলীন্য তৈরি করে জাতিগত পুরনো কৌলীন্যকে নতুন শক্তিতে বীভৎস করে তোলে অনেক সময়। তার মানে এই নয় যে অশিক্ষা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তির দাওয়াই। তার মানে, অশিক্ষিত দরিদ্র তার জীবনযাপনের দায় থেকে অনেক সময় তাড়াতাড়ি সাম্প্রদায়িক সংস্কার ঝেড়ে ফেলতে পারে ও শিক্ষিত সম্পন্ন মানু্ষ তার শিক্ষা ও সম্পন্নতার জোরেই বেশি করে সাম্প্রদায়িক হতে চায়। রোহিত ভেমুলার মৃত্যুতে তা আরও একবার প্রমাণিত হল। তাঁর মৃত্যুর পরও উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদীদের রাজনৈতিক আচরণে তা আরও প্রমাণিত হচ্ছে। সম্ভবত ভবিষ্যতে আদালতে ও পার্লামেন্টে আরও বেশি প্রমাণিত হবে যে হিন্দুদের নিজেদের ভিতরকার সাম্প্রদায়িকতা কতটাই দৃঢ়মূল ও কতটাই নিষ্ঠুর।
পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক মেঘনাদ সাহা ছিলেন নিম্নবর্ণের সন্তান। তিনি স্কুলের পড়া শেষ করে কলকাতায় এলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে। তাঁর পরীক্ষার ফল এতই ভাল ছিল যে তাঁকে সবাই নামেই চিনত। থাকতেন হিন্দু হস্টেলে, প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রাবাস। খাবার সময় যখন তিনি সবার সঙ্গে খেতে বসতেন তখন কিছু উচ্চবর্ণ আবাসিক ছাত্র তাঁর সঙ্গে খেতে বসতে আপত্তি করেন। এর প্রতিবাদে মেঘনাদের দুই সহপাঠী জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও নীলরতন ধর হিন্দু হস্টেল থেকে মেঘনাদকে নিয়ে বেরিয়ে যান ও সে–রাতটা রাস্তায় কাটিয়ে পরদিন নিজেরা একটা মেস তৈরি করেন। কালক্রমে এই তিনজনই তাঁদের বৈজ্ঞানিক গবেষণার জোরে পৃথিবীর বৈজ্ঞানিক জগতে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেন।
আজ রোহিতকে নিয়ে যে–সঙ্কট তৈরি হয়েছে প্রায় অবিকল তেমন সঙ্কটের সমাধান খুঁজছিলেন ১৯১৭ সালের স্যাডলার কমিশন। স্যাডলার কমিশন জানতে চাইছিলেন— স্কুল–কলেজে সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা ও ছাত্রাবাসে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ছাত্রদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে কী কী সঙ্কট তৈরি হয়, সে সম্পর্কে। মেঘনাদ সাহা উত্তর দিয়েছিলেন, তিনিও রোহিতের মতোই নিজেকে অনুন্নত বা শিডিউল্ড (তখন তো তেমন কোনও তালিকা তৈরিই হয়নি) বলতে চাইতেন না। তিনি নিজের পরিচয় দিতেন ডেমোক্রেটিক ক্লাস বলে। রোহিতও তো তাই বলতেন। মেঘনাদ উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বিভিন্ন কলেজের হস্টেলগুলিতে আসলে কিছু উচ্চবর্ণ হিন্দু ছাত্রদের আধিপত্য চলে— ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য। ডেমোক্রেটিক শ্রেণীর (নিম্নবর্ণের) ছাত্রদের জায়গা মেলে না। পরীক্ষার ফল দেখে যদি নিতে বাধ্য হয় তা হলেও তাদের করুণা করা হয়। যদি একই ঘরে উভয় ধরনের (উচ্চবর্ণ ও নিম্নবর্ণ) ছাত্রকে থাকতে দেওয়া হয়, একই খাবার ঘরে তাদের খেতে দেওয়া হয় তাহলে, হতভাগা (নিম্নবর্ণের) ছেলেটিকে সেই ঘর থেকে বাইরে যেতে বলা হয়। সেখানে গিয়ে তাকে আলাদা বসে খেতে হয়। এ–সব বহু ঘটনা আমার জানা।’
১৯১৭–র মেঘনাদ সাহা ও ২০১৬–র রোহিত ভেমুলার অভিজ্ঞতার কী আশ্চর্য মিল। কী আশ্চর্য মিল— প্রেসিডেন্সি কলেজ আর কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণের মধ্যে। কলকাতা শহরে হিন্দু হস্টেলের নাম এখনও হিন্দু হস্টেল।
অধ্যাপক শ্যামল চক্রবর্তী তাঁর সাম্প্রতিক একটু লেখায় মেঘনাদ সাহার জীবনের এই বিশেষ দিকটির কথা বিস্তারিত করেছেন।
তফাত একটা ঘটেছে মনে হয়।
রোহিত ভেমুলাকে নিয়ে নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক সমাজ সারা দেশেই তৎপর হয়ে উঠেছে। ওই চারজনকে গ্রেপ্তার করতে হবে, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হবে ও নতুন আইন তৈরি করতে হবে। সেটা সম্ভবও মনে হচ্ছে।
http://aajkaal.in/editorial/editorial-front-page/%e0%a6%ae%e0%a7%87%e0%a6%98%e0%a6%a8%e0%a6%be%e0%a6%a6-%e0%a6%b8%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%be-%e0%a6%93-%e0%a6%b0%e0%a7%8b%e0%a6%b9%e0%a6%bf%e0%a6%a4-%e0%a6%ad%e0%a7%87%e0%a6%ae%e0%a7%81%e0%a6%b2/
No comments:
Post a Comment