বিএসসি পাশ করে কাঁসিরাম ডিআরডিওর অ্যাসিস্ট্যান্ট সায়েন্টিস্ট হিসেবে মিলিটারী অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিতে কাজ করছিলেন। মিস্টার দিনা ভানা ছিলেন এই ফ্যাক্টরির একজন দলিত নেতা।তিনি রাজস্থানের মানুষ। ১৯৫৭ সালে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরির ম্যানেজমেন্ট ছুটির তালিকা থেকে বাবা সাহেব আম্বেদকরের জন্মদিন এবং বুদ্ধের জন্মদিন বাদ দেয়। পরিবর্তে তিলকের জন্মদিন এবং দেওয়ালীকে ছুটির তালিকায় ঢোকান হয়। প্রতিবাদে সরব হন দিনা ভানা। ম্যানেজমেন্ট তাঁকে সাসপেন্ড করে। প্রতিবাদে ফেটে পড়েন দলিত সহযোদ্ধারা। শুরু হয় লাগাতার আন্দোলন। শক্ত হাতে এই আন্দোলন পরিচালনা করতে এগিয়ে আসেন কাঁসিরাম। ফল স্বরূপ বাবা সাহেবের জন্মদিন এবং বুদ্ধের জন্মদিনকে আবার ছুটির দিন হিসেবে মেনে নিতে হয় এবং দিনা ভানাকে সসম্মানে পুনর্বহাল করতে বাধ্য হয় ম্যানেজমেন্ট।
এই আন্দোলনের আগে তেমন ভাবে জাত বৈষম্যের ঘৃণ্য অবস্থা সম্পর্কে কাঁসিরামের পরিচয় ছিল না। এই আন্দোলনই তাঁর জীবনে এক ব্যপক পরিবর্তন আনে। হাতে আসে বাবা সাহেবের লেখা
"Annihilation of Castes" । ঘুম চলে যায় তাঁর। হাতে আসে জ্যোতি রাও ফুলের গোলামগিরি। জানতে পারেন সাহু মহারাজ, পেরিয়ার অসামান্য লড়াইয়ের কথা। পড়ে ফেলেন বাবা সাহেবের অবিস্মরণীয় মাদ্রাজ ডিক্লেরেশন। ১৯৪৪ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর বাবা সাহেব মাদ্রাজে ঘোষণা করেছিলেন, "Understand our ultimate
goal. Our ultimate goal is to become the rulers of this country. Write this
goal on the walls of your houses so that you will never forget. Our struggle is
not for the few jobs and concessions but we have a larger goal to achieve. That
goal is to become the rulers of the land."
কাঁসিরাম তাঁর ভবিষ্যৎ ঠিক করে ফেলেন। ১৯৬৪ তিনি চাকরী ছেড়ে দেন। ঠিক করেন তিনি বিয়ে করবেন না। বাবা সাহেবের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করাই হবে তাঁর একমাত্র লক্ষ্য।
১৯৫৬ সালের ৬ই ডিসেম্বর বাবা সাহেবের মহাপরিনিব্বানের পরে জানা যায় যে তিনি রিপাবলিকান পার্টি অফ ইন্ডিয়া(আরপিআই) নামে
একটি
রাজনৈতিক
দল
গঠন
করেছিলেন।
১৯৫৭
সাল
থেকে
এই
পার্টি
কাজ
করতে
শুরু
করে।
কিন্তু
নেতৃত্বের
কারনেই
এই
রাজনৈতিক
পার্টি
কেবল
মাত্র
মহারাষ্ট্রের
মধ্যে
সীমাবদ্ধ
হয়ে
পড়ে।
মাহার
ছাড়া
অন্য
পিছিয়ে
থাকা
সমাজের
অনেকেই
আরপিআই
ছেড়ে
কংগ্রেসের
সাথে
চলে
যায়।
কাঁসিরাম ৮বছর ধরে আরপিআইয়ের একজন সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করে যান। এই সময় দাদা সাহেব গাইকোয়ার একটি মাত্র লোকসভা আসনের জন্য কংগ্রেসের মোহন ধারিয়ার সঙ্গে হাত মেলান। আরপিআই এই একটি আসনে প্রার্থী দিতে পারাকেই বিরাট সাফল্য মনে করে। কাঁসিরাম মনে করেন সামাজিক এবং মানসিক পরিবর্তন না আনতে পারলে এই জাতি কখনোই রাজা হতে পারবে না। তাই এমন জাতি গঠন করা দরকার যে কোন অবস্থাতেই নিজের সত্তা বিক্রি করবে না। তিনি গঠন করলেন
Scheduled Castes, Scheduled Tribes, Other Backward classes and Minorities
Employees Welfare Association। এটি ছিল তাঁর সামজিক সংগ্রামের প্রস্তুতি মাত্র।
৫ বছর ভারতের বহুজন সমাজের শিক্ষিত চাকরিজীবীদের একত্রিত করে সংগ্রামের জন্য অর্থনৈতিক বুনিয়াদ খানিকটা মজবুত করে তিনি শুরু করলেন সামাজিক পরিবর্তনের আসল সংগ্রাম। ১৯৭৮ সালে তৈরি করলেন বামসেফ।
পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনকে একেবারে বিপ্লবাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য ১৯৮১ সালে তৈরি হল দলিত শোসিত সমাজ সংঘর্ষ সমিতি বা ডিএস-৪। কাঁসিরাম মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন যে, "people who should succeed
politically must have strong non-political roots"। বামসেফকে তিনি সেই ভাবেই তৈরি করলেন যেন তাঁরা দেশ ও সমাজের জন্য যোগ্য নেতা তৈরি করার কাজে মনোনিবেশ করেন।
নেতৃত্বের খোঁজে প্রতিটি রাজ্যে রাজ্যে শুরু হল এক মুসাফিরের সমাজ পরিবর্তনের যাত্রা। ঘুমন্ত বহুজনের দরজায় দরজায় কড়া নেড়ে তিনি প্রতিধ্বনিত করলেন বাবা সাহেবের সেই অমোঘ ঘোষণা
"Educate Organize and Agitate"।
বামসেফের দায়িত্ব, কর্তব্য এবং অবস্থান কেমন হবে তা নিয়ে মান্যবর কাঁসিরামের চিন্তার শেষ ছিল না। বিশেষ করে বহুজন সমাজ পার্টি গঠিত হলে বামসেফের সাথে দলের কর্মীদের সম্পর্ক কেমন হবে তা বিভিন্ন কর্মশালায় আলোচ্য বিষয় হিসেবে উঠে আসে। কাঁসিরাম বিভিন্ন ক্যাডার ক্যাম্পে ডায়াগ্রাম এঁকে বামসেফের অবস্থান, দায়িত্ব এবং কর্তব্যকে বুঝিয়ে দেন। মানুষের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তুলে আনেন এই ডায়াগ্রাম।
এই ডায়াগ্রামের দুটি অংশঃ
তিনি সূর্যের সাথে বহুজন সমাজ পার্টির প্রভাবের তুলনা করলেন। ভোরের সূর্যের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে নেতা বা কর্মী হিসেবে বর্ণনা করলেন আর তার দীর্ঘ ছায়াকে তুলনা করলেন বামসেফ হিসেবে। তিনি জানান যে সূর্য ধীরে ধীরে উপরে দৃশ্যমান হলে তার প্রভাব তত প্রখর হবে অপর দিকে ছায়ার পরিমাপ ক্রমশ ছোট হয়ে আসবে। সূর্য যখন একেবারে মধ্য গগনে দৃশ্যমান হবে তখন এই ছায়া আর কায়া মিলে মিশে একাকার হয়ে যাবে। বহুজন সমাজ পার্টি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল বহুজনের রাষ্ট্রীয় ভাগিদারী সুনিশ্চিত করবে। পার্টির গঠন শৈলীর মধ্যে এই শৈল্পিক আবেগ থাকলেও এটি ছিল বামসেফের একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান।
কংগ্রেসের অর্জুন সিংহের মদতে এবং বামসেফের কিছু ক্ষমতা লোভী পদাধিকারীর অসহযোগিতায় কাঁসিরামকে এই স্যাডো বামসেফ অবস্থান থেকে সরে আসতে হয়। কাঁসিরাম লক্ষ্য করেন এই পদাধিকারীদের মধ্যে অনেকেই মেগালোমেনিয়াক। ডগমা’য় আক্রান্ত। তাঁরা অর্থ লোলুপ এবং ক্ষমতার জন্য লালায়িত। এরা বামসেফকে রেজিস্ট্রেশন করে অরাজনৈতিক,
গণআন্দোলনবিমুখ একটি সুবিধাভোগী সংগঠন বানাতে চায়। কনভেনশনের নামে ভুরিভোজের আয়োজন করতে চায় এবং বহুজনের উপর নিজেদের মাতব্বরি চাপিয়ে দিতে চায়।
১৯৮৪ সালে সারা দেশ জুড়ে ১০০ দিনের সাইকেল র্যালি এবং ৭০০০ মিটিং সমাপ্ত করার পর ১৪ই এপ্রিল বাবা সাহেব আম্বেদকরের জন্মদিনে দিল্লীতে এক বিশাল সমাবেশের মধ্য দিয়ে বহুজন সমাজ পার্টির আত্তপ্রকাশ ঘটে। এই বিশাল সভায় মান্যবর শ্লোগান তোলেন,
“ভোট হমারা রাজ তুমহারা,
নেহি চলেগা নেহি চলেগা”।
বামসেফের যে অংশ মান্যবর কাঁসিরামকে সমর্থন করেন এবং বিএসপিকে তন-মন-ধন দিয়ে সাহায্য করেতে এগিয়ে আসেন তাঁদের জন্য তৈরি হয় নতুন মডিউল। মান্যবর বহুজন সমাজ পার্টিকে একটি বটবৃক্ষের সাথে তুলনা করে বামসেফকে এই পার্টির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে সম্পৃক্ত করে নেন। তিনি জানান যে বামসেফ হল এই বটবৃক্ষের শিকড়। এই শিকড় মাটির তলায় বিস্তৃত হয়ে বটবৃক্ষকে খাদ্য যোগান দ্যবে। শিকড় যত বিস্তৃত হবে, যত খাদ্যের যোগান দেবে বৃক্ষ ততই ডালপালা মেলে বেড়ে উঠবে। ঝুরি নামিয়ে বৃক্ষের আয়তন সম্প্রসারিত হবে। এই প্রক্রিয়ায় ক্রমশ মহীরুহে পরিণত হবে বহুজন সমাজ পার্টি। কাঁসিরাম সতর্ক করে দেন যে এই শিকড় কখনোই মাটির উপরে উঠে আসবে না। শিকড়ের মূল মাটির সম্পদ সংগ্রহ করে গাছকে যোগান দেওয়া। অর্থাৎ এই বামসফের কর্মীরা হলেন সেই ইন্টেলেকচুয়াল ফোর্স যারা তাঁদের জ্ঞান,
দক্ষতা ও কর্মক্ষমতা দিয়ে বহুজন সমাজ পার্টির কর্মীদের দেশের ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির সাথে সম্যক পরিচয় করাবেন এবং দক্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে গড়ে তুলবেন। শিকড়ের কাজ যেমন উপর থেকে দৃশ্যমান হয় না তেমনি বামসেফের কর্মীরা নিঃশব্দে কাজ করে যাবেন। এই সময় মান্যবর কাঁসিরাম ঘোষণা করলেনঃ "I
will never get married, I will never acquire any property, I will never visit
my home, I will devote and dedicate the rest of my life to achieve the goals of
Phule -Ambedkar movement"
বহুজন সমাজ পার্টি গঠন করার পরেই নির্বাচনে লড়াইয়ের প্রস্তুতি শুরু হয়। মান্যবর কাঁসিরাম বামসেফের পদাধিকারীদের পূর্ণ দায়িত্ব নেবার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি জানান যে বহুজন সমাজ পার্টি ছাড়া আর কোন কাজ তিনি করবেন না।
১৯৮৬ সালে বামসেফ আড়াআড়ি বিভাজিত হয়ে যায়। সমস্ত অর্থ ভান্ডার হাতিয়ে নিয়ে সরে পড়ে সুবিধাভোগীর দল। অন্যদিকে মাননীয় টি এস ঝাল্লি পুরানো বামসেফকে অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে রেজিস্ট্রি করেন। তিনি বামসেফের জাতীয় অধ্যক্ষ হিসেবে মনোনীত হন। ঝাল্লির পরে জাতীয় অধ্যক্ষ হিসবে মনোনীত হন রাজ সিং পানোয়ার। ২০০৮ সালে তিনি পদত্যাগ করলে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই দায়িত্বভার পালন করেন গুজরাটের বেচাভাই রাঠোর। মাননীয় অটবীর সিং বর্তমানে এই বামসেফের দায়িত্বে আছেন।
রণনীতি, রণকৌশল তৈরি হল। এবার যোদ্ধার প্রয়োজন। দৃঢ়চেতা, নির্ভীক সৈনিক চাই। রাজ্যে রাজ্যে,
সেমিনার হলে, কলেজের নির্বাচনে নিঃশব্দে এই সৈনিক জোগাড় করা মান্যবর কাঁসিরামের এক গোপন অভিসার। এক অভিজ্ঞ জহুরির চোখ নিয়ে বিরামহীন ভাবে খুঁজে চলেছেন বহুজন সৈনিক। রাত কাটিয়েছেন ফুটপাথে, পার্কের বেঞ্চে,
রেলওয়ে
স্টেশনে । আবার কক্ষনো বস্তিতে, পর্ণকুটিরে, গ্রামে, গঞ্জে, শহরে। মনে পড়ছে বাবা সাহেবের অমোঘ ঘোষণাঃ “Our
is a battle, not for wealth nor for power. Our is a battle for freedom, for
reclamation of human personality”.
আবার মনে পড়ছে, “We must stand on our own feet and fight as best as we can for our rights. So carry on your agitation and organize your forces. Power and prestige will come to you through struggle”.
আবার মনে পড়ছে, “We must stand on our own feet and fight as best as we can for our rights. So carry on your agitation and organize your forces. Power and prestige will come to you through struggle”.
(চলবে)
কাঁশিরামজী,
ReplyDeleteতোমার আজীবন ত্যাগী কিন্ত কৌশল সংঘর্ষের ফসল
ঘুমন্ত বহুজন সমাজ জেগে উঠে করছে ভারত দখল ।
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteCommitment and it's fulfilment makes a man or a woman perfect.
ReplyDeleteবহুজনের রাজনৈতিক উত্থানকে গতিশীল করতে মান্যবর কাঁসিরাম বহুজন মনিষীদের বিচারধারাকে দর্ষণ হিসেবে বেছে নিলেন। গোতমা বুদ্ধ থেকে হরিচাঁদ-গুরুচাদের বিচারধারাকে মনুবাদী দর্ষণের উপরে নিয়ে এলেন।
ReplyDeleteমুল্যবান লেখা। পরবর্তী অংশের অপেক্ষায় থাকলাম
ReplyDeleteআপনাকে অনেক শুভেচ্ছা জানাই।
Delete"অধিকারহীন অবস্থায় পশুর মতো জীবনযাপন করার চেয়ে, অধিকার অর্জনের জন্য প্রাণদান করা অধিকতর গৌরবের"---- বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর ।
ReplyDelete