ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে SOVEREIGN SOCIALIST SECULAR DEMOCRATIC REPUBLI হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। ১৯৭৬ সালের ৪২তম আমেন্ডমেন্টে এই সেকুলার কথাটির ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে যে,
“-ভারতে সরকারী ভাবে কোন বিশেষ ধর্মকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
-জনগণ নিজের পছন্দ মত যে কোন ধর্ম পালন করতে পারেন।
- সরকার কোন ভাবেই কোন বিশেষ ধর্মের প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারী টাকা বরাদ্দ করতে পারবে না।
-সরকার কোন বিশেষ গোষ্ঠীর ধর্মীয় অনুষ্ঠান অথবা উৎসবে অংশগ্রহণ করবে না। ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র তাই এখানে কোন রাজ্যধর্ম নেই। এখানকার জনগণ শান্তিপূর্ণ ও স্বাধীন ভাবে ধর্ম পালন করতে পারবে”।
সংবিধানের এই নির্দেশিকা নির্বাচিত, এমএলএ, এমপি, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, বিচারপতি প্রভৃতি সাংবিধানিক পদাধিকারীদের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। সাংবিধানিক কোন পদে থেকে প্রকাশ্যে বিশেষ কোন ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করা ভারতীয় সংবিধান বহির্ভূত কাজ। এতে সার্বভৌম, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের গরিমা বিনষ্ট হয় এবং জনগণের মধ্যে অসন্তোষের বাতাবরণ তৈরি হয়।
গত ১০ই সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সারা রাজ্যের দুর্গাপূজা কমিটিগুলির জন্য রাজকোষ থেকে ২৮কোটি টাকা বরাদ্দ করার জন্য নানা মহলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে জনগণের টাকা উন্নয়নের কাজে ব্যয় না করে কেন উৎসবের আবেগে উড়িয়ে দেওয়া হল? বিগত দিনে যেখানে এই উৎসব কমিটিগুলিই তাদের বরাদ্দ টাকার একটি অংশ মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করত সেখানে উল্টে তাদেরকেই জনগণের টাকা দেওয়া হল কেন? প্রশ্ন উঠেছে একটি সাংবিধানিক পদে থেকে মুখ্যমন্ত্রী জনগণের টাকা এভাবে ওড়াতে পারেন? প্রশ্ন উঠেছে কেন তিনি একটি সাংবিধানিক পদের গরিমাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে দুর্বিনীতের মত সংবিধান লঙ্ঘন করলেন?
https://www.google.com/url?sa=t&rct=j&q=&esrc=s&source=web&cd=6&cad=rja&uact=8&ved=2ahUKEwiD2o-e_fDdAhUP3o8KHUeZBKQQwqsBMAV6BAgHEAc&url=https%3A%2F%2Fwww.youtube.com%2Fwatch%3Fv%3DxCDgak7tu2c&usg=AOvVaw3jvaqHuxj-GuI2ZgrXP4MA
বাংলার জনগণ শঙ্কিত! যেখানে মুখ্যমন্ত্রীর সংবেদনশীলতা নিয়ে মানুষ গর্বিত হবেন, যেখানে মুখ্যমন্ত্রীর ধর্মনিরপেক্ষতা হবে প্রশ্নাতীত সেখানে এই ভাবে সংবিধানের নির্দেশিকাকে কার্যত বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তিনি যা করলেন তা ফ্যাসিবাদের নামান্তর। তার এই অসাংবিধানিক, অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের ফলে বিভিন্ন পূজা কমিটির বিজ্ঞাপনকে প্রভাবিত করেছে। তাদের প্রচারে এসেছে হিংস্রতা। তারা শহরের মোড়ে মোড়ে বিজ্ঞাপন দিয়ে দুর্গাপূজাকে নরহত্যালীলার প্রদর্শনীতে পরিণত করে ফেলেছে “বঙ্গাসুর বধ”এর নামে সমস্ত বঙ্গবাসীকে চরম অপমান করেছে।
এমনি এক হত্যার বিজ্ঞাপন দিয়েছে বেহালা বুড়ো শিবতলা দুর্গাপূজা কমিটি। এই পূজা কমিটির সভাপতি শ্রী শুভাশীষ চক্রবর্তী, মাননীয় সাংসদ, রাজ্যসভা। পূজা কমিটির চেয়ারম্যান হলেন শ্রী পার্থ চ্যাটার্জী, মাননীয় উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী এবং মূখ্য আহ্বায়ক হলেন শ্রী দিলীপ মণ্ডল বিধায়ক, বিষ্ণুপুর তপঃ বিধানসভা কেন্দ্র। এঁরা প্রত্যেকেই সরকারের অংশ এবং সাংবিধানিক পদে আসীন। আমরা ধরে নিতে পারি যে, বেহালা বুড়ো শিবতলা পূজা কমিটির এই “বঙ্গাসুর বধ” এর বিজ্ঞাপনেও এনাদের সম্মতি আছে এবং আজো দুর্গা পূজার নামে এই অসুর হত্যাকে জনসমক্ষে প্রদর্শন করতে এনারা বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেন না।
বিজ্ঞাপন দেবার আগে এইসব সাংবিধানিক পদে আসীন থাকা মাননীয়গণ কি বিচার করে দেখেছেন কে এই বঙ্গাসুর? কেন আজ বঙ্গের ৯০% দলিত-বহুজন মানুষ তাদের মহান রাজাকে অন্যায় ভাবে হত্যা করার জন্য ক্রমশ প্রতিবাদী হয়ে উঠছে?
সাঁওতালী ভাষায় “বঙ্গা” শব্দের অর্থ পবিত্র সত্তা। যে দেশে মাটি উর্বর, জল, বাতাস, আলো এবং সুনীল আকাশ বিরাজমান সে দেশ “বঙ্গা দিশম”। বঙ্গা দিশমের ভাষা অসুর ভাষা। “মঞ্জুশ্রীমূলকল্প” গ্রন্থে পরিষ্কার বর্ণিত হয়েছে “অসুরানাং ভবেৎ বচা গৌড়পুন্ড্রোদ্ভবা সদা”।
বর্তমানে সাঁওতাল, কোল-মুন্ডা, শবর, অসুর প্রভৃতি ৪০টি জনজাতি, চন্ডাল, পৌণ্ড্র, বাগদী, ডোম, ভূমিজ, রাজবংশী প্রভৃতি ৬০টি জাতি এবং ১৪২টি ওবিসি জাতি সকলেই এই অসুরভাষী মানুষ। এদেরই আদিপুরুষ এই বঙ্গাসুর। যিনি সাঁওতাল সমাজে হুদুড় দুর্গা নামে পূজিত হন। যে রাজাকে দেবী নামে এক ছলনাময়ী নারী অন্যায় ভাবে হত্যা করেছিলেন। যিনি এখন দেবী দুর্গানামে পূজিত হন। সাঁওতালেরা এই সময় দাসায় বা অশৌচ পালন করেন। ভুয়াং নাচের মাধ্যমে গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে তাদের হারিয়ে যাওয়া রাজাকে খুঁজে বেড়ান।
২০১১ লোকগণনা অনুসারে ভারতের ৭৭টি জেলায় ৩২ হাজারের থেকে বেশি অসুর আদিবাসী বসবাস করেন। ঝাড়খণ্ডে এই আদিবাসীদের সংখ্যা ২০হাজারের থেকে বেশি। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার চাবাগান অঞ্চলে বসবাস করেন প্রায় ৪হাজার অসুর জাতির মানুষ। এই মানুষেরা বঙ্গাসুর বা মহিষাসুরকে তাদের পূর্বপুরুষ মনে করেন। তারাও মনে করেন যে বর্তমানে যে দুর্গা ব্রাহ্মণ দ্বারা পূজিত হন তিনি অন্যায় ভাবে তাদের রাজাকে হত্যা করেছিলেন। তারা দেবী দুর্গার মুখ দর্শন করেন না। “বঙ্গাসুর বধ”এর এই বিজ্ঞাপন এই আদিম জনজাতি এবং অসুরভাষী সমস্ত মানুষকে অপমানিত করেছে।
দুর্গা মহিষাসুর এখন একটি জাতীয় আলোচ্য বিষয়। রোহিত ভেমূলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যাকান্ডের পরে দিল্লীর জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের তুমুল প্রতিবাদের বিষয়কে আক্রমণ করার জন্য মাননীয়া স্মৃতি ইরানী রাজ্যসভায় দুর্গা-মহিষাসুরের প্রসঙ্গ টেনে আনেন। তিনি দাবী করেন যে, জেএনইউর প্যামপ্লেটে দুর্গাকে যৌনকর্মী এবং মহিষাসুরকে ন্যায়পালক রাজা হিসেবে দেখানো হয়েছে। সংসদের মধ্যে তুমুল বিতর্কে স্মৃতি ইরানী পর্যুদস্ত হন কিন্তু এই বিতর্কের মধ্যে দেশের মানুষ দুটি সংঘর্ষরত শ্রেণীতে বিভাজিত হয়ে পড়েন। একটি দেশীয় সংস্কৃতি ধ্বংসকারী, আক্রমণকারী, নরহত্যাকারী “দুর্গা বাহিনী” এবং অন্যটি দেশের স্বাতন্ত্রতা, সম্মান এবং সংস্কৃতির রক্ষাকারী “মহিষাসুর ব্রিগেড”।
বাংলার মূখ্যমন্ত্রী জ্ঞাতে হোক বা অজ্ঞাতে হোক এই নরহত্যাকারী দুর্গাবাহিনীর পক্ষ নিয়েছেন। হিংস্র ব্রাহ্মন্যবাদের প্রচারক হয়ে উঠছেন। সংবিধানের নির্দেশিকাকে উপেক্ষা করে জনগণের টাকা সেই সব ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বরাদ্দ করেছেন যেখানে অসুরভাষী মানুষকে হত্যা করার প্রোরচনা দেওয়া হচ্ছে। এটা বাংলার কাছে লজ্জা। বঙ্গবাসীর প্রতি চরম অপমান।
পুনশ্চঃ ৩দিন ধরে "বঙ্গাসুর বধ" এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন খবরের কাগজে এই প্রতিবাদপত্র পাঠালেও কোন কাগজই এই পত্রটি প্রকাশ করতে সাহস দেখায় নি। গতকালই কোলকাতা হাইকোর্ট এই অনুদানের উপর স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। কিন্তু ধর্মের নামে পুজার অছিলায় বাংলার মূখ্যমন্ত্রী এবং তার দলের নেতারা যে ভাবে বঙ্গবাসীকে খুনের হুমকি দিয়েছেন তার নিন্দা করা হয় নি।
No comments:
Post a Comment