সম্প্রতি প্রণব মুখার্জির সাথে আরএসএস বা সঙ্ঘ পরিবারের ঘনিষ্ঠতা নিয়ে ভারতীয় রাজনীতিতে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৮ সালের ৭ই জুন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মূখ্য কার্যালয় নাগপুরের একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে প্রধান বক্তা হিসেবে তার যোগদান ভারতীয় রাজনীতির এক বিশেষ অধ্যায় হিসেবে অনেকে বর্ণনা করছেন। দীর্ঘকাল কংগ্রেস শিবিরের অত্যন্ত একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন প্রণব বাবু। অলক্ষ্যে থেকে কংগ্রেসের আভ্যন্তরীণ ঝড়ঝাপটা অনেকটাই সামলেছেন তিনি। গান্ধী পরিবারের নম্র সহচর হয়ে নিঃশব্দে উঠে এসেছেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অলিন্দে। ২০১২ সালে কংগ্রেসের মনোনীত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হয়ে তিনি বিজেপির মনোনীত প্রার্থী পিএ সাংমাকে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত করে ভারতের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন এবং দক্ষতার সাথে সামলেছেন ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিকের পদ। এহেন প্রণব মুখার্জির নাগপুরাভিমুখি প্রবণতা দেখে ভারতীয় রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা চঞ্চল হবেনতো বটেই চমৎকৃতও হবেন! তাঁদের বিশ্লেষণে উঠে আসবে নানান তথ্য। সঙ্ঘ পরিবারের প্রধানরাও নানা গোপন তথ্য প্রকাশ করে প্রণব বাবুর সাথে তাঁদের দীর্ঘ সম্পর্কের সূত্রতা উজাড় করে তুলে ধরবেন। প্রবল উত্তেজনায় ভারতের অধিকাংশ রাজনৈতিক সচেতন মানুষ উদগ্রীব হয়ে শুনতে চাইবেন ৮২ বছর অতিক্রান্ত প্রণব মুখার্জির অন্তিম অভিপ্রায়।
সম্প্রতি গুজরাটের বিধান সভা নির্বাচন থেকে মোদি ম্যাজিক ফিকে হয়ে যাচ্ছে বলে কানাঘুষো চলছিল আরএসএস এর অভ্যন্তরে। এলকে আদবানী, মুরলী মনোহর যোশী, উমা ভারতী, সুষমা স্বরাজ, যশবন্ত সিনহা, শত্রুঘ্ন সিনহার মত একঝাক সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ নেতা দীর্ঘদিন থেকে অকেজো। মোদি এবং অমিত শাহ রেজিমেন্টের ধারের কাছে নেই দ্বিতীয় সারির কোন নেতা। ইতিমধ্যেই নোটবন্দির ধাক্কায় মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে পঙ্গু। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশিকায় চলছে অঘোষিত জরুরী অবস্থা। সঙ্ঘ চালকেরা আশাবাদী। তারা প্রায় সকলেই ভেবে নিয়েছিলেন যে এই জুটিকে দিয়েই সম্পন্ন হবে হিন্দুত্বের মহান উত্থান। এদেরকে অশ্বমেধের ঘোড়ার মত ব্যবহার করে এসসি, এসটি, ওবিসি এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আবার চতুর্বর্ণের খোঁয়াড়ে পোরা যাবে। এসসি এসটিদের জন্য বিশেষ আইন এবং সংবিধান ধ্বংস করে মনুর শাসন লাগু করা যাবে। হিন্দু আবেগের উন্মাদনায় প্রতিষ্ঠিত করা যাবে কাঙ্ক্ষিত রামরাজ্য। কূটনীতি হোক বা দুর্নীতি হোক যে কোন ভাবে রাজ্যগুলিকে তাবে এনে একেবারে পৌরাণিক মোড়কে অভ্যুত্থান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
Advertisement
tdn_bangla_ads
অভ্যুত্থানের এই পরিকল্পনাকে সামনে রেখেই রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা হয়। জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হারিয়ে যায় নাজিব। স্বতন্ত্র মত প্রকাশের জন্য কালবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশদের হত্যা করা হয় । গোটা দেশ জুড়ে শুরু হয় গোরক্ষার নামে তান্ডব। বীভৎস ভাবে হত্যা করা হয় জুনায়েদ এবং আফরাজুলকে। সারা দেশে দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে দেবার জন্য শোনা যায় অস্ত্রের আস্ফালন। রাম নবমী, হনুমান জয়ন্তী, রানা প্রতাপ জয়ন্তী পালনের নামে শুরু হয় জিঘাংসা। এই জিঘাংসা দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা।
ক্রিয়ার বিপরীতে প্রতিক্রিয়ার মতই প্রতিরোধ দানা বাঁধতে শুরু করে। রোহিতের মৃত্যুতে গর্জে ওঠে ছাত্র সমাজ। দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে সোচ্চার প্রতিবাদ। উনার গোরক্ষকদের তাণ্ডবের বিরুদ্ধে দলিত-মুসলিম সমাজ এক হয়ে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করাতে বাধ্য করে। উত্তরপ্রদেশের দাঙ্গাবাজ রাজপুত সেনাদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে ভীম সেনা। মহারাষ্ট্রের ভীমা কোরেগাওয়ের তান্ডবের বিরুদ্ধে দলিত-বহুজন মানুষ স্তব্ধ করে দেয় গোটা মহারাষ্ট্র। এসসি এসটি (প্রিভেনশন ওফ অ্যাট্রোসিটি) অ্যাক্ট ১৯৮৯ লঘু করার বিরুদ্ধে ২রা এপ্রিল দলিত বহুজন মানুষের ডাকা বন্ধে অচল হয়ে যায় দেশের ১৮টি রাজ্য। দলিত-বহুজনের এই আক্রোশ উপনির্বাচনগুলিকেও প্রভাবিত করে। গোরক্ষপুর সহ বহু কেন্দ্র হাতছাড়া হয়ে যায় বিজেপির। সম্প্রতি কর্ণাটকের নির্বাচনে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে উঠে আসলেও ফ্লোর টেস্টের আগেই ইস্তফা দেবার জন্য বিধান সভা ছাড়তে হয় ইয়াদুরাপ্পাকে।
দলতি-বহুজনের এই প্রত্যাঘাত এবং নির্বাচনগুলির সার্বিক ফলাফল বিজেপির বিরুদ্ধে চলে যাওয়াতেই চিন্তিত হয়ে পড়ে সঙ্ঘ পরিবার। কর্ণাটকে কুমারস্বামীর মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে সমস্ত বিরোধী শিবিরকে একত্রিত হতে দেখে শঙ্কিত হয়ে পড়েন তাঁরা। সঙ্ঘ চালকেরা বুঝতে পারেন মোদি এবং অমিত শাহকে ২০১৯ এর সাধারণ নির্বাচনের কাণ্ডারি করলে বিরোধীদের আক্রমণের ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে কালাধন এবং সুইস ব্যাঙ্কের টাকা। প্রশ্ন আসবে প্রতিবছর ২কোটি চাকরি প্রতিশ্রুতি নিয়ে। আমিত শাহ এবং মোদির পকোড়া প্রকল্প শিক্ষিত বেকারদের উদ্বেগ সামলাতে পারবে না। বুমেরাং হয়ে ফিরে আসবে নোটবন্দির নামে ভারতীয় খাজানা লুট প্রসঙ্গ। প্রশ্ন উঠবে প্রত্যেক অ্যাকাউন্টে ১৫লক্ষ টাকার প্রতিশ্রুতি নিয়ে। আদানী, আম্বানী, বিজয় মাল্য, ললিত মোদি, নীরব মোদি, আশারাম, রামদেব, রামরহিমদের কেচ্ছা নিয়ে বিরোধীরা যে ভাবে আসরে নামবে তা সামলানো দুষ্কর হয়ে দাঁড়াবে তাঁদের। তাছাড়া জিগনেশ মেবানী, হার্দিক প্যাটেল, কানাইয়া কুমার, উমর খলিদ, অখিলেশ যাদব, তেজস্বী যাদব এবং রাহুল গান্ধির মত বিরোধী শিবিরের একঝাঁক উচ্চশিক্ষিত যুবক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে ঠেঙ্গাড়ে গোরক্ষক বাহিনী দিয়ে সামাল দেওয়া যাবে না। এই যুবনেতারা ক্রমবর্ধমান ভারতের অর্থনীতির অধঃপতন, বেকারত্ব, কৃষক-মজদুরদের দুর্দশা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, পানীয় জলের সমস্যা, বিদেশ নীতি এবং শিল্পনীতি নিয়ে বিজেপিকে এমন ভাবে নাস্তানাবুদ করে ছাড়বেন যে পুরানো নেতাদের দ্বারা তা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। তাছাড়া পুরানো নেতাদের জবাবদিহি ভারতের জনগণের কাছে বিশ্বস্ত হয়ে উঠবেনা। বিজেপি শিবিরে এমন কোন যুবক নেতা নেই যিনি আতঙ্কিত ভারতবাসীকে আশ্বস্ত করতে পারেন এবং নিজের করিশ্মা দেখিয়ে ভারতবাসীদের আবেগ চালিত করে নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে পারেন।
তাই ৮২ বছরের প্রনব মুখার্জিকে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ শিবিরের প্রধান বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ। তাঁর নম্র মুখের ঐকান্তিক অভিলাষ সঙ্কট কালের পাথেয় হতে পারে। অথবা তাঁকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মারা যেতে পারে এক ঢিলে তিন পাখি।
কথা উঠছে প্রনব মুখার্জী কেন অন্তিম কালে সঙ্ঘ শিবিরে গিয়ে “জয় শ্রীরাম” ধ্বনিতে শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করবেন? একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও কেন তিনি রামরাজ্য বা হিন্দু রাষ্ট্রের পক্ষে বক্তব্য রাখবেন? তাঁর মত ব্যক্তিত্বের আভ্যন্তরীণ আচরণের মধ্যে কী এমন উপাদান রয়েছে যে জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে তিনি তাঁর অন্তিম অভিলাষ পূর্ণ করতে চান? আরএসএস শিবির কিন্তু এমন কথাই দাবী করছে। তাঁরা বিবৃতি দিয়ে দাবী করছেন যে মাননীয় প্রনব মুখার্জী রাষ্ট্রপতি থাকা কালীনই সঙ্ঘের সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন করেন। ২০১৫ সালে মোহন ভগতের সাথে রাষ্ট্রপতি ভবনেই দেখা করেন তিনি। আরএসএস রাজ্য দপ্তর থেকে জানানো হচ্ছে যে ২০১৬ সালে সঙ্ঘের প্রতিনিধিরা প্রনব বাবুর বাড়িতে দুর্গা পূজার নিমন্ত্রণ পান। ২০১৭ সালে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে অবসরের এক মাস আগে মোহন ভগত রাইসিনা হিলসে যান এবং মধ্যাহ্ন ভোজন করেন।
নরেন্দ্র মোদি, যোগী আদিত্যনাথ বা অমিত শাহদের নেতৃত্বে সারা ভারতে যে অসন্তোষের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে তাতে বিকাশের পরিবর্তে বিনাশের সম্ভাবনাই বেশি। পাশাপাশি এই বিনাশের বিরুদ্ধে দলতি-বহুজন মানুষ যে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে তা ক্রমশ প্রবলতর শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এই আক্রোশ আরো ঘনীভূত হলে দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। আর এখনই এই গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ব্রাহ্মন্যবাদের পক্ষে তা হবে এক আত্মঘাতী পদক্ষেপ। এর প্রশমন ঘটানোর জন্যই চাই এক সহনশীল নরম প্রকৃতির মানুষ। যার অভয় বাণীতে দেশের জনগণ আশ্বস্ত হতে পারে। যার কূটনৈতিক চালে জনগণ বিজেপির দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ভুলে যেতে পারে এবং যার ধর্ম দেশনায় রক্ষা পেতে পারে ব্রাহ্মন্যবাদ। এখন দেখার ৭ই জুন জাতীর সামনে কী বক্তব্য রাখছেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রনব মুখার্জী? কী তাঁর অন্তিম অভিলাষ!
No comments:
Post a Comment