Photo from Sudra the Rising |
আগ্রাসন, আক্রমণ, জয়, পরাজয় মানবেতিহাসের একটি প্রবাহমান ধারা।
এই ধারার মধ্য
দিয়েই সূচীত হয়েছে বিজেতার সামাজিক উত্তরণ এবং বিজিতের অবনমন। জিঘাংসার
এই প্রদোষকালে বিজেতার প্রবল বিজয় উল্লাসের উচ্চকিত ঢক্কানিনাদে চাপা
পড়ে গেছে বিজিতের হাহাকার। প্রতিকুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার নিস্পত্তি হয়েছে বিজিতের প্রতি বিজেতার প্রবল ঘৃণা ও
অবজ্ঞা দিয়ে যা কালে বিজিতের আত্তপরিচয়ের সাথে স্থায়ী
ভাবে জুড়ে দেওয়া
হয়েছে।
ভারতবর্ষে আর্য অনুপ্রবেশ এবং তাদের উপনিবেশ স্থাপনের একেবারে ঊষালগ্ন থেকেই এই দ্বন্দ্বটি প্রকাশ্যে চলে আসে। আর্যরা ভারতবর্ষের আদি কৌম্যজনদের চিহ্নিত করার জন্য যে শব্দগুলি ব্যবহার করে তা মোটেও এই কৌম্যজনদের কাছে গৌরবআত্মক ছিলনা, বরং এই শব্দগুলির সাথে সাথেই আর্থ সামাজিক ভাবে তাদের ঘৃণিত অবস্থান সূচীত হয়েছিল। বেদের একেবারে প্রথম মণ্ডল থেকেই “দাস”, দস্যু “পণি” “রক্ষস শব্দগুলি ব্যবহার করে আর্যরা আদি কৌম্যজনদের চিহ্নিত করেছেন এবং তাদের আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানকে ঘৃণার যোগ্য বলে বর্ণনা করেছেন। আর্য সমাজ বিস্তার এবং ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের সাথে সাথে এই ঘৃণিত শব্দ ভান্ডারও স্ফীত হতে শুরু করে।
ঋকের ১০ম মণ্ডলের পুরুসুক্ত রচনা
কালে আর্য সমাজের পুনর্বিন্যাস ঘটে। দাস রাজা যারা চতুর্বর্ণ মেনে নেয় তারা “রাজন্য”
পরিচয় লাভ করে শাসনকার্য পরিচালনায় নিয়োজিত হয়। ঘৃণিত পণিরা “বৈশ্য’ পরিচয় লাভ করে এবং
শ্রমের সাথে সম্পৃক্ত দাসেরা “শূদ্র” নামে বর্ণ ব্যবস্থায় একেবারে নিচে জায়গা পায়। শ্রেষ্ঠ হিসেবে এই তিন বর্ণের উপরে বসিয়ে দেওয়া হয় ভূদেবতা ব্রাহ্মণকে। (পুরুসুক্ত, ৯০ শ্লোক)
চাণক্যের অর্থ শাস্ত্রে মোটামুটি পুরুসুক্তের কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রেখে শূদ্রদের মধ্যে বিভাজন ঘটিয়ে আরো উপজাতির সংখ্যা
বাড়ানো চেষ্টা করে।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৫ সালে রচিত
হয় মনুস্মৃতি। মনুস্মৃতি রচনাকার ভৃগু
“রাজন্য” শব্দের পরিবর্তে ক্ষেত্র রক্ষক হিসেবে রাজকুল প্রতিনিধিদের “ক্ষত্রিয়”, চাষ
এবং ব্যবসার সাথে যুক্ত পণিদের “বৈশ্য” হিসেবে বর্ণনা করেন। সমস্যা তৈরি হয় শূদ্রের অবস্থান
নিয়ে। মনুস্মৃতি পরিষ্কার ঘোষণা করে যে, যারা চতুর্বর্ণ স্বীকার করেনা তারা দস্যু। এরা অস্পৃশ্য। আর্য সমাজ ব্যবস্থায় এদের কোন জায়গা নেই। এরা পরিত্যাজ্য এবং বহিষ্কৃত।
মনু চতুর্বর্ণের বাইরে কোন পঞ্চম বর্ণ স্বীকার করেনি। কিন্তু সামজিক অবস্থার মূল্যায়নে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে অনুশাসন থাকা সত্ত্বেও বৃহত্তর সমাজের মধ্যে আরো বিভাজন ঘটে গেছে এবং অসবর্ণ জৈবিক সম্পর্কের কারণে সংকরবর্ণের সৃষ্টি হয়েছে। এই ক্ষেত্র সমীক্ষার ফলে তিনি বিভিন্ন সংকর জাতির কথা উল্লেখ করেন। এই তালিকায় আমরা নিষাদ, অম্বষ্ঠ,
উগ্র, অপসাদ, মাগধ, বৈদেহ, আয়োগাভাস, কাসন্তা, ঝাল্লা, মাল্লা, নট, করণ, খস, দ্রাবিড়া, সুধনভা, আচার্য, কারুসা, বিজম্মা, শতভাত ইত্যাদি নানা ভাগ দেখতে পাই। (মনুস্মৃতি, ১০
অধ্যায়, ১২-৪৫৬
শ্লোক)
এই সংকর জাতির উৎপত্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মনু চণ্ডাল জাতির উল্লেখ করেন। মনু উল্লেখ করেন যে শূদ্র পুরুষের দ্বারা ব্রাহ্মণ নারীর গর্ভে যে সন্তানের জন্ম হয় তাকে চণ্ডাল বলে। (মনুস্মৃতি, ১০ অধ্যায়, ১২
শ্লোক)
আবার এই চণ্ডাল কন্যা
যদি ব্রাহ্মণকে বিয়ে করে এবং সাতপুরুষ ধরে ব্রাহ্মণ বীর্য
ব্রাহ্মণের মধ্যেই
সীমাবদ্ধ থাকে তবে এই চণ্ডাল রক্ত পরিশুদ্ধ হয়, তখন
সেই সন্তানকে পারশব ব্রাহ্মণ বা দেবল ব্রাহ্মণ বলে। (মনুস্মৃতি, ১০ অধ্যায়, ৬৪
শ্লোক)
এখানে বলে রাখা ভাল যে মনুর বিধান হল একটি দীর্ঘস্থায়ী অনুশাসন ব্যবস্থা যা শক, হুন, পাঠান, মোগল প্রভৃতি শাসন কালেও অটুট ছিল। সামাজিক এবং কূটনীতিক কৌশল অবলম্বন করে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্যরা মুসলমান শাসন কালেও তাদের পদাধিকার ও সামাজিক উচ্চতা বজায় রেখেছে এবং শূদ্র সমাজকে ভেঙ্গে কয়েক হাজার জাতের সৃষ্টি করেছে।
মনুর এই সামাজিক ব্যবস্থা ধাক্কা খায় ব্রিটিশ ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেয়ানী লাভের পরে। কোম্পানি
তার ব্যবসা বৃদ্ধি করার জন্যই বহিষ্কৃত জনপুঞ্জ বা আদি কৌম্যজনদের মধ্য থেকেই বলিষ্ঠ পুরুষদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করে। এদের সম্মিলিত শক্তির কাছে পরাজিত হয় মোগল এবং তাদের তাবেদার ব্রাহ্মন্যবাদী শক্তি। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনীতে কাজের সুবাদে সৈনিকদের সন্তান সন্ততিরা মিশনারি বিদ্যালয়ে পড়াশুনার সুযোগ পায় এবং উচ্চ শিক্ষিত হয়ে সমাজ সচেতন হয়ে ওঠে।
দলিত শব্দের নির্মাতা জ্যোতিরাও ফুলেঃ
মাহামানব জ্যোতিরাও ফুলে এই যুগ সন্ধিক্ষণের এক কালজয়ী পথিকৃৎ। তিনি শূদ্র সমাজের সন্তান। জাতে মালি। উচ্চ শিক্ষিত, বজ্রকঠিন দৃঢ়তা কিন্তু কোমল হৃদয়ের মানুষ। মানুষে মানুষে বিভেদ এবং অসাম্য তিনি মেনে নিতে পারেননি। মেনে নিতে পারেননি ছোঁয়াছুঁয়ি এবং জাত বিচার। ব্রাহ্মন্যবাদী জাতপাতকে গুড়িয়ে
দিয়ে সমস্ত নিপীড়িতজনদের একটি কোমে নিয়ে আসাই ছিল তার সাধনা। স্বপন ছিল জাত
মুক্ত একটি পরিশুদ্ধ জাতির ভিত্তি
স্থাপনের। সত্যশোধক সমাজের মধ্য দিয়েই তিনি বঞ্চিত, নিপীড়িত, শোষিত জাতিকে ব্রাহ্মন্যবাদী শাসনের
গ্লানি থেকে মুক্ত করার প্রবল
আন্দোলন শুরু করেন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি সহস্র খন্ডিত জাতিকে মারাঠি শব্দ “দলিত” নামে অভিহিত করে ব্রাহ্মন্যবাদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। গোলামগিরি নামক গ্রন্থের মাধ্যমে ব্রাহ্মন্যবাদের অসাড়তা ও মিথ্যাচারকে ব্যাঙ্গের চাবুকে জর্জরিত করে তোলেন। তাঁর আন্দোলনকে আরো তীব্রতর করে তোলার জন্য এগিয়ে আসেন তাঁর সহধর্মিণী মা সাবিত্রী ফুলে। দলিতদের উজ্জীবিত করার জন্য তিনি শ্লোগান তোলেন “সবিত্রী ফুলে কি কহনা হ্যায়, শের বনকে রহনা হ্যায়”। নারীর স্বাধিকার আন্দোলনকে বাস্তবে রুপদান করার জন্য আহ্বান জানান, “হাম ভারত কি নারী হ্যায়, ফুল নাহি চিঙ্গারী হ্যায়”।
গুরুচাঁদ দলিতবহুজন শব্দের অন্যতম নির্মাতাঃ
গুরুচাঁদ ঠাকুর অবিভক্ত বাংলার দলিত আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। বাংলার উচ্চ বর্ণের দ্বারা সংঘটিত স্বদেশী আন্দোলন চলা কালে বিদেশী পণ্য বর্জনের জন্য নিদারুণ নিপিড়নের শিকার হয় মুসলিম এবং অন্ত্য বর্ণের মানুষেরা। বাংলার চন্ডালেরা এই পণ্য বর্জনের বিরুদ্ধে মুসলিম জনগণকে সমর্থন করে এবং যৌথভাবে
আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯০৫ সালে গুরুচাঁদের নেতৃত্বে নমশূদ্র এবং মুসলমানের যৌথ প্রচেষ্টায় প্রতিহত করা হয় বর্ণ হিন্দুদের বর্বর আক্রমণ। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ই গঠিত হয় “দলিত মুসলিম ইউনাইটেড ফ্রন্ট”। এই শক্তিকে চুরমার করতেই ব্রাহ্মন্যবাদীরা জাতির উন্নয়নের অছিলায় হিন্দুত্বের শ্লোগানকে সামনে নিয়ে আসে এবং বাঙালীর মধ্যে ধর্মের জিগির তুলে দাঙ্গার
আগুন জ্বালাতে শুরু করে।
১৯১৯ সালে পাশ করা হয় গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট। এখানে বাংলার আইন সভার জন্য একজন ‘ডিপ্রেসড ক্লাস” প্রতিনিধি রাখার বিধান রাখা হয়। এই “ডিপ্রেসড ক্লাস” কথাটির বাংলা অর্থ অনেকটাই “দলিত” শব্দের কাছাকাছি। গুরুচাঁদ একেবারে সচেতন ভাবেই “বহুজন” এবং “দলিত” শব্দ ব্যবহার করে তাঁর ভাবনাকে আপামর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন।
“নমশূদ্রেকুলে জন্ম হয়েছে আমার।
তবু বলি আমি নহি নমোর একার।।
দলিত পীড়িত যারা দুঃখে কাটে কাল।
“নমশূদ্রেকুলে জন্ম হয়েছে আমার।
তবু বলি আমি নহি নমোর একার।।
দলিত পীড়িত যারা দুঃখে কাটে কাল।
ছুঁসনে ছুঁসনে বলে যত জলচল।।
শিক্ষা হারা দীক্ষা হারা ঘরে নাহি ধন।
এই সব জানি আমি আপনার জন”।। (গুরুচাঁদ চরিত, ১৪৪)
এই সব জানি আমি আপনার জন”।। (গুরুচাঁদ চরিত, ১৪৪)
দলিত শব্দকে প্রচারের আলোয় নিয়ে আসেন বাবাসাহেব আম্বেদকরঃ
গান্ধীজী ভারতের দলিত সমাজকে “হরিজন” বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তাঁর এই “হরিজন” শব্দ আরোপের মধ্যে ছিল গভীর ষড়যন্ত্র। প্রকৃত পক্ষে হরিজন একটি দ্রাবিড় শব্দ যার আসল অর্থ হল পিতৃপরিচয়হীন ব্যক্তি। গান্ধীর এই আরোপিত শব্দ বাবাসাহেব মেনে নিতে পারেন নি। তাঁর ব্যখ্যা ছিল গান্ধী আসলে পেছন থেকে ছুরি মারার চেষ্টা করছেন। গান্ধীর হরিজন মেনে নেওয়া আসলে হিন্দু বর্ণ ব্যবস্থাকেই মেনে নেওয়ার সামিল।
কম্যুনিস্টদের দেওয়া “প্রলেতারিয়েত” শব্দও বাবাসাহেবের কাছে গ্রহণ যোগ্য মনে হয়নি। তিনি বুঝে ছিলেন প্রলেতারিয়েত শব্দ দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছন যাবে না। তিনি দীর্ঘদিন থেকেই যে একটি মানান সই শব্দ খুঁজে চলেছিলেন তা বুঝতে পারা যায় বিভিন্ন শব্দ ব্যবহার করে তাঁর দর্শনকে প্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে। তাঁর “মূকনায়ক” এবং “বহিষ্কৃত ভারত” স্বতন্ত্র পরিচয় খোঁজার একটি অনন্য প্রয়াস। “বহিষ্কৃত ভারতে”ই তিনি দলিত শব্দের প্রকৃত অর্থ
বর্ণনা করেছেন। তিনি
বলছেন, “….dalithood
is a kind of life condition which characterize the exploitation , suppression
and marginalization of Dalits by the social, economic, cultural and political
domination of the upper castes”.
যদিও তিনি তাঁর অন্যান্য লেখায়
দলিত শব্দ ব্যবহার করেননি বরং
‘ডিপ্রসড ক্লাস” কথাটি বেশি ব্যবহার করেছেন। আম্বেদকরকে সামনে রেখে ১৯৫৬ সালের ডিসেম্বরে আয়োজন করা হয়েছিল প্রথম দলিত সাহিত্য সম্মেলন। অস্পৃশ্য জাতির বিশিষ্ট সাহিত্যিক আন্না ভাউ সাঠেকে এই সম্মেলনের সভাপতি করা হয়। আন্না ভাউ সাঠের সাথে শঙ্কররাও খরাট, বাবুরাও বাগুলের মত স্বনাম ধন্য দলিত সাহিত্যকেরা এই সম্মেলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। আকস্মিক ভাবে বাবাসাহেবের মহাপরিনিব্বানের কারণে এই সম্মেলন পিছিয়ে যায়। সম্মেলন হয় ১৯৫৮ সালে। এই সম্মেলনে জ্যোতিরাও ফুলেকে দলিত আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সম্মেলনে বলা হয় যে, জ্যোতিরাও ফুলেই প্রথম ব্যক্তি যিনি দলিত সাহিত্যের সূচনা ঘটিয়েছেন।
দলিত প্যান্থারঃ
১৯৭২ সালের ৯ই জুলাই নামদেও ধাসাল, অর্জুন
ডাংলে, জে ভি পাওয়ার, দয়া পাওয়ার, উমাকান্ত
রণধীর, রামদাস সোরতে অ্যামেরিকার ব্লাক প্যান্থার আন্দোলনের নিরিখে “দলিত প্যান্থার” গঠন করেন। দলিত প্যান্থারের সর্বাত্মক আন্দোলন দলিত শব্দকে সর্বব্যাপি করে তোলে। সাম্প্রতি জার্মান দলিত সলিডারিটি ফোরামের সাথে মত
বিনিময় করে আমরা জানতে পারি যে ইয়োরোপের প্রায় অধিকাংশ দেশে দলিত সলিডারিটি ফোরাম গড়ে উঠেছে। তাই “দলিত” শব্দটি এখন সর্বব্যপি একটি আন্তর্জাতিক শব্দ যার মধ্য দিয়ে বঞ্চিত মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তি সুনিশ্চিত করছে।
প্রসঙ্গ হিন্দু
এবিষয়ে বাবা সাহেব Dr.
B.R AMBEDKAR ,ANNIHILETION OF CASTE এ বলেছেন-
The first
and foremost thing that must be recognized is that Hindu Society is a myth. The
name Hindu is itself a foreign name. It was given by the Mohammedans to the
natives for the purpose of distinguishing themselves. It does not occur in any
Sanskrit work prior to the Mohammedan invasion. They did not feel the necessity
of a common name because they had no conception of their having constituted a
community. Hindu society as such does not exist. It is only a collection of
castes.’
হিন্দু শব্দের প্রথম উল্লেখ পাই ৭১২ খৃষ্টাব্দে মহম্মদ বিনকাশেমের সময় থেকে।বিনকাশেম ভারতের ব্রাহ্মণদের উদ্দেশ্যে এই হিন্দু শব্দ উচ্চারন করেছিলেন।অন্যদিকে যারা মহৎ এবং কর্তব্যপরায়ণ তাদের চামার বলে উল্লেখ করেছিলেন। ১১৯২ সালে তরাইয়ের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজ চৌহানকে পরাজিত করার পর মহম্মদ ঘোরি হিন্দু শব্দকে জাতি এবং হিন্দুস্থানকে দেশ হিসবে সার্বজনীন করে তোলেন।
উল্লেখ থাকে যে পার্সিয়ান অভিধান লুঘেত-ই-কিস্বরীতে হিন্দু শব্দের অর্থ করা হয়েছে “চোর” “ডাকু” “রাহাজান” এবং “গুলাম” হিসেবে। আর একটি অভিধান উর্দু-ফিরোজ-উল-লাঘট এ হিন্দু শব্দের অর্থ করা হয়েছে “বারদা” বা চাকর এবং “সিয়া ফাম” বা কালা আদমি হিসেবে।
উল্লেখ থাকে যে পার্সিয়ান অভিধান লুঘেত-ই-কিস্বরীতে হিন্দু শব্দের অর্থ করা হয়েছে “চোর” “ডাকু” “রাহাজান” এবং “গুলাম” হিসেবে। আর একটি অভিধান উর্দু-ফিরোজ-উল-লাঘট এ হিন্দু শব্দের অর্থ করা হয়েছে “বারদা” বা চাকর এবং “সিয়া ফাম” বা কালা আদমি হিসেবে।
অর্থাৎ মুসলমান আক্রমণের সময় কালে “হিন্দু” জাতি হিসবে গড়ে উঠলেও ধর্ম হিসেবে গড়ে ওঠেনি। ব্রাহ্মণগণ তাদের নানা গ্রন্থে ধর্ম কথাটি বার বার উল্লেখ করলেও সমগ্র ভারতবাসীদের জন্য একটি জাতিসত্ত্বা বা নির্দিষ্ট ধর্ম গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। মুসলমান শাসকগণই “তামাম হিন্দুস্থান” নামকরণের মাধ্যমে এই জাতিসত্ত্বা প্রতিষ্ঠিত করে দেন।
সেই অর্থে “আর্য ধর্ম” বা “ব্রাহ্মণ ধর্ম” বলতে যা অনুসরণ করা হত তা ছিল সাম-দাম-দন্ড-ভেদ রক্ষা করার পক্ষে কিছু অনুশাসন। একে ধর্ম না বলে ব্রাহ্মন্যবাদী রাজনৈতিক বিধান বলাটাই যুক্তিযুক্ত হবে। এই বিধানগুলি গড়ে উঠেছিল বেদ, অর্থশাস্ত্র এবং মনুস্মৃতিকে কেন্দ্র করে।
১৮৭৩ সালে জ্যোতি রাও ফুলের “সত্য শোধক সমাজ”কে কাউন্টার করে ১৮৭৫ সালে দয়ানন্দ সরস্বতী “আর্য সমাজ” গঠন করলেও নিজেদের হিন্দু বলে স্বীকার করেন নি এবং ধর্মকে হিন্দু ধর্ম বলে উল্লেখ করেন নি।
১৮৭৩ সালে জ্যোতি রাও ফুলের “সত্য শোধক সমাজ”কে কাউন্টার করে ১৮৭৫ সালে দয়ানন্দ সরস্বতী “আর্য সমাজ” গঠন করলেও নিজেদের হিন্দু বলে স্বীকার করেন নি এবং ধর্মকে হিন্দু ধর্ম বলে উল্লেখ করেন নি।
তার আগে ১৮২৮ সালে রাজা রামমোহন রায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘ব্রাহ্ম সমাজ’।
1922 সালে নাসিকে ‘হিন্দু মহাসভা’ এর স্থাপন করার পরে এই হিন্দু ধারনার প্রসার হতে শুরু করে।
হিন্দু রাজনীতির নেপথ্য ইতিহাসঃ
1917-18সাল নাগাদ ইংল্যান্ডে প্রাপ্ত
বয়ষ্কের ভোটাধীকারের
আন্দোলন শুরু
হয় । কারন
ইংলন্ডেও সকল
প্রাপ্ত বয়ষ্কদের
ভোটাধীকার ছিল
না । এই আন্দোলন ব্রাহ্মন্যবাদীদের কাছে একটি বিপদ সংকেত ব্যে নিয়ে আসে। বিপদটা এই যে ইংলন্ডে প্রাপ্ত বয়ষ্কের ভোটাধীকার
চালু হলে তা ভারতেও কার্যকরী হবে।
প্রাপ্তবয়ষ্কদের ভোটাধীকার আইন
লাগু হলে ভাগিদারী অনুপাতে 85% SC, ST, OBC রাজ ক্ষমতা দখল করে নেবে। ভাগিদারী অনুপাতে ব্রাহ্মণের অংশ হবে মাত্র ৩.৫%। ফলে ব্রাহ্মন্যবাদ নামক যে অনুশাসন হাজার হাজার বছর ধরে চলে আসছে তা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু হিন্দু নামের
সংগঠন হলে নেতৃত্বের জোরে সমস্ত SC,ST, OBC দের তাবে রাখা সহজ হবে এবং জাতির নামে ব্রাহ্মণ্য শাসন কায়েম করা সহজ হবে। এই ভাবনাকেই কার্যকরী করার জন্য হিন্দুত্বের জাল বিছানো হয় এবং 1922 সালে
নাসিকে ‘হিন্দু মহাসভা’
এর স্থাপন করা হয়। হিন্দুত্বকে এক রাষ্ট্রবাদে রূপান্তরিত করার জন্য ১৯২৫ সালেই গঠন করা হয় আরএসএস নামে স্বয়ং সেবক বাহিনী। কংগ্রেস এবং এই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির গোপন আঁতাত এবং ষড়যন্ত্রের কারনেই হিন্দুকে জাতি থেকে ধর্মে পরিণত করার খেলা শুরু হয়। জহরলাল নেহেরুর সময় থেকেই ভারতীয় লোক গণনায় হিন্দুধর্ম নামক বিশেষ কোডের মধ্যে জাতিগুলিকে ঢুকিয়ে দিয়ে পাকাপাকি ভাবে ব্রাহ্মন্যবাদী চতুর্বর্ণ ব্যবস্থাকে হিন্দুকে ধর্মে রূপান্তরিত করা হয়। বর্ণশ্রেষ্ঠ হিসেবে ব্রাহ্মণগণ হয়ে ওঠে এই ধর্মের চালিকা শক্তি।
হিন্দুত্ব দলিত-বহুজনের স্বাধিকারের পরিপন্থীঃ
“গর্ব করে বল আমি হিন্দু” এই শ্লোগানের নামে যে উগ্র ভাগুয়া সন্ত্রাসের জিগির তোলা হচ্ছে তার সাথে জাতীয়তাবাদ বা বিবিধের মাঝে মিলনের কোন সম্পর্ক নেই। আসলে এই হিন্দুত্ববাদ হিংস্র মনুবাদেরই পুনর্জাগরণ। কেন্দ্রে একটি চরম মনুবাদী সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সাথে সাথে এই সাম-দাম-দণ্ড-ভেদের নীতি একেবারে প্রকাশ্য আলোয় চলে এসেছে।
ব্রাহ্মন্যবাদ কখনোই সাম্য এবং বৈচিত্রের মধ্যে সহাবস্থান মেনে নেয় না। ব্রাহ্মন্যবাদ মনুর শাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত যেখানে দলিত-বহুজনের ভাগিদারী এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা ব্রাহ্মণ সমাজের কাছে উতকন্ঠা ও উদ্বেগের কারণ হিসেবে বর্ণিত। ২০১৬ সালের ১৭ই জানুয়ারী রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যাকাণ্ডে আবার প্রমানিত হয়েছে যে ব্রাহ্মন্যবাদ ভারত বিধ্বংসী বিষ এবং এই বিষের প্রভাব এখনো সমান ভাবে কার্যকরী। সমাজ পাল্টালেও ব্রাহ্মন্যবাদের ঘৃণ্য প্রভাব একেবারে পাল্টায়নি বরং উপযুক্ত পরিবেশ ও রাষ্ট্রীয় ইন্ধন পেয়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে ভারতবর্ষের সমগ্র শরীরে।
মুজাপফরনগর, দাদরি, উনা, কালাহান্ডি সর্বত্র চলছে মৃত্যুর মিছিল। কালবুর্গী, রোহিত, মুথুকৃষ্ণান, একলাখ, জুনায়েদ আর গৌরী লঙ্কেশদের লাশ জমা হচ্ছে পোষ্টমর্টেমে। ভারত মাতার মৃত শরীর উঠে আসছে দানা মাঝিদের শক্ত কাঁধে। উন্নত শির, শক্ত হাত, শক্ত গতর। পাথরের মত কঠিন। গো-রক্ষকদের নৃশংস ডাণ্ডাকেও ক্লান্ত করে ছেড়েছে প্রতিরোধের এই শক্ত গতর। চুনি কোটালের সময় থেকে যে প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল আজ তা উচ্চকিত হয়ে এক ঘূর্ণি ঝড়ের আকার নিয়েছে। রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার প্রতিবাদে ইউনেস্কোর বিশেষ সভায় ধিক্কার জানানো হয়েছে ভারতের ব্রাহ্মণ্য শাসন ব্যবস্থাকে। ভারতের পার্লামেন্টে ঝড় বয়ে গেছে। ধিক্কার জানানো হয়েছে আপ্পা রাও, বাঙ্গারু দত্তাত্রেয় ও স্মৃতি ইরানীকে। উনার ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সর্বত্র। চর্মকার ভাইদের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে দলিত মুসলিম ভাইয়েরা। তাদের সম্মিলিত বিপুল প্রতিরোধের কাছে নতিস্বীকার করে গদি ছাড়তে হয়েছে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীকে। ভারতের প্রতি কোনে কোনে সংঘটিত হয়েছে দীপ্ত মিছিল। দেশের জনগণের মধ্যে সংহতির চেতনা জাগ্রত কারার জন্য জাতপাতের ভেদভাবকে উপেক্ষা করে মিছিলে মিলিত হয়েছে অগণিত মানুষ। তারা দীপ্ত ভাবে ঘোষণা করেছে ব্রাহ্মন্যবাদ নিপাত যাক, জাতপাত নিপাত যাক, মনুর শাসন ধ্বংস হোক। তারা হুঁশিয়ার করেছে সেই সব দাঙ্গাবাজদের যারা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে ভারতীয় শাসনব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলার চক্রান্তে সামিল হয়েছে। তারা দাবী করেছে যে সব কাজের জন্য জাতপাত নির্ণয় করা হয় সেই কাজ আর তারা করবেনা। তারা দাবী করেছে সরকারকে তাদের প্রাপ্য জমি ফেরত দিতে হবে এবং সেই জমিতে খাদ্য উৎপাদন করে তারা মর্যাদার সাথে জীবনযাপন করবে। অর্থাৎ স্বাধিকারের এই লড়াইতে দলিত-বহুজন মানুষ যে দর্শনকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে তা মহামতি গোতমা বুদ্ধের ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা ও ভ্রাতৃত্বের দর্শন, জ্যোতিরাও ফুলের প্রদর্শিত গোলামগিরি থেকে মুক্ত হবার দর্শন, রামস্বামী পেরিয়ারের আত্তমর্যাদা প্রতিষ্ঠার দর্শন এবং এবং বাবা সাহেব আম্বেদকরের ভাগিদারী দর্শন।
দলিত-বহুজন মানুষেরা বুঝতে পেরেছেন যে বাবা সাহেবের Social inclusive doctrine বা ভাগিদারী দর্শনই ৮৫%
মূলনিবাসী বহুজন সমাজকে কেন্দ্রীভূত করে তুলবে এবং এই ভাগিদারী সামাজিক শৈলী বহুজনদের রাষ্ট্র ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দুতে নিয়ে আসবে। স্বাধিকার এবং ভাগিদারীর সুষম বন্টন নিশ্চিত হলে শ্রেণি-সংগ্রামহীন, হিংসাশ্রয়ী রক্তরঞ্জিত যুদ্ধ ছাড়াই সংঘটিত হবে এক নিঃশব্দ রাষ্ট্র বিপ্লব। সর্বজনের কল্যাণে সর্বজনের রাষ্ট্রীয় উত্থান। আত্তউপলব্ধি ও আত্তিকরণের এমন এক সামাজিক উত্থানের মাধ্যমেই বন্ধুত্বপূর্ণ কল্যাণকারী রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন দলিত-বহুজন সমাজ।
No comments:
Post a Comment