Pages

Thursday 28 April 2016

কমরেড কান্তি বিশ্বাস স্মরণে ঃ যুদ্ধ পরিস্থিতি - judhho poristhiti Yesterday at 4:37am


১৯৭৭ সাল। পশ্চিমবঙ্গে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে গঠিত হলো প্রথম বামফ্রন্ট সরকার। আরও অনেকের মতনই সিপিআই(এম) প্রার্থী হিসেবে জিতে এলেন কমিউনিষ্ট নেতা কমরেড কান্তি বিশ্বাস। জ্যোতি বসু কে মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে সামনে রেখে গঠিত হলো বামফ্রন্টের ক্যাবিনেট। সেই ক্যাবিনেটে নেই কোন নিম্নবর্ণের প্রতিনিধি। কমরেড কান্তি বিশ্বাস এই ব্যাপারটা পার্টির দৃষ্টিগোচর করলেন। বাম আন্দোলনে তখনো শ্রেনীর প্রশ্ন সামনের সারিতে, জাতের প্রশ্ন নিয়ে তখনও তারা মাথা ঘামাচ্ছেন না। তাই এই ব্যাপারটিকেও খুব একটা গুরুত্ব দিলেন না হয়তো। কান্তি বিশ্বাস কে ক্যাবিনেটে নেওয়া হলো, কিন্তু তিনি হলেন পোর্টফোলিও ছাড়া মন্ত্রী। ক্ষোভে পদত্যাগের কথা বললেন তিনি। তার ক্ষোভ প্রশমিত করতেই তাকে যুবকল্যাণ এবং স্বরাষ্ট্র (পাসপোর্ট) দপ্তরের ভার দেওয়া হলো।
১৯৮২ সাল। আবার ভোটে জিতে দ্বিতীয় বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হলো। এবার কান্তি বিশ্বাস ক্যাবিনেটে জায়গা পেলেন স্কুল শিক্ষামন্ত্রী হিসেবে। এবং এর পরেই 'শিক্ষিত' এবং 'প্রগতিশীল' বাঙালি সমাজের মধ্যে আলোড়ন উঠলো। সেই সময়কার সংবাদপত্রে মধ্যবিত্ত বাঙালিরা চিঠি লিখতে শুরু করলেন - কেন একজন 'চন্ডাল', 'নিম্নবর্ণ' কে শিক্ষামন্ত্রী করা হয়েছে। একদিন প্রমোদ দাসগুপ্ত কান্তি বিশ্বাস কে ডেকে ওনাকে ৪০০ র বেশি চিঠি দেখালেন, যা সিপিআই(এম) এর রাজ্য সম্পাদক হিসেবে প্রমোদ দাসগুপ্ত কে উদ্দ্যেশ্য করে লেখা। সেই চিঠি যারা লিখেছেন, তাদের মধ্যে পার্টির সমর্থকরাও আছেন। প্রতিটি চিঠির বিষয়ই এক - একজন নিম্নবর্ণের মানুষকে কেন শিক্ষামন্ত্রী করা হয়েছে? রাজ্যের শিশুদের শিক্ষার দায়িত্ব কিভাবে একজন চন্ডালের হাতে ছাড়া যায়? প্রয়োজনে ওনাকে আরও বেশি দায়িত্ব দিয়ে অন্য দপ্তরে সরিয়ে দেওয়া হোক, কিন্তু শিক্ষার মতন একটা দপ্তর কিছুতেই একজন চন্ডালের হাতে দেওয়া যায় না।
না, কান্তি বিশ্বাসকে তার দপ্তর থেকে সরানো হয়নি। ঢাকা ইউনিভার্সিটির স্নাতক এই 'চন্ডাল' ২০০৬ অবধি একের পর এক বামফ্রন্টের ক্যাবিনেটের স্কুলশিক্ষামন্ত্রী ছিলেন - স্কুলশিক্ষার ক্ষেত্রে বামফ্রন্টের যদি এতটুকুও সাফল্য থেকে থাকে, তা একান্তই কমরেড কান্তি বিশ্বাসের অবদান।
২০০০ সাল। সব রাজ্যের স্কুল শিক্ষামন্ত্রীদের নিয়ে দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে একটি সম্মেলন হচ্ছে। 'ন্যাশনাল কারিকুলাম ফ্রেমওয়ার্ক' নিয়ে আলোচনা। কংগ্রেস এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো থেকে আসা শিক্ষামন্ত্রীদের মধ্যে তুমুল দ্বন্দ্ব। বিজেপি চেষ্টা করছে স্কুলের সিলেবাসে সুচতুর ভাবে তাদের হিন্দুত্ববাদের এজেন্ডা প্রবেশ করানোর। বিরোধিদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন কান্তি বিশ্বাস। উনি সওয়াল করছেন আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত সিলেবাসের পক্ষে। হঠাত রেগে গেলেন কেন্দ্রের মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী, বিজেপির সাংসদ মুরলিমনোহর যোশী। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন - আমি কান্তি বিশ্বাস কে সম্মান করি। ওনার মতন জ্ঞানের ব্যাপ্তি অন্য কোন শিক্ষামন্ত্রীর নেই। কিন্তু একইসাথে আমি ওনাকে ঘৃনা করি, কারন উনি একজন বাঙালি ব্রাহ্মন হয়েও তফসিলি জাতির সার্টিফিকেট নিয়ে নিম্নবর্ণ সেজে থাকেন।
কান্তি বিশ্বাস অবাক হয়ে বললেন - আমি ব্রাহ্মন, এই কথা আপনাকে কে বললো?
যোশী বললেন - ব্রাহ্মন না হলে আপনি শিক্ষাক্ষেত্রে এত মেধাবী এবং এত জ্ঞানী হলেন কি করে?
কান্তি বিশ্বাস প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন - আপনার ধারনা একজন নিম্নবর্ণ শিক্ষায় মেধাবী হতে পারে না। এ আপনার বর্ণবাদী মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ।
বিগত কয়েকদিন ধরে আমরা যে স্লোগানগুলো নিয়ে চর্চা করছি - ব্রাহ্মন্যবাদ সে আজাদি, মনুবাদ সে আজাদি - সেই স্লোগানগুলো যে লড়াইয়ের কথা বলে, সেই লড়াইয়ের সামনের সারির সৈনিক ছিলেন কান্তি বিশ্বাস। এই ব্রাহ্মন্যবাদ বা মনুবাদের ধারক ও বাহক যেমন বিজেপি এবং গোটা সংঘ পরিবার, তেমনই এর ওপর একচেটিয়া দাবি শুধু তাদের না। সমস্ত রাজনৈতিক দল, সমাজের সমস্ত স্তরে, এমনকি কমিউনিষ্ট এবং বামপন্থীদের মধ্যেও এই ব্রাহ্মন্যবাদ এবং মনুবাদ বিরাজমান। আমরা যখন এর থেকে আজাদি চাই, তখন আসলে আমরা নিজেদের মননে এবং চেতনায় লুকিয়ে থাকা 'prejudice' এর সাথে লড়াই করছি। এবং এই লড়াই চিরন্তন, আমাদের প্রত্যেকের জীবনের শেষদিন অবধি এই লড়াই চলবে। তাই শুধু বিজেপি এবং হিন্দুত্ববাদীরা নয়, এই লড়াই নিজেদের সাথেও লড়তে হবে আমাদের। শ্রেনী আন্দোলন হাত ধরবে বর্ণ আন্দোলনের - আজ নীল রঙ মিশবে লাল রঙ এর সাথে - সেটাই হবে ব্রাহ্মন্যবাদ সে আজাদি!
২৭ এপ্রিল, ২০১৬ - মারা গেলেন কমরেড কান্তি বিশ্বাস।
লাল সেলাম!
জয় ভীম!
(উপরোক্ত ঘটনাবলী এবং তথ্য কমরেড কান্তি বিশ্বাসের আত্মজীবনী 'আমার জীবনঃ কিছু কথা' থেকে নেওয়া)

 https://www.facebook.com/juddhoporisthiti/posts/1179460518750840?fref=nf

No comments:

Post a Comment