সংঘ পরিবার বুঝে নিয়েছে যে ভারতকে হিন্দুস্তান বানানোর এটাই শেষ সুযোগ। কেননা তাদের টোল থেকে জন্মানো বিজেপি সরকার এখন একচ্ছত্র ভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন। যা করার এখনি না করতে পারলে সাধের রামরাজ্য মগজেই শুকিয়ে যাবে। আলেয়ার আলোর মত উবে যাবে ব্রাহ্মন্যবাদের পরম্পরা এবং মিথ্যার মাইথলজি।
মোদির স্বচ্ছ ভারত বা মেক ইন ইন্ডিয়া যে ব্রাহ্মন্যবাদ পুনঃ প্রতিষ্ঠার এক সুচতুর কৌশল তা কিন্তু নানা ইস্যুতে উঠে আসছে। ক্রমশই মুখোশ খসে গিয়ে বেরিয়ে আসছে ব্রাহ্মন্যবাদের বীভৎসতা। এই মডিউলগুলিতে যে কী ভয়ঙ্কর বিষ মেশানো রয়েছে তা ভারতের মূলনিবাসী বহুজন সমাজ হাড়েহাড়ে বুঝে নিয়েছে। তারা বুঝে নিয়েছে যে এই স্বচ্ছ ভারত বা ভারত সাফাই অভিযানের নেপথ্যে লুকিয়ে আছে মূলনিবাসী দলিত বহুজনের (SC/ST, OBC and Minorities) নিকেশ অভিযান।
এই মডিউলকে কার্যকরী করার জন্য সংঘপরিবার উগ্র হিন্দুত্ববাদ, জাতপাত, রামজাদা, হারামজাদা, দেশদ্রোহী আইন( যে আইনে ব্রিটিশরা ভারতীয় বিপ্লবীদের ফাঁসি বা মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করত), গোমাংস, দুর্গা-মহিষাসুর এবং “ভারত মাতা কি জয়” প্রভৃতিকে প্রবলভাবে একটি টুল হিসেবে ব্যবহার করছে যাতে দেশ বিরোধিতার অজুহাতে ব্রাহ্মন্যবাদ বিরোধী সমস্ত শক্তিগুলিকে চুরমার করে দেওয়া যায়। মোটকথা ব্রাহ্মন্যবাদ ছাড়া অন্যান্য যে কোন মতবাদ বিজেপি বা সংঘ পরিবারের কাছে দেশবিরোধী। আরএসএস এর ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা করেই ওরা দেশভক্ত ও দেশদ্রোহী হিসেবে দাগিয়ে দেয়।
দীর্ঘকালীন জাত-ধর্মের লড়াই চালাতে চালাতে সংঘ পরিবার বুঝে নিয়েছে যে মুসলমান এবং খ্রিষ্টান ধর্মের মানুষদের সহজে সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায় এবং দেশপ্রেমের নামে খুব সহজেই মসজিদ ভেঙ্গে, গির্জা পুড়িয়ে নারীদের ধর্ষণ করে ধর্মীয় পূন্য অর্জন করার আবেগে হিন্দুদের উদবুদ্ধ করা যায়। ওরা মনে করে যে ধর্মীয় আবেগ ছাড়া এই দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে মূলনিবাসী ভাবধারা একেবারেই নেই এবং সেই কারণেই এই দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতীয়তাবাদ তেমন ভাবে গড়ে ওঠেনি। বলতে দ্বিধা নেই যে এই দুটি সম্প্রদায়কে আক্রমণ করে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করার অনুশীলনে সংঘ পরিবারের লোকেরা সফল হয়েছে।
অন্যদিকে ভারতীয় বামপন্থী দলগুলির বিরুদ্ধেও ব্রাহ্মন্যবাদ সমান ভাবে সফল। অধিকাংশ বামপন্থী দলের অভ্যন্তরে নিজেদের লোক ঢুকিয়ে দিয়ে তারা বামপন্থী দলের নেতাদের মুখ থেকে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের ভাষা মুছে দিয়েছে। অধিকাংশ বামপন্থী দলের সেন্টাল কমিটি বা পলিটব্যুরো এখন ব্রহ্মন প্রতিনিধিদের কব্জায়। বামপন্থী দলগুলিকে বিপথ চালিত করার জন্য এই সব নেতারা সর্বদাই সচেষ্ট। তাই এরা এখন শুধুই ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতা দখলের জন্য লালায়িত। সমাজ বিপ্লব ওদের কিতাবেই ঢাকা পড়ে আছে।
এবার তাই ওদের আক্রমণের গতিমুখ দলিত-বহুজন এবং আম্বেদকরবাদ। সংঘ পরিবার জানে যে ভারতীয় সামাজিক ব্যবস্থায় একমাত্র আম্বেদকরের ভাগীদারী দর্শন এবং যুক্তিবাদই তাদের মান্ধাতা আমলের অনুশাসনকে একেবারে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলতে পারে। আম্বেদকরবাদের প্রসার ঘটলে তাদের হাত থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল চাবিকাঠিটি স্থায়ী ভাবে বেহাত হয়ে যেতে পারে। কেননা আম্বেদকরবাদ বহুজন বা সর্বজনের রাষ্ট্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার যাদুদণ্ড যা জাতপাতকে এবং ধর্মীয় বিভাজনকে সরিয়ে রেখে জনগণকেই ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে আসে। আম্বদকরবাদ ভাইচারা ও ভ্রাতৃত্ব বোধের নিঃশব্দ অভ্যুত্থান। বিজেপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকতে থাকতেই সংঘপরিবার খুব পরিকল্পিত ভাবেই আম্বেদকরবাদকে চ্যলেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে।
রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা, এই সাফাই অভিযানেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থী ও আম্বেদকরপন্থী ছাত্রছাত্রীদের উপর বর্বর পুলিশি অত্যাচার নামিয়ে আনা এবং প্রশান্ত, কানহাইয়া, উমর খলিদ বা অনির্বাণদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আসলে ব্রাহ্মন্যবাদ বিরোধী মতবাদের সাফাই অভিযানের রণকৌশল।
অনেক অনেক দেরিতে হলেও ব্রাহ্মন্যবাদ বিরোধী সমস্ত শক্তিই এখন আম্বেদকরবাদের সাথে একাত্ততা অনুভব করতে শুরু করেছে। মনুবাদের বিরুদ্ধে ভারতীয় জনগণের প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। আকাশবাতাস মুখরিত করে প্রতিধ্বনিত হয়ে চলেছে “জয় ভীম”। উন্নত শির, শক্ত চোয়াল এবং দৃঢ় মুষ্টিবদ্ধ অগণিত কন্ঠে ঘোষিত হচ্ছেঃ
“জাতিবাদ কি টক্কর মে, জয় ভীম হামারা নারা হ্যায়”।
“মনুবাদ কি টক্কর মে, জয় ভীম হামারা নারা হ্যায়”।
“ব্রহ্মন্যবাদ কি টক্কর মে, জয় ভীম হামারা নারা হ্যায়”।
ভারতীয় রাজনিতিতেও আসছে নতুন সমীকরণ। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটি মঞ্চে আসার চেষ্টা করছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ইতিমধ্যেই MIM নেতা ব্যারিস্টার আসাউদ্দিন ওয়েসি বহিন মায়াবতীর সাথে মিলিত হয়ে রাজধানীতে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন। ব্যারিস্টার আসাউদ্দিন ওয়েসি দাবী করেছেন যে ভারতীয় প্রেক্ষাপটে বাবা সাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের মতবাদই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। মুসলিম নেতাগণ এই সহজ সত্যটা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবেন ততই মঙ্গল। কেবল মাত্র এই মতবাদই পারে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী ব্রাহ্মন্যবাদকে রুখে দিতে। সময়ের দাবীকে মান্যতা দিয়েই তিনি বহিন কুমারী মায়াবতীর সাথে হাত মেলালেন।
সংসদে রোহিত ভেমুলার প্রাতিষ্ঠানিক হত্যা বিতর্কে কংগ্রেস, বামপন্থী, আরজেডি, জনতা দল, ডিএমকে প্রভৃতি দলগুলি যে ভাবে মানব সম্পদ মন্ত্রী স্মৃতি ইরানীর বিরুদ্ধে বহিন মায়াবতীকে সমর্থন করলেন তা নজিরবিহীন। এই সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে জনগণের কাছে একটি বার্তা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, গান্ধীবাদ, মাক্সবাদ, লেনিনবাদ, মাওবাদ দিয়ে মনুবাদ বা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে না। কালের ভবিষ্য লিপি অনুসারে একমাত্র আম্বেদকরবাদই গণতন্ত্র ফেরানো বা জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূলাধার হয়ে উঠতে পারে।
জয় ভীম।
No comments:
Post a Comment