বিজেপি
বা তার পৃষ্ঠপোষক মনুবাদী সংগঠনগুলির এজেন্ডাই হল সাম-দাম-দন্ড-ভেদ। ওর যখন যখন
ক্ষমতাসীন হয়েছে বা সুযোগ পেয়েছে এই বিভাজন নীতিকেই বাস্তবায়িত করতে উঠে পড়ে
লেগেছে। উদ্দেশ্য একটাই এই বিভাজন নীতি বাস্তবায়িত হলে মনুবাদীদের
সামাজিক স্থিতি মজবুত হয়। সুরক্ষিত হয় ও প্রবলতর হয়। শ্রমজীবী মানুষের পেটের উপরে
পা দিয়ে আরাম সে বংশপরম্পরায় চালিয়ে যাওয়া যায় পরগাছা জীবন। মনুবাদীরা এখানেই
সার্থক যে, এই নীতিকে বাস্তবায়িত করতে তারা সুকৌশলে ধর্ম নামক একটি টুলকে দক্ষতার
সঙ্গে ব্যবহার করেছে এবং সমগ্র জাতিকে জাতপাতের বেড়াজালে আবদ্ধ করে মানুষের
ব্যক্তি সত্তার মধ্যে ঘৃণার ঘুন ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে।
মনুবাদীদের
রাজনৈতিক দল বিজেপি যখন যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে এই বিভাজনই হয়ে উঠেছে তাদের প্রধান খেলা। আর এই
খেলা মূলত দেশের ৮৫% মানুষকে তাদের পায়ের তলায় পিষে মারার খেলা। দেশের জীব বৈচিত্র,
সামাজিক বৈচিত্র ও ধর্মীয় বৈচিত্র নিয়ে বিভেদের খেলা। বিদ্যালয়গুলিতে সরস্বতীমন্ত্র
চালু করা, গায়ত্রীমন্ত্র জপ করানো এবং জ্যোতিষশাস্ত্রকে বিজ্ঞান হিসেবে চালু করানো
ছিল এই খেলার প্রায়োগিক কৌশল। বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা, রামের মূর্তি ঢুকিয়ে দিয়ে
স্থানটিকে রামের জন্মভূমি হিসেবে ঘোষণা করা, একটি প্রাকৃতিক সংযোগ সেতুকে রাম সেতু
হিসেবে দেখানোর এই আবেগ আসলে মাইথোলোজিকাল রামকে ঐতিহাসিক রামে প্রতিষ্ঠিত করার
উন্মত্ত খেলা। বিজেপি ক্ষমতায় এলেই সামাজিক, অর্থনৈতিক বা বৈচিত্রময় সামাজিক
উন্নয়নের পরিবর্তে এই বিভাজনের খেলাতেই মত্ত হয়ে উঠেছে বেশী। মোদি এই খেলার
বর্তমান কালাপাহাড়। ধ্বংস ও নির্মাণ যার অন্যতম শ্লোগান।
মোদির
গলায় আরএসএস এর গানঃ
“১৯৪৭ সালের পরে যাঁরা ভারতে এসেছেন, তাঁরা বিছানা- বেডিং বেঁধে রাখুন! ১৬ মে-পরে তাঁদেরবাংলাদেশে ফিরে যেতে হবে”। মোদির এই বজ্র নিনাদ হঠাৎ তাল পড়ার মতো কোন বিষয় নয়। অথবা আবেগের বশে অতি
প্রগলভতার বহিঃপ্রকাশও নয়। এটা রীতিমত গৃহানুশীলন ও দীর্ঘ প্রস্তুতির একটি আবশ্যিক
রনভেরির যা আরএসএস এর পাঠশালায় প্রতিদিন বাজানো হয়। একই সুরে এই বিউগলই আমরা
বাজাতে দেখেছিলাম শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিদের। সঙ্গে ছিলেন বিধান রায়, নলিনী সরকার
এবং এন সি
চ্যাটার্জিদের মত হিন্দু মহাসভার বলিষ্ঠ নেতাগণ। এবং এই
বিভাজনের কাজে এগিয়ে আসে মাড়োয়ারি ব্যবসাদার, বিড়লা,গোয়েঙ্কা, ঈশ্বর দাস জালান। তারা প্রচুর পরিমাণে
অর্থ ঢালতে শুরু করে দেশ বিভাগের পক্ষে কারণ এই বিভাগে তারাই সবথকে বেশি লাভবান
হবেন। তাদের পয়সা দিয়েই তখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, বিধান রায়, নলিনী সরকার, এন সি চ্যাটার্জিদের আন্দোলন চলে। ৪
এপ্রিল ১৯৪৭ সালে,
তারকেশ্বরে হিন্দু মহাসভার একটি সম্মেলনে
এন সি চ্যাটার্জি বলেন,"বিষয়টা আর দেশভাগের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বাংলার হিন্দুরা আলাদা প্রদেশ গড়ে
শক্তিশালী দিল্লী কেন্দ্রিক জাতীয় সরকারের অধীনে থকাবে। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি একই
সুরে বলেন যে,
দেশ ভাগই সাম্প্রদায়িক সমস্যার একমাত্র
সমাধান”। কেননা Proportional Representation নীতির জন্য দলিত-মুসলিমরা এক হয়ে আইন
সভাতে সর্বাধিক প্রতিনিধি পাঠাতে শুরু করেছে। সংখ্যা বলে তারাই শাসন ক্ষমতার উপরে
উঠে আসছে। বামুনেরা সংখ্যায় নগণ্য তাই তারা ক্ষমতার শীর্ষে আসতে পারছে না এবং
সাধারণের উপর তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে পারছেনা। স্বাধীনতার পরেও যদি এই মডেল
কার্যকরী থাকে তবে লোটা কম্বল নিয়ে তাদের খাইবার – বোলান গিরিপথের ভিতর দিয়ে বহির্গমন
করেতে হবে। সুতরাং বিভাজনই একমাত্র সমাধান। তাতে দেশ খণ্ডিত হলেও ব্রাহ্মন্যবাদী
শাসকদের প্রভুত্ব অটুট থাকবে। মোদির গলায় তাই হিন্দু মহাসভা ও আর এস এস এর পুরাতনী
গান।
সাম্প্রদায়িক
বাটোয়ারার ও পুনর্বাসনঃ
খণ্ডিত দেশে
ব্রাহ্মন্যবাদীদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও পুনর্বাসন ও নাগরিকত্ব নিয়ে
থেকে যায় বিস্তর বিভেদ। ১৯৪৬ এর দাঙ্গা, সাম্প্রদায়িক হানাহানি ইতিমধ্যেই বাঙালী
মনে বিভেদের প্রাচীর তৈরি করে ফেলেছে। উদ্বাস্তু সমস্যায় জর্জরিত হচ্ছে উভয় দেশ। সাম্প্রদায়িক
বাটোয়ারার জন্য বিশাল সংখ্যক মানুষ পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে
বাধ্য হচ্ছে। জলা-জঙ্গল-মরুভূমিতে চলছে পুনর্বাসনের কাজ। ঠিক এরকম সময় ১৯৫০ সালের
৮ই এপ্রিল খণ্ডিত দুই রাষ্ট্রের
প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে এই বিষয় নিয়েই প্রথম চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি নামে খ্যাত।
“The two Prime
Ministers met in Delhi on April 2, 1950, and discussed the matter in detail.
The meeting lasted for six long days. On April 8, the two leaders signed an
agreement, which was later entitled as Liaquat-Nehru Pact. This pact provided a
‘bill of rights’ for the minorities of India and Pakistan. Its aim was to
address the following three issues:
·
To
alleviate the fears of the religious minorities on both sides.
·
To
elevate communal peace.
·
To
create an atmosphere in which the two countries could resolve their other
differences.
According
to the agreement, the governments of India and Pakistan solemnly agreed that
each shall ensure, to the minorities throughout its territories, complete
equality of citizenship, irrespective of religion; a full sense of security in
respect of life, culture, property and personal honor.
It
also guaranteed fundamental human rights of the minorities, such as freedom of
movement, speech, occupation and worship. The pact also provided for the
minorities to participate in the public life of their country, to hold
political or other offices and to serve in their country’s civil and armed
forces”.
-
See more at:
http://storyofpakistan.com/liaquat-nehru-pact/#sthash.v8DC88RS.dpuf
এরপর চুক্তি
স্বাক্ষরিত হয় ২রা এপ্রিল ১৯৭২ সালে। ইতিমধ্যে সংঘটিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা
সংগ্রাম। চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের
রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলি ভুট্টার সাথে।
১৯৭৪ সালে
স্বাক্ষরিত হয় ইন্দিরা-মুজিব প্যাক্ট। প্রত্যেক স্বাক্ষরিত চুক্তির মধ্যেই দুই
দেশের সংখ্যালঘুদের পুনর্বাসনের উপরে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই চুক্তিগুলির
ভিত্তি ছিল নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি। অর্থাৎ সংখ্যালঘুরা স্বাধীন ভাবেই যে কোন দেশের
নাগরিক হতে পারে এবং স্বাধীন ভাবে তাদের ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক পরম্পরা বহন করতে
পারে।
এটা অনস্বীকার্য
যে এই চুক্তিগুলি ছিল আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু সমস্যা ও তাদের পুনর্বাসনের বিধি ব্যবস্থার
পরিপূরক। এবং তার ফল হিসেবে ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে
ব্যপক পুনর্বাসন। বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত উদ্বাস্তুরা ভারতের বিভিন্ন
রাজ্যে বসতি স্থাপন করেছে। এবং ধীরে ধীরে মূল সংস্কৃতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। কিছু
মানুষ নিপীড়ন সহ্য করেও থেকে গেছে পিতৃপুরুষের আজন্ম ভিটেয়। কিছু উৎপীড়িত হয়ে আজও
উদ্বাস্তুতে পরিণত হচ্ছে। জনান্তিকে বলে রাখি, এই উদ্বাস্তুরা ভারতের আদিজন,
ভারতীয় সংস্কৃতির ধারক, বাহক ও প্রতিপালক।
“তুমি
মহারাজ সাধু হলে আজ...ঃ
ব্রাহ্মন্যবাদীদের
গাত্রদাহ এখানেই। এরা হিসেব করে দেখেছে যে এই দলিত, নিপীড়িত মানুষেরা নাগরিকত্বের
অধিকার পেলে আবার এরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় উঠে আসবে। সাংবিধানিক রক্ষাকবজ ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয়
সম্পদের নিজেদের ভাগ আদায় করে ছাড়বে এবং বিভাজনের আজন্ম খোঁয়াড় ভেঙ্গে ফেলে
রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক/সাম্যবাদী রাষ্ট্রতে পরিণত করবে। আর সেটা হলে
ব্রাহ্মন্যবাদ, মনুবাদ অপাংক্তেয় হয়ে পড়বে। বর্ণবাদ ধ্বংস হয়ে যাবে। উৎপাদকদের
পেটের উপর পা দিয়ে বংশপরম্পরায় চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় গলধকরণ অসম্ভব হয়ে পড়েবে।
তাই পূর্বপুরুষ মনুর বাণীকে আইনী গ্রাহ্যতা দিতে ২০০৩ সালে বিজেপি নাগরিক আইনের
মধ্যে একটি সংশোধনী এনে পূর্ববর্তী আইন গুলিকে কার্যত ধুলিস্যাত করে দিল এবং একটি
কালাকানুনকে বাস্তবায়িত করার জন্য রাষ্ট্র শক্তিকে ব্যবহার করতে শুরু করল। এই কালা
কানুনের ফলেই কোটি কোটি মানুষ হয়ে পড়ল দেশহীন। এই কালাকানুনের ভাষায় তারা অনুপ্রবেশকারী,
দেশদ্রোহী ও শ্ত্রু। সত্যি সেলুকস...!!!! প্রকৃতজনেরা আজ বেঘর অনুপ্রবেশকারী আর প্রকৃত
অনুপ্রবেশকারীরা আদর্শ নাগরিক !!
জায়নবাদী
কণ্ঠস্বরঃ
আরএসএস
এর লালিত ও প্রতিপালিত বিজেপি জানে যে তাদের কালাকানুন (http://www.indiankanoon.org/doc/693674/ ) আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
মহামান্য সুপ্রিম কোর্টও এই ভাবে একটি বৃহত্তর জন সমূহকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত
করা যায়না বলে এই কানুন পরিবর্তনের জন্য তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। এসব জেনেও
নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদি এরূপ প্রতিক্রিয়া দিলেন কেন? একটু খেয়াল করলেই ধরা পড়বে
যে, নেহেরু, প্যাটেল, শ্যামাপ্রসাদ বা বিধান রায়দের যারা দেশ বিভাগের জন্য মদত দিচ্ছিলেন
এযুগেও তাদের বংশধরেরা মোদিকে মদত দিয়ে চলেছে। এর কারণ হল ব্যবসা, মুনাফা এবং
প্রভুত্ববাদ কায়েম করা। প্রভুত্ববাদ কায়েমের জন্য কাঁচামাল ও সস্তা শ্রমিকের উপর একচ্ছত্র
দখলদারী। এই দখলদারী সার্বিক না হলে সুন্দরবন, জঙ্গলমহল, হিমালয় অঞ্চল অথবা জল-জঙ্গল-জমির
উপর প্রভুদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাই এই কালাকানুনকে সামনে রেখে মোদি তার
কর্পোরেট মডেলের বাস্তবায়ন শুরু করলেন। এই আইনের বলে যে কোন মানুষকে কনসেন্ট্রেশন
ক্যাম্পে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে। তকেই প্রমান করতে হবে যে ১৯৪৭ সালের আগে তার
পূর্বপুরুষেরা এদেশের নাগরিক ছিল। মোদি এটাও জানে যে নিরক্ষর সাধারণ মানুষের কাছে
এমন কোন প্রামাণ্য দলিল নেই যে সে প্রভুদের জেরা থেকে মুক্তি পেতে পারে।
খনিজ পদার্থের ঘটতি ইতিমধ্যেই প্রায় শেষের দিকে। পরমাণু জ্বালানী ও
পেট্রোডলারের বাজার শেষ হয়ে যাবে কয়েক দিনের মধ্যে। এবার প্রাকৃতিক সম্পদ তাই
ব্যবসার মূলধন, মূল পুঁজি, মূল কাঁচামাল। জায়নবাদী পুঁজিপতিরা তাই প্রাকৃতিক
সম্পদের উপর দখলদারিতে সর্বশক্তি দিয়ে নেমে পড়েছে । অথচ এই প্রাকৃতিক সম্পদের
অনেকটাই আগলে রেখেছে সাধারণ মানুষ। শ্রম এবং উৎপাদনের সাথে জড়িত মূলনিবাসী মানুষ।
এদেশের আদিমজন। ভারতের সংবিধান যাদের রক্ষা কবজ। আদিবাসী ভূমি আইন, সেডুল্ড কাস্ট,
সেডুল্ড ট্রাইব এট্রোসিটিস অ্যাক্ট এবং সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় যারা ধীরে ধীরে
বলিয়ান হয়ে উঠছে তাদের সোজা পথে বিতাড়িত করা দুরূহ কাজ। ব্যবসাদারদের মুনাফার
জন্যই জায়নবাদী মোদি তাই এই কালা কানুনের আশ্রয় নিতে বদ্ধপরিকর। যে আইনের মধ্য
দিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের উপর সার্বিক দখলদারি কায়েম করা যায়। ভয় প্রদর্শন, নিপীড়ন, গোলামী
করন ও বিতাড়নের মাধ্যমে মানুষকে সর্বস্বান্ত করা যায়। মোদির জ্বলামুখ দিয়ে তাই
উদ্গিরণ হয়ে পড়েছে সেই পুরাতনী মনুবাদীদের সাম-দাম-দন্ড-ভেদ মূল নীতি।
সুন্দর। ধন্যবাদ এত তথ্য দেওয়ার জন্য।
ReplyDeleteধন্যবাদ অঙ্কুর ।
Deletevery useful information. i would like to translate it. may i?
ReplyDelete