চুরিবিদ্যা নাকি মহাবিদ্যা! হ্যা, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের এটাই শিক্ষা। আর সেই কারণেই গোটা সংস্কৃত সাহিত্যই চুরি বিদ্যার এক মহা সংগ্রহশালা। পাহাড় প্রমান জঞ্জাল। ধাপ্পাবাজির দুর্লভ ডকুমেন্ট!
“সুদীর্ঘ সময় ছিল ধ্বংসের যুগ, অনুকরণের কাল। প্রাচীন দেশীয় শব্দ, লিপি, ভাষা আত্মসাৎ করার অন্ধকার যুগ। অর্থাৎ মূলত এদেশের ভাষা ও শব্দ সম্ভার, সাহিত্যরচনার রীতি এবং লেখকদের আশ্রয় করেই বিজয়ী আর্যরা নিজেদের প্রয়োজন সিদ্ধিমূলক বৈদিক রচনা করে নিয়েছিল। বেদ বা বৈদিক সাহিত্য তাই মূলতঃ ঔপনিবেশিক সংবিধান। বিজয়ী আর্যদের গৌরব গাঁথা এবং তাদেরই স্বার্থ রক্ষার চূড়ান্ত নিয়ম পদ্ধতির দলিল”। (শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়/ বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা)
সংস্কৃত সাহিত্যের বিষয়গুলি সূক্ষ্ম ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, গোটা সাহিত্যটাই মূলভারতীয় বিচারধারার কাউন্টার ন্যারেশন। তাঁদের লক্ষ্যভেদের মূল টার্গেট কপিলের হেতুবাদ এবং গোতমা বুদ্ধের ৮৪ হাজার দেশনা। কপিল এবং গোতমা কার্যকারণের নিরিখে যে মহাজাগতিক জীবনশৈলী নির্মাণ করেছিলেন তা ধ্বংস না করতে পারলে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিকাশ সম্ভব ছিলনা। আর্যরা দীর্ঘ দিন ধরে এই কাজটিই করে চলেছে। তাঁরা প্রয়োজনে চুরি করেছে, হাইজ্যাক করেছে। প্রয়োজনে শব্দগুলিকে পাল্টে মনগড়া একটি কাহিনী রচনা করে ভারতীয় পরম্পরাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে।
কাজটা কিন্তু বেশ কঠিন ছিল। চোরেরা যদি রাজনৈতিক ক্ষ্মতায় আসীন থাকে, তবে তাদের চোর প্রমান করা যথেষ্ট কঠিন। চোখের সামনে চুরি হলেও চোর ধরা মুশকিল। এক্ষেত্রে চৌকিদারও চোর, বিচারকও তো আর এক মহাচোর! তিনি স্বধর্ম এবং স্বভাব ধর্ম বজায় রাখতে চুরি বিদ্যার পক্ষেই রায় দেবেন! সম্প্রতি "রামজন্মভূমি"র পক্ষে রায় দেখেই আপনারা বুঝতে পারছেন যে চোরেরা চোরেদের পক্ষই সমর্থন করে। রাম গল্পের চরিত্র হলেও তার "জন্মভূমি" নির্ধারিত হয় এবং ঐতিহাসিক দলিল থাকা সত্ত্বেও, সম্রাট পসেন্দির #সাকেত_বিহার" "অযোধ্যা নগরী" হিসেবে দখল হয়ে যায়! বলতে এতটুকু আপত্তি নেই যে, ব্রিটিশদের শিক্ষা নীতি এবং জ্যোতিবাঁ ফুলে, সাবিত্রী ফুলে, ফতিমা, সাহু মহারাজ, হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ, পেরিয়ার এবং আম্বেদকরের শিক্ষা আন্দোলন ঢেউয়ের মত আছড়ে না পড়লে সাধারণ মানুষের জ্ঞান হতনা এবং চুরিও ধরা পড়ত না। ব্রাহ্মণরা প্রথম থেকে জানত যে সাধারণ মানুষ শিক্ষিত হলে তাঁদের চোট্টামি ধরা পড়ে যাবে। আর সেই কারণেই তাঁরা ভারতের ভূমি সন্তানদের কাছ থেকে জমি, সস্ত্রধারণ ক্ষমতা এবং শিক্ষা কেড়ে নেয়। সংস্কৃতি ধ্বংস করে "চোরকাহিনীর" ফিউশন তৈরি করে এবং এই চুরিবিদ্যাকে ধর্মের সাথে যুক্ত করে সংস্কারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।
কিন্তু #ইতিহাস_তো #ইতিহাসের_নিয়মেই ঘটে! হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীকে ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে #বুদ্ধের_জন্ম হয়। সহস্র বছরের সঞ্চিত আবর্জনার পাহাড় গুড়িয়ে দিতে #জন্ম_নেয় #আম্বেদকর। আর এই বোধিসত্ত্বদের শান্ত, সমাহিত জ্ঞানের আলোতে সাধারণ মানুষ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
"চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ সিদ্ধ হয়না"। অতি চালাকেরও গলায় দড়ি পড়ে। চোর নিজেকে যতই চালাক ভাবুক প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সে চৌর্যবৃত্তির নমুনা রেখে যায়। ধরা পড়ে। গলায়, পেটে দড়িও জোটে। কেউ কেউ লজ্জিত হয়! কেউ কেউ চৌর্যবৃত্তি ছেড়ে দেয়।
কিন্তু ব্রাহ্মণবাদী চোর?
আশ্চর্য হলেও সত্য যে #মনুষ্যন্যায়_এই_প্রজাতিটি চুরিবিদ্যাটি কিছুতেই ছাড়তে চায়না! চুরির সমর্থনে হাজারটা অজুহাত খাড়া করে! একটি মিথ্যে ঢাকা দিতে হাজার মিথ্যের বেসাতি সাজিয়ে বসে! আষাঢ়ে গল্প, গালগল্প, আজগুবি গল্প, দৈব গল্পের জাল বিস্তার করে চুরি বিদ্যার মহিমা কীর্তন করে চলে! নির্লজ্জ, বেহায়া দর্শনই ব্রাহ্মণবাদের প্রাণভোমরা। চুরি, জোচ্চুরি, জালিয়াতি, রাহাজানি ছাড়লে ব্রাহ্মণবাদ বাঁচেনা!
“দীপাবলি” এমনি একটি চুরির মাল, যা রামকাহিনী তৈরি করে হাইজ্যাক করা হয়েছে। বাল্মীকি রামায়ণের যুদ্ধকান্ডে বর্ণনা করা হয়েছে যে, ত্রেতা যুগে শ্রীরাম রাবণকে বধ করে চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন। শ্রীরামের চৌদ্দ বছর পরের প্রত্যাবর্তনের খুশিতে নাকি সারা রাজ্য জুড়ে দীপ জ্বালানো হয়েছিল! আর সেই আনন্দ উৎসবই নাকি দীপাবলি নামে পরিচিত!
বাল্মীকি রামায়ণের কাহিনীটি এমনঃ
রাম অযোধ্যা প্রত্যাবর্তনের আগের দিন মহর্ষি ভরদ্বাজের আশ্রমে অবস্থান কালে হনুমানকে অযোধ্যায় প্রেরণ করল। হনুমান ভরতকে জানাল যে, “ আপনি কল্য পুষ্যা-নক্ষত্র-যোগে রামকে দেখিতে পাইবেন”।
সত্যপরায়ণ ভরত সেই সম্বাদ শ্রবণ করিয়া প্রহৃষ্টচিত্তে শত্রুঘ্নকে কহিলেন, তুমি এই ঘোষণা কর যে, বিশুদ্ধবার ও শুদ্ধাচার ব্যক্তিগণ সুগন্ধি মাল্য দ্বারা কুলদেবতাদিগের মন্দির ও সাধারণ দেবালয় সমস্ত সুসজ্জিত করুক এবং সর্বত্রই বিবিধ বাদ্যযন্ত্র সকল বাজিতে থাকুক। স্তুতি ও পুরাণজ্ঞ সুতগণ, সকল বৈতালিক, নিপুণ বাদ্যকর ও গণিকা সকল এবং আমত্যবর্গের সমভিব্যাহারে আমাদিগের মাতৃগণ, স্ব স্ব স্ত্রীদিগের সহিত সৈন্যগণ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, প্রধান প্রধান বৈশ্য ও জ্ঞাতিগণ, সকলেই রামচন্দ্রের চন্দ্রমুখ দর্শন করিতে সত্বর বিনর্গত হউক”। বাল্মীকি রামায়ন/যুদ্ধকান্ড/ একোনত্রিংশাধিকশততম সর্গ/ বসুমতি সাহিত্য মন্দির)
ভরতের কথা শুনে শত্রুঘ্ন ভৃত্যদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দিল। নন্দীগ্রাম থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত রাস্তা সমতল করে তাতে জল ছিটিয়ে দেওয়া হল। সব জায়গায় সুগন্ধি ফুল দিয়ে সাজানো হল। বিচিত্র পতাকায় মুড়ে নগরীর শোভা বাড়ানো হল। সূর্যোদয়ের আগে সমস্ত নগরীকে সুসজ্জিত করা হল। অর্থাৎ রামায়ণ কাহিনীতে নগরসজ্জার এই বহরে “দীপাবলী”র কোন উল্লেখ নেই। দিনের বেলাতেই সাধিত হয়েছিল রামের প্রত্যাবর্তন সমারোহ, রাতের বেলা নয়।
ভারতীয় প্রজাপুঞ্জের সমৃদ্ধির অন্যতম শোপান ছিল কৃষি। তাই কৃষিকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল লোকোৎসব। #কেরলের_ওনাম, #বাংলার_আড়ম বা আড়ং, #সোহারায়, #বাদনা এই জনপ্রিয় লোকোৎসবের পরম্পরা। এগুলি ধ্বংস করার জন্যই অকালবোধনের দৈবকাহিনী তৈরি করলেন কীর্তিবাস। আর এই সূত্র ধরে শারদীয় অমানিশার জীবকল্যাণের মঙ্গলময় একটি লোকোৎসব “দীপোদান”কে নরহত্যাকারী কালীপুজার সাথে যুক্ত করে হিংস্রতার “দীপাবলি”তে রূপান্তরিত করা হল। দীপাবলি তাই ভারতীয় সংস্কৃতি ধ্বংসের বিজয় উল্লাস এবং জালিয়াতির নির্লজ্জ আড়ম্ভর।
ব্রাহ্মণবাদে জালিয়াতির সীমা পরিসীমা নেই। যে রামের প্রত্যাবর্তন নিয়ে এত অসাড় কাহিনী এবং দীপাবলির রোশনাই ছড়ানো হচ্ছে বাল্মীকি রামায়ণে তা কি ভাবে আছে দেখে নিন। রামের বনবাস থেকে পুনরায় অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন নিয়ে যদি একটি কালপঞ্জি তৈরি করি তবে সেটি এমন দাড়াবেঃ
১) চৈত্র শুক্ল পঞ্চমীতে রামের বনবাস।
২) ষষ্ঠীতে শৃঙ্গবেরপুর গমন।
৩) সপ্তমীতে বনস্পতি মূলে অবস্থান।
৪) অষ্টমীতে ভরদ্বাজ আশ্রমে গমন।
৫) নবমীতে যমুনাতীরে গমন।
৬) দশমীতে চিত্রকূট পাহাড়ে গমন। সেই রাতে দশরথের মৃত্যু।
৭) একাদশীতে তৈলমধ্যে দেহরক্ষা। ভরতের আগমন। দশরথ দাহ।
৮) তের বছর কেটে গেলে চৈত্র মাসে সীতাহরণ।
৯) বৈশাখে সুগ্রীব মিলন।
১০) আষাঢ়ে বালিবধ।
১১) আশ্বিনে সৈন্য সজ্জা।
১২) ফাল্গুন চতুর্দশীতে লঙ্কাদাহ ।
১৩) ফাল্গুন অমাবস্যায় রাবণ বধ।
১৪) চৈত্র শুক্লপ্রতিপদে রাবণদহ।
১৫) চৈত্র মাসের দ্বিতীয়ায় সীতাপ্রাপ্তি।
১৬) তৃতীয়ায় লঙ্কা থেকে নির্গমন।
১৭) পঞ্চমীতে ভরদ্বাজ আশ্রমে অবস্থান।
১৮) পরের দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের ষষ্ঠীতে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন।
আশাকরি বন্ধুরা বুঝতে পারছেন যে শারদীয় অমানিশার সাথে রামায়ণ বর্ণিত রামের প্রত্যাবর্তনের কোন মিল নেই। এটি সম্পূর্ণ ভাবে একটি জালিয়াতি। রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্রের অযোধ্যা প্রত্যাবর্তনের সময় চৈত্র মাস বা বসন্ত কাল। কাতি( কার্ত্তিক) মাসের অমানিশা বা শরৎ কাল নয়। আসলে ভারতের আদিবাসী সমাজের জনপ্রিয় উৎসব এবং পরম্পরাগুলিকে হাইজ্যাক করার জন্যই দখলদারেরা এই জালিয়াতির গল্প ফেঁদেছে এবং আইন সভা, বিচার সভা এবং প্রশাসনকে কবজা করে এই জালিয়াতির কারবার চালিয়ে যাচ্ছে।
No comments:
Post a Comment