Pages

Thursday, 25 November 2021

বৈঠা জোরে বাও

বৈঠা জোরে বাও রে মনুয়া   

শরদিন্দু উদ্দীপন 


বৈঠা জোরে বাও রে মনুয়া,

বৈঠা জোরে বাও
পূবের আকাশ রাঙা হল
ডিঙ্গা সাগরে ভাসাও।
আমার সাম্পান বান্ধা ছিল
শঙ্খমালার ঘাটে
দড়ি-কাছি উড়ায় নিল
দেশ ভাগের জঞ্ঝাটে
তবু কুলের আশায় ধরব পাড়ি
নীল বাদাম উড়াও।
ছিল সোনার দাঁড় পবনের বৈঠা
ময়ূরপঙ্খী নায়
চান্দো সুরুজ ফুল ছড়াত
স্নিগ্ধ জোছনায় ।
সপ্ত ডিঙ্গার মাধুকরী
বন্দরে বন্দরে
খুঁজে পেলে কাঞ্চনমালা
আসত দেশে ফিরে
আমার মন মধুকর বড়ই ব্যাকুল
ডিঙ্গা সাগরে ভাসাও ।।

Thursday, 4 November 2021

#দীপাবলীর #আলোকসজ্জা #রামের #প্রত্যাবর্তন না #চুরিবিদ্যার_নির্লজ্জ_কাহিনী !!!

 

চুরিবিদ্যা নাকি মহাবিদ্যা! হ্যা, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের এটাই শিক্ষা। আর সেই কারণেই গোটা সংস্কৃত সাহিত্যই চুরি বিদ্যার এক মহা সংগ্রহশালা। পাহাড় প্রমান জঞ্জাল। ধাপ্পাবাজির দুর্লভ ডকুমেন্ট!
“সুদীর্ঘ সময় ছিল ধ্বংসের যুগ, অনুকরণের কাল। প্রাচীন দেশীয় শব্দ, লিপি, ভাষা আত্মসাৎ করার অন্ধকার যুগ। অর্থাৎ মূলত এদেশের ভাষা ও শব্দ সম্ভার, সাহিত্যরচনার রীতি এবং লেখকদের আশ্রয় করেই বিজয়ী আর্যরা নিজেদের প্রয়োজন সিদ্ধিমূলক বৈদিক রচনা করে নিয়েছিল। বেদ বা বৈদিক সাহিত্য তাই মূলতঃ ঔপনিবেশিক সংবিধান। বিজয়ী আর্যদের গৌরব গাঁথা এবং তাদেরই স্বার্থ রক্ষার চূড়ান্ত নিয়ম পদ্ধতির দলিল”। (শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়/ বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা)
সংস্কৃত সাহিত্যের বিষয়গুলি সূক্ষ্ম ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, গোটা সাহিত্যটাই মূলভারতীয় বিচারধারার কাউন্টার ন্যারেশন। তাঁদের লক্ষ্যভেদের মূল টার্গেট কপিলের হেতুবাদ এবং গোতমা বুদ্ধের ৮৪ হাজার দেশনা। কপিল এবং গোতমা কার্যকারণের নিরিখে যে মহাজাগতিক জীবনশৈলী নির্মাণ করেছিলেন তা ধ্বংস না করতে পারলে ব্রাহ্মণ্যবাদের বিকাশ সম্ভব ছিলনা। আর্যরা দীর্ঘ দিন ধরে এই কাজটিই করে চলেছে। তাঁরা প্রয়োজনে চুরি করেছে, হাইজ্যাক করেছে। প্রয়োজনে শব্দগুলিকে পাল্টে মনগড়া একটি কাহিনী রচনা করে ভারতীয় পরম্পরাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে।
কাজটা কিন্তু বেশ কঠিন ছিল। চোরেরা যদি রাজনৈতিক ক্ষ্মতায় আসীন থাকে, তবে তাদের চোর প্রমান করা যথেষ্ট কঠিন। চোখের সামনে চুরি হলেও চোর ধরা মুশকিল। এক্ষেত্রে চৌকিদারও চোর, বিচারকও তো আর এক মহাচোর! তিনি স্বধর্ম এবং স্বভাব ধর্ম বজায় রাখতে চুরি বিদ্যার পক্ষেই রায় দেবেন! সম্প্রতি "রামজন্মভূমি"র পক্ষে রায় দেখেই আপনারা বুঝতে পারছেন যে চোরেরা চোরেদের পক্ষই সমর্থন করে। রাম গল্পের চরিত্র হলেও তার "জন্মভূমি" নির্ধারিত হয় এবং ঐতিহাসিক দলিল থাকা সত্ত্বেও, সম্রাট পসেন্দির #সাকেত_বিহার" "অযোধ্যা নগরী" হিসেবে দখল হয়ে যায়! বলতে এতটুকু আপত্তি নেই যে, ব্রিটিশদের শিক্ষা নীতি এবং জ্যোতিবাঁ ফুলে, সাবিত্রী ফুলে, ফতিমা, সাহু মহারাজ, হরিচাঁদ, গুরুচাঁদ, পেরিয়ার এবং আম্বেদকরের শিক্ষা আন্দোলন ঢেউয়ের মত আছড়ে না পড়লে সাধারণ মানুষের জ্ঞান হতনা এবং চুরিও ধরা পড়ত না। ব্রাহ্মণরা প্রথম থেকে জানত যে সাধারণ মানুষ শিক্ষিত হলে তাঁদের চোট্টামি ধরা পড়ে যাবে। আর সেই কারণেই তাঁরা ভারতের ভূমি সন্তানদের কাছ থেকে জমি, সস্ত্রধারণ ক্ষমতা এবং শিক্ষা কেড়ে নেয়। সংস্কৃতি ধ্বংস করে "চোরকাহিনীর" ফিউশন তৈরি করে এবং এই চুরিবিদ্যাকে ধর্মের সাথে যুক্ত করে সংস্কারের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়।
কিন্তু #ইতিহাস_তো #ইতিহাসের_নিয়মেই ঘটে! হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীকে ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা এবং ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করতে #বুদ্ধের_জন্ম হয়। সহস্র বছরের সঞ্চিত আবর্জনার পাহাড় গুড়িয়ে দিতে #জন্ম_নেয় #আম্বেদকর। আর এই বোধিসত্ত্বদের শান্ত, সমাহিত জ্ঞানের আলোতে সাধারণ মানুষ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
"চালাকির দ্বারা মহৎ কাজ সিদ্ধ হয়না"। অতি চালাকেরও গলায় দড়ি পড়ে। চোর নিজেকে যতই চালাক ভাবুক প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সে চৌর্যবৃত্তির নমুনা রেখে যায়। ধরা পড়ে। গলায়, পেটে দড়িও জোটে। কেউ কেউ লজ্জিত হয়! কেউ কেউ চৌর্যবৃত্তি ছেড়ে দেয়।
কিন্তু ব্রাহ্মণবাদী চোর?
আশ্চর্য হলেও সত্য যে #মনুষ্যন্যায়_এই_প্রজাতিটি চুরিবিদ্যাটি কিছুতেই ছাড়তে চায়না! চুরির সমর্থনে হাজারটা অজুহাত খাড়া করে! একটি মিথ্যে ঢাকা দিতে হাজার মিথ্যের বেসাতি সাজিয়ে বসে! আষাঢ়ে গল্প, গালগল্প, আজগুবি গল্প, দৈব গল্পের জাল বিস্তার করে চুরি বিদ্যার মহিমা কীর্তন করে চলে! নির্লজ্জ, বেহায়া দর্শনই ব্রাহ্মণবাদের প্রাণভোমরা। চুরি, জোচ্চুরি, জালিয়াতি, রাহাজানি ছাড়লে ব্রাহ্মণবাদ বাঁচেনা!
“দীপাবলি” এমনি একটি চুরির মাল, যা রামকাহিনী তৈরি করে হাইজ্যাক করা হয়েছে। বাল্মীকি রামায়ণের যুদ্ধকান্ডে বর্ণনা করা হয়েছে যে, ত্রেতা যুগে শ্রীরাম রাবণকে বধ করে চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন। শ্রীরামের চৌদ্দ বছর পরের প্রত্যাবর্তনের খুশিতে নাকি সারা রাজ্য জুড়ে দীপ জ্বালানো হয়েছিল! আর সেই আনন্দ উৎসবই নাকি দীপাবলি নামে পরিচিত!
বাল্মীকি রামায়ণের কাহিনীটি এমনঃ
রাম অযোধ্যা প্রত্যাবর্তনের আগের দিন মহর্ষি ভরদ্বাজের আশ্রমে অবস্থান কালে হনুমানকে অযোধ্যায় প্রেরণ করল। হনুমান ভরতকে জানাল যে, “ আপনি কল্য পুষ্যা-নক্ষত্র-যোগে রামকে দেখিতে পাইবেন”।
সত্যপরায়ণ ভরত সেই সম্বাদ শ্রবণ করিয়া প্রহৃষ্টচিত্তে শত্রুঘ্নকে কহিলেন, তুমি এই ঘোষণা কর যে, বিশুদ্ধবার ও শুদ্ধাচার ব্যক্তিগণ সুগন্ধি মাল্য দ্বারা কুলদেবতাদিগের মন্দির ও সাধারণ দেবালয় সমস্ত সুসজ্জিত করুক এবং সর্বত্রই বিবিধ বাদ্যযন্ত্র সকল বাজিতে থাকুক। স্তুতি ও পুরাণজ্ঞ সুতগণ, সকল বৈতালিক, নিপুণ বাদ্যকর ও গণিকা সকল এবং আমত্যবর্গের সমভিব্যাহারে আমাদিগের মাতৃগণ, স্ব স্ব স্ত্রীদিগের সহিত সৈন্যগণ, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, প্রধান প্রধান বৈশ্য ও জ্ঞাতিগণ, সকলেই রামচন্দ্রের চন্দ্রমুখ দর্শন করিতে সত্বর বিনর্গত হউক”। বাল্মীকি রামায়ন/যুদ্ধকান্ড/ একোনত্রিংশাধিকশততম সর্গ/ বসুমতি সাহিত্য মন্দির)
ভরতের কথা শুনে শত্রুঘ্ন ভৃত্যদের মধ্যে কাজ ভাগ করে দিল। নন্দীগ্রাম থেকে অযোধ্যা পর্যন্ত রাস্তা সমতল করে তাতে জল ছিটিয়ে দেওয়া হল। সব জায়গায় সুগন্ধি ফুল দিয়ে সাজানো হল। বিচিত্র পতাকায় মুড়ে নগরীর শোভা বাড়ানো হল। সূর্যোদয়ের আগে সমস্ত নগরীকে সুসজ্জিত করা হল। অর্থাৎ রামায়ণ কাহিনীতে নগরসজ্জার এই বহরে “দীপাবলী”র কোন উল্লেখ নেই। দিনের বেলাতেই সাধিত হয়েছিল রামের প্রত্যাবর্তন সমারোহ, রাতের বেলা নয়।
ভারতীয় প্রজাপুঞ্জের সমৃদ্ধির অন্যতম শোপান ছিল কৃষি। তাই কৃষিকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল লোকোৎসব। #কেরলের_ওনাম, #বাংলার_আড়ম বা আড়ং, #সোহারায়, #বাদনা এই জনপ্রিয় লোকোৎসবের পরম্পরা। এগুলি ধ্বংস করার জন্যই অকালবোধনের দৈবকাহিনী তৈরি করলেন কীর্তিবাস। আর এই সূত্র ধরে শারদীয় অমানিশার জীবকল্যাণের মঙ্গলময় একটি লোকোৎসব “দীপোদান”কে নরহত্যাকারী কালীপুজার সাথে যুক্ত করে হিংস্রতার “দীপাবলি”তে রূপান্তরিত করা হল। দীপাবলি তাই ভারতীয় সংস্কৃতি ধ্বংসের বিজয় উল্লাস এবং জালিয়াতির নির্লজ্জ আড়ম্ভর।
ব্রাহ্মণবাদে জালিয়াতির সীমা পরিসীমা নেই। যে রামের প্রত্যাবর্তন নিয়ে এত অসাড় কাহিনী এবং দীপাবলির রোশনাই ছড়ানো হচ্ছে বাল্মীকি রামায়ণে তা কি ভাবে আছে দেখে নিন। রামের বনবাস থেকে পুনরায় অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন নিয়ে যদি একটি কালপঞ্জি তৈরি করি তবে সেটি এমন দাড়াবেঃ
১) চৈত্র শুক্ল পঞ্চমীতে রামের বনবাস।
২) ষষ্ঠীতে শৃঙ্গবেরপুর গমন।
৩) সপ্তমীতে বনস্পতি মূলে অবস্থান।
৪) অষ্টমীতে ভরদ্বাজ আশ্রমে গমন।
৫) নবমীতে যমুনাতীরে গমন।
৬) দশমীতে চিত্রকূট পাহাড়ে গমন। সেই রাতে দশরথের মৃত্যু।
৭) একাদশীতে তৈলমধ্যে দেহরক্ষা। ভরতের আগমন। দশরথ দাহ।
৮) তের বছর কেটে গেলে চৈত্র মাসে সীতাহরণ।
৯) বৈশাখে সুগ্রীব মিলন।
১০) আষাঢ়ে বালিবধ।
১১) আশ্বিনে সৈন্য সজ্জা।
১২) ফাল্গুন চতুর্দশীতে লঙ্কাদাহ ।
১৩) ফাল্গুন অমাবস্যায় রাবণ বধ।
১৪) চৈত্র শুক্লপ্রতিপদে রাবণদহ।
১৫) চৈত্র মাসের দ্বিতীয়ায় সীতাপ্রাপ্তি।
১৬) তৃতীয়ায় লঙ্কা থেকে নির্গমন।
১৭) পঞ্চমীতে ভরদ্বাজ আশ্রমে অবস্থান।
১৮) পরের দিন অর্থাৎ চৈত্র মাসের ষষ্ঠীতে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন।
আশাকরি বন্ধুরা বুঝতে পারছেন যে শারদীয় অমানিশার সাথে রামায়ণ বর্ণিত রামের প্রত্যাবর্তনের কোন মিল নেই। এটি সম্পূর্ণ ভাবে একটি জালিয়াতি। রামায়ণে শ্রীরামচন্দ্রের অযোধ্যা প্রত্যাবর্তনের সময় চৈত্র মাস বা বসন্ত কাল। কাতি( কার্ত্তিক) মাসের অমানিশা বা শরৎ কাল নয়। আসলে ভারতের আদিবাসী সমাজের জনপ্রিয় উৎসব এবং পরম্পরাগুলিকে হাইজ্যাক করার জন্যই দখলদারেরা এই জালিয়াতির গল্প ফেঁদেছে এবং আইন সভা, বিচার সভা এবং প্রশাসনকে কবজা করে এই জালিয়াতির কারবার চালিয়ে যাচ্ছে।




Wednesday, 22 September 2021

ধর্ষণ এক বৈদিক শিষ্টাচার

 





“ধর্ষণ” 
হিন্দু সংস্কৃতির কত গভীরে শিকড় গাড়তে পারে তার উলঙ্গ উন্মোচন ঘটল ২০০২ সালে পাঞ্জাব হরিয়ানা হাইকোর্টের দাখিল করা একটি ধর্ষণ ঘটিত মামলার রায়ের মাধ্যমে। সিবিআই’এর উকিল জগদীপ সিং কোর্টের রায় পড়ে শোনানোর সঙ্গে সঙ্গে ধর্ষণ কেসের মূল আসামী ডেরা সাচা সৌদার স্বঘোষিত ঈশ্বর পুরুষ গুরমিত সিং রামরহিমের অন্ধ ভক্তরা যে ভাবে এই ধর্ষকের পক্ষ নিয়ে দুটি রাজ্যে প্রশাসনকে একেবারে অকেজ করে দিল এবং জনজীবনের মধ্যে প্রলয় সংকেত নামিয়ে আনল তা অবশ্যই ভারতরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের পক্ষে এক নৈরাজ্যের সংকেত।বলার অপেক্ষা রাখেনা যে কিছু রাজনৈতিক দলের সরাসরি মদতে এই নৈরাজ্য আরো ব্যপক আকার ধারণ করল।

প্রশ্ন আসছে এইভাবে নৈরাজ্যের বাতাবরণ তৈরি করে কি সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলগুলি ভারতের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চাইছে? ধ্বংস করে দিতে চাইছে ভারতের সংবিধান?
বিজেপির সাংসদ সাক্ষী মহারাজের বয়ানে কিন্তু সেই রকমই সংকেতের প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। তিনি ধর্ষক রামরহিমের পক্ষ নিয়ে এই দৈবপুরুষদের দ্বারা সাধ্বী বা নারিদের ধর্ষণ হওয়ার ঘটনাকে নৈতিক শিষ্টাচার বলে বর্ণনা করেছেন। শুধু তাই নয় তিনি ধর্ষকের বিরুদ্ধে আনা আদালতের রায়কে খারিজ করারও দাবী জানিয়েছেন। অর্থাৎ ভারতীয় ন্যায়ের শাসনকে ধুলিস্যাত করে তিনি ব্রহ্মার বিধান বা বেদের বিধানকে মান্যতা দেবার সংকেত দিয়েছেন এবং হিন্দু নৈতিক শিষ্টাচারের কথা উত্থাপন করেছেন। সম্ভবত উদ্ভূত সঙ্কট কালে সাক্ষী মহারাজের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে ব্রাহ্মন্য ধর্ম সংস্থাপনের একটি সুপ্রাচীন বার্তা।
কী এই নৈতিক শিষ্টাচার?
ভারতের একটি ন্যায়পালিকা একজন ধর্ষকের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার পর তাকে দোষী সাব্যস্ত করবেন এবং তার প্রাপ্য সাজা শোনাবেন এটাইতো নিয়ম। কিন্তু ন্যায়পালিকার সেই নিয়মকে ব্রাহ্মণ্য শিষ্টাচারের বিরুদ্ধে বলতে গেলেন কেন সাক্ষী মহারাজ? প্রশ্নটা এখানেই। কী সেই ব্রাহ্মণ্য শিষ্টাচার যা রামরহিমের মত দৈবপুরুষরা ধারণ করে আছেন? কি সেই অমোঘ ভিত্তি যা রামরহিমের মত ধর্ষকদের দৈব লীলার সাথে যুক্ত।
২০০২ সালে ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী মাননীয় অটলবিহারী বাজপায়ীকে লেখা পাঞ্জাবের এক সাধ্বীর চিঠিতে বোধ হয় এই প্রশ্নের খানিকটা উত্তর রয়েছে। সাধ্বী লিখেছেন, “আমি পঞ্জাব থেকে আসা মেয়ে। সিরসা (হরিয়ানা)-র ডেরা সচ্চা সৌদায় একজন সাধ্বী হিসেবে সেবা করে চলেছি গত ৫ বছর ধরে । আমার মতো আরও কয়েকশো মেয়ে এখানে রয়েছেন, যাঁরা প্রতি দিন ১৮ ঘণ্টা করে সেবা করে চলেছেন।
কিন্তু এখানে আমরা যৌন নির্যাতনের শিকার। ডেরায় মেয়েদের ধর্ষণ করেন ডেরা মহারাজ (গুরমিত সিংহ)। আমি একজন স্নাতক। ডেরা মহারাজের উপরে আমার পরিবারের অন্ধ বিশ্বাস। পরিবারের সেই অন্ধবিশ্বাসের জেরেই আজ আমি একজন সাধ্বী। সাধ্বী হওয়ার বছর দুয়েক পর এক দিন রাত ১০টা নাগাদ হঠাৎ এক মহিলা ভক্ত আমার ঘরে আসেন। জানান, মহারাজ আমাকে ডেকেছেন। মহারাজ স্বয়ং ডেকে পাঠিয়েছেন শুনে খুব উচ্ছ্বসিত হয়ে পড়েছিলাম। সাধ্বী হওয়ার পর সেটাই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাৎ। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে তাঁর ঘরে ঢুকি। দেখলাম ওনার হাতে একটা রিমোট এবং টিভিতে তিনি ব্লু ফিল্ম দেখছেন। বিছানায় তাঁর বালিশের পাশে একটা পিস্তল রাখা ছিল। এ সব দেখে আমি ভয় পেয়ে যাই। ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছিলাম। এর পর মহারাজ টিভিটা বন্ধ করে দেন। আমাকে ঠিক তাঁর পাশে নিয়ে গিয়ে বসান। খাওয়ার জন্য এক গ্লাস জল দেন। তার পর খুব আস্তে করে বলেন, ডেকে পাঠানোর কারণ আমাকে তিনি নিজের খুব কাছের বলে মনে করেন। এটাই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা।
এর পরই তিনি এক হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে তাঁর আরও কাছে টেনে নেন। কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলেন, আমাকে তিনি হৃদয়ের গভীর থেকে ভালবাসেন। আমার সঙ্গে সহবাস করতে চান। বলেন, তাঁর শিষ্যা হওয়ার সময়ই আমার সমস্ত সম্পদ, আমার শরীর এবং আত্মা তাঁর কাছে উৎসর্গ করেছি এবং তিনি তা গ্রহণও করেছেন। আমি বাধা দিলে তিনি বলেন, ‘আমি ঈশ্বর, এতে তো কোনও সন্দেহ নেই’। আমি তাঁকে বলি, ঈশ্বর কখনও এ রকম করেন না। আমাকে বাধা দিয়ে তিনি বলেন:
১) শ্রীকৃষ্ণও ঈশ্বর। তাঁর ৩৬০ জন গোপী ছিলেন। যাঁদের সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণ প্রেমলীলা করতেন। আমাকেও সবাই ঈশ্বর বলে মানে। এতে এত অবাক হওয়ার কিছু নেই”। ( রাম রহিমের বিরুদ্ধে সাধ্বীর সেই চিঠি, পড়লে শিউরে উঠবেন ঃ নিজস্ব প্রতিবেদন, আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৬ অগস্ট, ২০১৭, ১৩:৪৫:৫৬)।
হ্যা, এটাই দৈবপুরুষদের লীলা এবং বেদের শিষ্টাচার এই লীলাকেই মান্যতা দিয়েছে। ঋকের একেবারে প্রথম দিকের শ্লোক বা গায়ত্রীর মন্ত্র (Mandala 3.62.10) বা বীর্যমন্ত্র। গায়ত্রীকে ভাষাতাত্ত্বিক ভাবে বিশ্লেষণ করলেই বুঝতে পারা যায় যে পরাজিত দেশের সব নারী এবং অনুঢ়া মেয়রা (যস্যবিতুবরেন্যায়ম ভর্গোদেবস্যধীমোহি। ধীয়োযোনা প্রচোদায়ত।) যাদের রাজার মৃত্যু হয়েছে এবং ন্যায়ের শাসন ধ্বংস হয়ে গেছে তারা দেবতাদের ভোগ্য হবে। অথবা যে রাজা নিঃসন্তান তিনি পুত্রকামষ্ঠী যজ্ঞের মাধ্যমে দেবপুরুষ বা ঋষিদের দ্বারা নিজ পত্নীগণের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে পারবেন।
বেদের এই পারম্পরিক শিষ্টাচারের রাজসূয় ব্যবস্থা দেখা যায় রামায়ণের বালকাণ্ডে। যেখানে নিঃসন্তান রাজা দশরথ ঋষ্যশৃঙ্গ নামক দেবপুরুষকে দিয়ে নিজের চার পত্নীর গর্ভে সন্তান উৎপাদন করেন। বেদধ্যয়নরত বৈদিক ঋষিদের স্ত্রীসহবাস সুখ অবগত করার জন্য পরমাসুন্দরী রমণী বা বরাঙ্গনাদের সহযোগিতা নেওয়া হত তাও বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে রামায়ণের বালকান্ডে।
মহাভারতেও একই ভাবে ঋষিক্রিয়ার এই বৈদিক শিষ্টাচার আমরা দেখতে পাই আদিপর্বে। বিচিত্রবীর্যের অকাল মৃত্যু হলে মা সত্যবতী ভাইয়ের পরমাসুন্দরী স্ত্রীদের গর্ভে ভীষ্মকে সন্তান উৎপাদন করে পিতার বংশ রক্ষা করার অনুমতি দেন। ভীষ্ম দারপরিগ্রহ না করার পূর্ব সংকল্প হেতু সত্যবতীর এই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন কিন্তু ক্ষেত্রজ উৎপাদনের বৈদিক দৃষ্টান্তের ব্যাখ্যা করে কোন ব্রাহ্মণ বা ঋষির দ্বারা ভাইয়ের স্ত্রীদের গর্ভে সন্তান উৎপাদনের আদেশ দেন। ভীষ্ম আরো বলেন যে এই ক্ষেত্রজ গ্রহণ ধর্মানুবদ্ধ, অর্থানুবদ্ধ এবং কামানুবদ্ধ।
এরপর মা সত্যবতী দৈবপুরুষ ঋষি ব্যাসকে দিয়ে তার পুত্রবধূদের নিষিক্ত করেন। অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্র এবং অম্বালিকার গর্ভে পা্রেন্র জন্ম হয়। মা সত্যবতী নিজের দাসীকেও ব্যাসদেবের দ্বারা নিষিক্ত করেন এবং সেই দাসী বিদুর নামে এক বুদ্ধিমান, জ্ঞানী পুত্রের জন্ম দেন।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে মা সত্যবতীও যৌবনে পরাসর নামে এক ঋষির কামনার শিকার হয়ে দীপের মধ্যে একটি সন্তানের জন্ম দেন। যে সন্তান ছিলেন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ। কৃষ্ণবর্ণ শরীর এবং দীপে জন্মানো এই সন্তান বেদভ্যাসের দ্বারা মহাপাণ্ডিত্য অর্জন করেন; তাই তার নাম হয় কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস। আর এই বেদব্যাসের জন্মদাত্রী ধর্ষিতা মায়ের নাম ছিল মৎসগন্ধা।ভীষ্মের পিতা শান্তনু তাকে বিয়ে করেন। রাজমহিষী হিসেবে তার নাম হয় সত্যবতী।

ঋষিক্রিয়া বা ঋষভ ক্রিয়ার উৎপত্তিঃ
বাজারে ধর্মের ষাঁড় ছেড়ে দেবার একটা লোকায়ত প্রথা আছে। নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভিতর এইসব ষাঁড়েরা ঋতুবতী গাভীদের নিষিক্ত করে। কৃষিজীবী মানুষেরা উন্নতমানের গোকুল বাড়ানোর জন্য সহমতের ভিত্তিতে এটা করে থাকতো এক কালে। বিনিময়ে ষাঁড় পেত অবারিত মাঠ। যত্র তত্র বিচরণের অবাধ ছাড়ত্র। ঋতুবতী গাভীদের সঙ্গে সহবাসের অধিকার। এখনো কৃষি প্রধান এলাকার এটাই প্রচলিত প্রজনন বিদ্যা। ঋতুবতী গাভীদের ডিম্বাণুর সাথে ধর্মের ষাঁড়দের শুক্রাণুর নিষিক্ত করণের এই ক্রিয়া প্রক্রিয়াকে ঋষি ক্রিয়া বলতে পারেন। তাই সংস্কৃত ভাষায় নির্দিষ্ট গোয়ালহীন ধর্মের ষাঁড়দের ঋষভ বলা হয়।

ভারতীয় জনপুঞ্জের এই লোকায়ত বিদ্যাটিকে বৈদিক যাযাবরেরা গভীর ভাবে অধ্যায়ন করে। আত্মস্থ্য করে এবং তাদের সামাজিক আচারের সাথে একেবারে অঙ্গীভূত করে নেয় এবং উন্নত মানবকুল বাড়ানোর জন্য ব্যভিচারে সম্মত ও সামর্থ মানুষকে ঋষি ক্রিয়াতে উদ্বুদ্ধ করে ময়দানে নামায়। পাশাপাশি ভরণ পোষণের নৈবেদ্য জুটতে থাকে লোকালয় থেকে। লোকালয়ের থেকে দূরে এই সব ঋষিগণ যখন যেমন খুশি যার তার সাথে যৌনাচারের স্বীকৃতি পায়।
ঋষভ ক্রিয়া ধর্মানুবদ্ধঃ
এই যে ঋষিক্রিয়া বা যৌনাচার বৈদিক সমাজে এমন এক উচ্চ শিষ্টাচারে পউছেছিল যে পাত্রী নির্বাচনে বৈদিক ঋষিদের মা,মাসি, কন্যা, ভাই, বোন বলে কোন বাদবিচার ছিল না বরং এই যৌনাচারকে ধর্ম সম্মত করে নানা শাস্ত্র প্রণয়ন করে। বৈদিক শাস্ত্রেই দেখা যায় যে, ব্রাহ্মণদের আদিপিতা ব্রহ্মা তার নিজের মেয়ে সরস্বতীকে ধর্ষণ করছে, এবং তার গর্ভে গর্ভ সঞ্চার করছে। সরস্বতী এবং ব্রহ্মার সন্তান স্বয়ম্ভূ মনু তার নিজের মা সরস্বতীর(শতরূপা ) সাথে যৌনাচারে লিপ্ত হচ্ছে, সন্তান উৎপাদন করছে।
“Saraswati Purana”. One is that Brahma created his beautiful daughter Saraswati direct from his “vital
strength” or seminal fluid. The other is that Brahma used to collect his semen in a pot whenever he masturbated fixing his carnal eyes on the celestial beauty Urvasi. Brahma’s semen in the pot gave birth to Saraswati. Thus,Saraswati had no mother.
This daughter or grand-daughter of Brahma is the Hindu goddess of learning. When Brahma saw the beauty of Saraswati he became amorous. To escape from her father’s passionate approach Saraswati ran to the lands in all four directions, but she could not escape from her father. She succumbed to Brahma’s wish. Brahma and his daughter Saraswati lived as husband and wife indulging in incest for 100 years. They had a son Swayambhumaru. Swayambhumaru made love with his sister Satarpa. Through the incest of Brahma’s son and daughter Brahma got two grandsons and two grand-daughters.
আর একটি সূত্র হলঃ
“Prajapati(Brahma) desired his daughter( SARASWATI) and made love to her. This was a sin in the eyes of the gods, who said to the god who rules over beasts [Pasupati, Rudra], ‘He commits a sin, acting in this way towards his own daughter, our sister. Pierce him.’ Rudra took aim and pierced him. Half his seed fell to the ground. The gods cured Prajapati and cut out Rudra’s dart, for Prajapati is the sacrifice. To utilize [the seed], the gods said, ‘Take care that this may not be lost, but that it may be less than the oblation.’ They gave it to Bhaga to eat, but it burnt his eyes and he became blind. Then they gave it to Pusan to eat, but it knocked out his teeth. At last they gave it to Savitr [the sun] and it did not injure him, for he appeased it.” — Ref : Satapatha Brahmana 1:7:4:1-7.

বৈদিক এই শিষ্টাচার বা যৌন সংস্কৃতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যে, একজন ঋষি যৌনাচারে লিপ্ত হলে অন্যজন কুকুরের মতো অপেক্ষা করতো বা দলবদ্ধ ভাবে যৌনাচারে লিপ্ত হত।
অনেক নারী কোলের থেকে বাচ্চা নামিয়ে রেখে ঋষির যৌন ক্ষুধা মেটাতে বাধ্য হত। এমনি এক ঘটনার শিকার হয়েছিল যাজ্ঞবল্ক। ধর্ষিতা যবালা পুত্র সত্যকাম তো তার বাপের নামই বলতে পারেনি! এই ধর্মাচার এমন মহান হয়ে উঠেছিল যে, রাজারা পুত্র কামনার জন্য এই সব ঋষিদের ভাড়া করে রাজসূয় যজ্ঞের আয়োজন করে তাদের স্ত্রীদের গর্ভে ঋষিদের বীর্য পাত ঘটিয়ে তেজস্বী সন্তান উৎপাদন করতেন।

এই ঋষভ ক্রিয়া বা মহাযজ্ঞ বৈদিক যাযাবরদের ধর্মাচরণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। উন্নত মানবকুল বাড়ানো বীজমন্ত্র। ঋষি সংস্কৃতির আদি নাদ।
বিবর্তনের সাথে সাথে এই ঋষভ সংস্কৃতি জনগণের মধ্যেও প্রথিত করতে সামর্থ হয়েছিল বৈদিক যাযাবরেরা। স্থায়ী ভাবেগোটা ভারতকেই ঋষিদের চারণভূমিতে পরিণত করতে পেরেছিল এই বৃত্যিজীবিরা।

বৌদ্ধ বিহারগুলি দখল করে সেগুলিকে মন্দিরে পরিণত করা (মন্দির = মন্দ+ইর বা মন্দ কামনা বাসনা চরিতার্থ করার সুরক্ষিত স্থান।)পরিণত করা,মন্দিরের মধ্যে দেবদাসী প্রথার প্রবর্তন,মন্দির সংলগ্ন এলাকাকে বেশ্যা পল্লী বানানো, গুরুকরণী প্রথার নামে কিশোরীদের দিনের পর দিন ধর্ষণ করা,কুল রক্ষার নামে বহু বিবাহ চালিয়ে যাওয়া, এ সকলই ঋষভ সংস্কৃতির গলিত দুর্গন্ধময় বর্জ্য। বৈদিক যাযাবরদের ঈশ্বর,দেব, দেবী বা ঋষিদের একালের বংশধর রজনিস, সাইবাবা, বাবা নিত্যানন্দ, রবিশঙ্কর, রামদেব এই বর্জ্য পদার্থের কারবারী।
এই গুরমিত সিং রামরহিম, আশারামেরা একালে ধর্মের ষাঁড়। বর্তমানের দৈবপুরুষ যৌনাচারী প্রাচীন ঋষভ ধারাকেই এরা বেগবান করে তুলেছে। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের দ্বারা প্রতিদিন চলছে প্রস্তুতি। ধর্ষণের প্রস্তুতি। ধ্বংসে প্রস্তুতি। রামরহিমকে ধর্ষক হিসেবে সাব্যস্ত করার পর পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা জুড়ে যে তান্ডব দেখা গেল তা পরিকল্পিত মহাপ্রলয়ের একটি মহড়া মাত্র। মনুবাদীরা নিরঙ্কুশ ভাবে ভারতের প্রত্যেক প্রদেশে ক্ষ্মতায় আসলে এই ভয়ঙ্কর প্রলয় নেমে আসবে। আর সেই প্রলয়ের মধ্য দিয়েই ধর্ম সংস্থাপন করতে নেমে আসবেন আর এক অবতার।

Monday, 23 August 2021

বাংলার আদিবাসী-১

 #SC_ST_OBC আমরা সবাই #আদিবাসী

সম্প্রতি আদিবাসী পরিচয় নিয়ে বেশ কিছু জনজাতির মধ্যে নানা ধরণের বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। এই বিতর্ক নিরসন করার জন্যই এই তথ্য ভিত্তিক লেখা। আশাকরি এই তথ্যগুলি আদিবাসী-মূলনিবাসী বহুজন আন্দোলনে সহায়ক হয়ে উঠবে।
বাংলার আদিবাসী-১
নৃতত্ত্ববিদেরা মেনে নিয়েছেন যে ভারতের জনাধারের প্রথম সোপানটি নির্মাণ করে নেগ্রিটো জন। উত্তর_পূর্বের আন্দামান থেকে আসাম এবং দক্ষিনের পেরাম্বকুলাম, আন্নামালাই অঞ্চলের পুলায়ান জাতির মধ্যে এই নেগ্রিটো রক্ত প্রবাহ এখনো বর্তমান।
হাটন সাহেব, বিরজাশঙ্কর গুহ, হারানচন্দ্র চাকলাদার, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, তারকচন্দ্র রায়চৌধুরী, গেইট এবং রিজলি সাহেবদের নরতাত্ত্বিক গণনা থেকে জানা যায় যে বিহারের রাজমহল পাহাড়ের আদিম অধিবাসীদের মধ্যেও কিছু কিছু মানুষের মধ্যে এই নেগ্রিটো জনের রক্ত প্রবাহ রয়েছে। বাংলার পশ্চিম প্রান্তে বাগদী এবং সুন্দরবন অঞ্চল থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত তটভূমি সংলগ্ন মৎসজীবীদের মধ্যে নেগ্রিটো জাতির দেহ বিশিষ্ট লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ নিম্নবঙ্গের নদীনালা, খালবিল ঘেরা জনপদগুলি যারা গড়ে তোলেন তাঁরা এই নেগ্রিটো জনের প্রতিনিধি।
"নিম্নবর্ণের বাঙালী এবং বাংলার আদিম অধিবাসীদের ভিতর যে জনের প্রভাব সব চেয়ে বেশি, নৃতত্ত্ববিদেরা তাহাদের নামকরণ করিয়াছেন আদি-অস্ট্রেলীয় (proto-Australoid)। তাহারা মনে করেন যে এই "জন" এক সময়ে মধ্য-ভারত হইতে আরম্ভ করিয়া দক্ষিণ-ভারত, সিংহল হইতে একেবারে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।" (রায়/দেজ পাবলিশিং/১৩৫৬/৩৩পাতা)
বঙ্গদেশের ৩৬ জাতিঃ
খ্রীস্টীয় ত্রয়দশ শতকে দুটি গ্রন্থে বাংলার আদিম অধিবাসীদের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই দুটি গ্রন্থ হল বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ। সংস্কৃত সাহিত্যের ১৮টি পুরাণের মত এই দুইটি পুরাণের লেখকও কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস! অনুমান করা হয় এই দুটি গ্রন্থই রাঢ়দেশে রচিত। বৃহদ্ধর্মপুরাণ ব্রাহ্মণ ছাড়া বাংলার অধিবাসীদের যে তালিকা দিয়েছে তা নিচে সংযুক্ত করা হলঃ
১) উত্তম সংকর বিভাগঃ করণ( সৎশুদ্র), অম্বষ্ঠ( বৈদ্য), উগ্র, মাগধ, গান্ধিক, বণিক, শঙ্খ বণিক , কাসারি, কুমোর , তাঁতি, কামার, গোয়ালা, দাস( চাষি), রাজপুত, নাপিত, মোদক, বারুজীবী, সূত্রধর (ছুতার), মালাকার, তাম্বুলি এবং তৌলিক।
২) মধ্যম সংকর বিভাগঃ তক্ষক, রজক, স্বর্ণকার, স্বর্ণবণিক, আভীর, তেলি, ধীবর, শৌণ্ডিক( শুঁড়ি), নট, শাবক, শেখর ও জালিক।
৩) অন্তজ বা অধম সংকরঃ মলেগ্রহী, কুড়ব, চণ্ডাল, বড়ুর, চর্মকার, ঘণ্টজীবী, ডোলাবাহী, মল্ল ও তক্ষ।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ রাঢ়দেশে রচিত হলেও কেন বঙ্গদেশের জাতি তালিকায় শবর, সাঁওতাল, ভূমিজ, পাহাড়িয়া প্রভৃতি কৌম জাতির উল্লেখ করা হলনা তা জিজ্ঞাসু জনের কাছে এক বিস্ময় বটে! সম্ভবত ঘোরতর জাতি বিদ্বেষের জন্যই গ্রন্থকার এই জাতিগুলির অস্তিত্ব স্বীকার করেননি। কারণ আর্যাবর্ত এবং অন্যান্য প্রদেশগুলির মতই বৃহৎবঙ্গের জনবিন্যাস, ভাষা, সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে ব্রাহ্মণবাদের বিজয়কেতন উড়ানোই ছিল তাঁদের আসল উদ্দেশ্য।
হান্টার কমিশনের রিপোর্টঃ ত্রয়দশ শতকে বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে শবর, ভুমিজ, মালে, মুন্ডা ও সাঁওতালদের উল্লেখ না থাকলেও ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত হান্টার কমিশনের রিপোর্টে এই কৌম্য জাতিগুলির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। এই রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, বীরভূম, সিংভূম, ধলভূম সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় সাঁওতাল, মুন্ডা, জাওরা পাহাড়িয়া সহ অসংখ্য আদিবাসী সমূদয়ের নিবাস ছিল। ১৭৭০-১৭৯০ সালের খরা ও মন্বন্তরের জন্য এই আদিবাসী সমুদায় রাজমহল পাহাড়ের দিকে আসতে শুরু করে। এই আদিবাসী সমুদায়ের মধ্যে সাঁওতালরা ছিল সব থেকে শক্তিশালী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ। বড়লাট বেন্টিংক পাহাড়িয়াদের দমন করার জন্য রাজমহল পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে সাঁওতালদের বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। হান্টার উল্লেখ করেছেন যে ১৭৭০ থেকে শুরু করে ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত “দামন-ই কোহ” তে বা রাজমহাল পাহাড়ের "আঁচল" ঘিরে এই মাইগ্রেশন চলে এবং প্রায় ১৫০টি সাঁওতাল গ্রামের পত্তন হয়।

বাংলার কৌম্য জাতির নৃতাত্ত্বিক গণনাঃ
উনবিংশ শতকের শেষ ভাগে বাংলার আদিম আদিবাসীদের নিয়ে একটি নৃতাত্ত্বিক গবেষণা শুরু হয়। এই গবেষণায় অংশগ্রহণ করেন বিরজাশঙ্কর গুহ, হারানচন্দ্র চাকলাদার, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, তারকচন্দ্র রায়চৌধুরী, গেইট এবং এইচ এইচ রিজলি।
এই গবেষকদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের ছোট ভাই ডঃ ভুপেন্দ্রনাথ দত্ত সাঁওতাল, ভূমিজ, বাউরী, বাগদী, লোহার, মাঝি, তেলি, সুবর্ণ এবং গন্ধ বণিক, ময়রা, কলু, তাঁতি, মাহিষ্য, তামলি, নাপিত এবং রজকদের নিয়ে গবেষণা করেন।
রিজলি সাহেব সদগোপ, রাজবংশী, মুচি, মালী, কৈবর্ত, গোয়ালা, চণ্ডাল, বাউরী, বাগদী এবং মুসলমানদের নিয়ে গণনা করেন। ১৮৯২ সালে প্রকাশিত হয় রিজলি সাহেবের বিখ্যাত গ্রন্থ "The Tribes and Castes of Bengal"। নৃতাত্ত্বিক গবেষণার এই গ্রন্থে পরিষ্কার করে উল্লেখ করা হয়েছে যে ব্রাহ্মণ ছাড়া এই বাংলার সমস্ত কৌমজাতিগুলিই অস্ট্রিক, দ্রাবিড় এবং মঙ্গোলয়েড জনজাতির অংশ। এঁদের মধ্যে উত্তম সংকর জাতি বা
সৎ শূদ্র জাতি করণ(কায়স্থ) এবং বদ্যি জাতিও ভারতের বহুজন সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
আর্যপূর্ব ভারতের আদিবাসীদের এখন নানা ক্যাটেগোরিতে ভাগ করা হয়েছে। এই ক্যাটেগোরিগুলি হলঃ 1) SC/ST এবং 2) OBC। দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে MBC বা মোস্ট ব্যাকোয়ার্ড ক্লাস হিসেবে যারা তালিকায় যুক্ত হয়েছেন তারাও ভারতের আদিবাসী। তথ্য সূত্রঃ ১) রায়/ বাঙ্গালীর ইতিহাস/ দেজ পাবলিশিং/১৩৫৬
২) সুর/বাঙলা ও বাঙালীর বিবর্তন/ সাহিত্য লোক
৩) সেন/বৃহৎ বং/দেজ পাব্লিশিং/১৩৪১
৪) Risley/ The Tribes and Caste of Bengal/1892
৫) শাস্ত্রী/ বৌদ্ধ গান দোহা
৬) বন্দ্যোপাধ্যায়/বাংলা সাহিত্য প্রসঙ্গে

Tuesday, 29 June 2021

অবৈধ অনুপ্রবেশকারী –এক নিপাট ষড়যন্ত্র

 

শরদিন্দু উদ্দীপন, কোলকাতা

 ২০১৬ সালে বিজেপি সরকারের আনা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের উপর তৈরি  হল  জয়েন্ট পার্লামেন্ট্রি  কমিটির বা জেপিসি'র একটি রিপোর্ট। বিজেপি পুনরায় ক্ষমতাসীন হয়েই  ৭ই জানুয়ারী, ২০১৯ লোকসভা এবং রাজ্য সভার উভয় কক্ষে পেশ করল এই রিপোর্ট। এই রিপোর্টে দাবী করা হল যে, বিভিন্ন সংগঠন, এনজিও, জ্ঞানীগুণী মানুষের বিচার, বিবেচনা সম্বলিত ৯০০০ মেমোরান্ডাম গ্রহণ করার পর এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে জয়েন্ট পার্লামেন্ট্রি  কমিটির চেয়ারপার্সন রাজেন্দ্র আগরওয়াল জানালেন যে এই কমিটি রিপোর্ট রচনার জন্য তিনটি শিক্ষামূলক ভ্রমণ করা হয়েছে এবং অভিবাসী, এনজিও, জনপ্রতিনিধি এবং সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে স্থানীয় স্তর থেকেই প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে কমিটির প্রতিনিধিরা ২০১৬ সালের ১৮ থেকে ২০শে ডিসেম্বর রাজস্থানের যোধপুর এলাকার তথ্য সংগ্রহ করেছেন, ২০১৭ সালের ১৮ থেকে ২০ এপ্রিল আহমেদাবাদ এবং রাজকোট ভ্রমণ করেছেন এবং ২০১৮ সালের ৭ থেকে ১১ই মে গুয়াহাটি, শিলচর এবং শিলং ক্ষেত্র সমীক্ষা করেছেন অর্থাৎ এই কমিটি নাগরিকত্ব আইনের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সেকশন -২ এর ক্লজ (i) এবং ক্লজ (ii) সংশোধনের ক্ষেত্রে যে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর (Illegal migrant)  ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে তাঁদের চিহ্নিত করার জন্য পশ্চিমবঙ্গকে বাদ রেখেছেন যেহেতু ভারতের সব রাজ্যে এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে Intelligence Bureau (IB) এবং Research and Analysis Wing (RAW) এর সাহায্য নেওয়া হয়েছিল তাতে নিশ্চিত করে বলা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গে কোন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর অস্তিত্ব নেই এই তথ্য জয়েন্ট পার্লামেন্ট্রি  কমিটি জানতেন

অবৈধ অনুপ্রবেশকারী প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গের নাম নেই কেন তার জবাবে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও বলেছিলেন যে, কংগ্রেস, বামফ্রন্ট এবং তৃণমূল সরকার পশ্চিমবঙ্গের সকলকেই নাগরিকত্ব দিয়ে দিয়েছেন কোন অবৈধ অনুপ্রবেশকারী তালিকা পশ্চিমবঙ্গে নেই

 তবে কাঁদের জন্য ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনা হল?

এই প্রশ্নে জয়েন্ট পার্লামেন্ট্রি  কমিটি তার রিপোর্টে উল্লেখ করলেন, “আমাদের সংগৃহীত নথি অনুসারে  সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৩১,৩১৩ জন ( হিন্দু-২৫৪৪৭, শিখ-৫৮০৭, খ্রীস্টান৫৫, বুদ্ধিস্ট-২ এবং পারসি-২) ব্যাক্তি আছেন যারা ধর্মীয় নিপীড়নের জন্য তাঁদের দেশ থেকে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। তাঁরা ভারতের নাগরিকত্ব  পাবার জন্য দাবি করেছেন এবং আবেদন করেছেন। দাবি অনুসারে তাঁদেরকে দীর্ঘমেয়াদী ভিসা প্রদান করা হয়েছে এবং এই মানুষেরাই সুবিধা পাবেন।   

কেন মাত্র এই ৩১,৩১৩ জনকে সুবিধা দেবার জন্য ২০১৯ সালের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল আনা হল? এই প্রশ্নের উত্তরে আইবি এর ডিরেক্টর পরিষ্কার খোলসা করলেন যেঃ “হ্যা, এঁরাই সুবিধা পাবেন, কারণ এঁরা দাবী করেছেন এবং আবেদন করেছেন।“          

এর পরে আইবি এর ডিরেক্টর দেশের অন্যান্য মানুষের ক্ষেত্রে খোলসা করে বললেন যেঃ   


“আরো অনেক মানুষ থাকতে পারেন এবং তাঁরা হয়ত বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করে দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে নিয়েছেন। তাঁদের হয়ত পাসপোর্ট, রেশন কার্ড আছে। অন্য আরো সমস্ত ডকুমেন্ট হয়ত তাঁরা পেয়ে গেছেন এবং হয়ত ইতিমধ্যেই তাঁরা তাঁদের নাম ভোটার তালিকায় নথিবদ্ধ করে নিয়েছেন। বাস্তবিক ক্ষেত্রে অবশ্যই তাঁরা এই দেশের নাগরিক। যদি কেউ অবৈধ উপায়ে এই সকল প্রমানাদি সংগ্রহ করে থাকেন তবে তা খুঁজে বার করার জন্য ট্রাইব্যুনাল আছে। সেটা সম্পূর্ণ আলাদা বিষয়। এই বিল তাঁদের জন্য যারা আবেদন করেছিলেন এবং যারা দাবী করেছিলেন যে ধর্মীয় নিপীড়নের জন্য তাঁরা তাঁদের দেশ থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।“       

অর্থাৎ একদিকে তিনি বিভিন্ন উপায়ে নাগরিকত্ব অর্জনকারী মানুষদের আশ্বস্ত করলেন অন্য দিকে তাঁরা অবৈধ উপায়ে এই নাগরিকত্ব অর্জন করেছেন কি না তা ট্রাইবুনাল খুঁজে বার করবে বলে আতংকের খাঁড়া ঝুলিয়ে রাখলেন!   

অনুপ্রবেশকারী বলে কাঁদের টার্গেট করেছিল বিজেপি?

এই হাড় হীম করা নিষ্ঠুর চক্রান্তের খবর মতুয়া সমাজ এখনো বুঝতে পারছে না! তাঁদের মধ্যে কিছু নেতা এমএলএ, এমপি হবার স্বপ্নে এমন বিভোর হয়ে আছেন যে তাঁরা জাতির গলায় এনআরসির ফাঁস লাগিয়ে বিজেপি এবং আরএসএস এর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়ে চলেছেন। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে বিজেপির টিকিট কিনছেন। কেউ কেউ আবার  আম্বেদকরবাদী মুখোশ চড়িয়ে অনবরত দেশভাগের বলি মানুষদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন এবং সরাসরি বিজেপির তোলা “অবৈধ অনুপ্রবেশকারী” তত্ত্বকে মান্যতা দিয়ে  প্রচার করে চলেছেন! এই সুচতুর সুবিধাবাদীর দল জাতির আবেগ কাজে লাগিয়ে দু’একটি সেমিনার করে মতুয়াদের এমন ধোঁকা দিয়ে চলেছেন যে সুধী সমাজ এই হাড় হীম করা চক্রান্তের টিকিটিও ধরতে পারছেন না!  

কী ছিল এই চক্রান্ত? রোহিঙ্গাদের সাথে কেন জুড়ে দেওয়া হয়েছিল ২ কোটি বাংলাদেশীর  নাম? এটা কি শুধু রাজনৈতিক শ্লোগান না মানুষকে বেঘর, বেনাগরিক করার নীল নকশা তার উপরেই এখন আলোকপাত করতে চাই।   

১৯/০৭/২০১৬ তারিখে বিজেপি সরকার লোক সভাতে, ভারতের নাগরিকত্ব  আইন-১৯৫৫ এর দ্বিতীয়  অধ্যায়ের সেকশন -২ এর ক্লজ (i) এবং ক্লজ (ii) সংশোধনের জন্য বিল আনলেন। এই বছরের ১৮ই ডিসেম্বর থেকে ভারতের ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো (আইবি)  এবং রিসার্স এন্ড আনালিসিস উইং(র) এর সহযোগিতায় শুরু হয়ে গেল অবৈধ অনুপ্রবেশকারী (Illegal migrant) চিহ্নিত করণের অভিযান। এই অভিযানে  অবৈধ অনুপ্রবেশকারী (Illegal migrant) চিহ্নিতকরণে জন্য ভোটার তালিকা, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, পাসপোর্ট প্রভৃতি   যে যে মাপকাঠি রাখা হয়েছিল তার ভিত্তিতে ৩১,৩১৩ জন মানুষের নাম নথিভুক্ত করা হয়। এই তালিকার বাইরে আর কেউ আছে কিনা তাঁদের খুঁজে বার করার জন্য ট্রাইব্যুনালকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়।  

২০১১ সালের সেনসাস, ২০১৫ সালের এনপিআর, ২০১৬ সালের হাউজহোল্ড সার্ভে, আইবি রিপোর্ট এবং রিসার্স এন্ড আনালিসিস উইং(র) এর অনুসন্ধান থেকে জানা যায় যে পশ্চিমবঙ্গবাসীদের অধিকাংশের কাছেই এই প্রমানপত্র এবং নথি আছে। এখানে কেউ অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারও ঘোষণা করেন যে মতুয়া, নমশূদ্র এবং অন্যান্যরা সবাই ভারতের নাগরিক। বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলি এবং কংগ্রেসও এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর তত্ত্ব খারিজ করে দেয়।

দুর্জনের ছলের অভাব হয়না। অসমে এই চাতুরিতে বিজেপি সফল। তাই অসমের আদলে ট্রাইব্যুনাল এবং সুপ্রিমকোর্টকে সামনে রেখে পরিকল্পিত হল এক বীভৎস ষড়যন্ত্র! ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের সামনে রেখে মতুয়া এবং নমশূদ্রদের চিহ্নিত করার জন্য এই জাল ছড়িয়ে দেওয়া হল। হিন্দু-মুসলিম অসহিষ্ণুতাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে যাবার জন্য রোহিঙ্গাদের সামনে রাখা হল যাতে ধর্মপ্রাণ মতুয়াদের মধ্যে দেশ বিভাজনের নিদারুন যন্ত্রণাকে চাগিয়ে দেওয়া যায় এবং ধর্মের আফিংয়ে  উন্মত্ত করে নির্বিঘ্নে এই চিহ্নিতকরণের কাজ সমাপ্ত করা যায়।  

১২ই ডিসেম্বর ২০১৯। “দি গেজেট অফ ইন্ডিয়া”তে প্রকাশিত হয় “নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন-২০১৯”। মতুয়ারা জানতেও পারেননা যে এই সংশোধনী আইনের কোথাও তাঁদের নাগরিকত্ব দেবার প্রতিবিধান রাখা হয়নি । তবুও রটিয়ে দেওয়া হয় যে, মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেবার জন্য এই সংশোধনী আইন পাশ করা হয়েছে। রুলস প্রকাশিত হলে নিজেকে শরণার্থী হিসেবে ঘোষণা করে আবেদন করলেই মতুয়ারা নাগরিকত্ব পেয়ে যাবেন।

 মতুয়ারা বেজায় খুশি। “নাগরিকত্ব পাইয়া গিছি” বলে পান চিবোতে শুরু করলেন লোককবির দল। ইতিমধ্যেই তাঁরা ঢোল, কাঁসি বাজিয়ে দিল্লীর যন্তরমন্তরে বিজেপির প্রশংসায় ধুয়াগান পরিবেশন করে এসেছেন। সোহাগে ঢলে পড়েছেন বিজেপি সাংসদদের গায়। ইতিহাসে নাম লেখাতে ছুটে এসেছেন তোষামুদের দল। দুই বাহু উত্তোলন করে ডাংকা, কাঁসি বাজিয়ে তাঁরা অমিত শাহের প্রশংসায় বিহ্বল হয়ে পড়েছেন। “হরিবোল” ভুলে জয়শ্রীরাম ধ্বনি দিতে দিতে আবেগমথিত হয়ে জানিয়ে দিয়েছেন যে, বিজেপির আগে কোন সরকার দেশভাগের বলি উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব দেবার কথা ভাবেনি। বিজেপি একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিল। জয় শ্রীরাম!    

শুরু হয়ে গেল শরণার্থী চিহ্নিতকরণের নতুন অধ্যায়। সুবোধ বিশ্বাসের নেতৃত্বে ১৮জন বিজেপি সাংসদকে রাজকীয় সম্বর্ধনা দেওয়া হল। মতুয়াদের শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিতকরণের  জন্য সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করার জন্য আসরে নেমে পড়লেন বিজেপি সাংসদ এবং মতুয়া মহাসংঘের সভাপতি শান্তনু ঠাকুর। শান্তনু ঠাকুরকে যথাযথ সঙ্গত দিলেন সাংসদ জগন্নাথ সরকার, বর্তমান হরিণঘটা বিধান সভার এমএলএ অসীম সরকার, বর্তমান কল্যাণী বিধান সভার এমএলএ অ্যাডভোকেট অম্বিকা রায় এবং আরো অনেকে। শান্তনু ঠাকুর নির্বাচনী জনসভায় ঘোষণা করেন যে, ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ড বা পাসপোর্ট নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়। মতুয়া কার্ডই নাগরিকত্বের প্রমাণ। বৈদ্যুতিন মাধ্যমে এবং সংবাদ পত্রে এই খবর প্রচারিত হয়। সহজ সরল মতুয়ারা এই কার্ড পাবার জন্য ঠাকুরনগরে ভীড়  করতে শুরু করে। এই কার্ড পাবার হিড়িক এমন বেড়ে যায় যে বহু জেলার বহু শহরে অফিস খুলে এই মতুয়া কার্ড বিতরণ করা হয়। জানিনা শান্তনু ঠাকুরদের কাছ থেকে কত লক্ষ মতুয়া কার্ড সংগ্রহ করেছেন। এই কার্ডের তালিকা বিজেপি মারফৎ ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা Intelligence Bureau (IB) এবং Research and Analysis Wing (RAW) হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে কিনা তাও জানিনা! যদি সত্যি তুলে দেওয়া হয় তার কী পরিণতি হতে পারে তা এবার অনুধাবন করুন!

 ১৯/০৭/২০১৬ তারিখে লোক সভায় নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল পেশ করার সাথে সাথে বিজেপি সাংসদ অ্যাডভোকেট অশ্বিনী উপাধ্যায় সুপ্রিম কোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা {No(s).924/2017} দায়ের করলেন। রোহিঙ্গা খোঁজার অছিলায় বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে বের করে ভারত থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য আবেদন করলেন। ঠিক একই ভাবে ২০০৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে অসমে মুসলমান এবং বাংলাদেশীদের খোঁজার নাম করে এনআরসি করার দাবী করেছিলেন সর্বানন্দ সোনোয়াল(Sarbananda Sonowal vs Union Of India & Anr on 12 July, 2005)। আসামে এনআরসি এর নামে মতুয়া, নমশূদ্র, আদিবাসী এবং মুসলিমদের কী দশা হয়েছে তা আমরা জানি।      

 অ্যাডভোকেট অশ্বিনী উপাধ্যায় এই জনস্বার্থ মামলায়  দাবী করেছেন যে, “বিদেশী আইন- ১৯৪৬ “ এর অধীনে কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারগুলিকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তা ব্যবহার করে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের চিহ্নিত করা এবং তাড়িয়ে দেবার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। আশংকার বিষয় যে বিপুল পরিমাণে মায়ানমার এবং বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী ভারতের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে ঢুকে এখানকার জনবিন্যাসের উপর শঙ্কা তৈরি করছে এবং ভয়ঙ্কর ভাবে রাষ্ট্রের একতা এবং নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে তুলেছে। ল’কমিশনের ১৭৫তম প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীরা নিরবচ্ছিন্ন ভাবে এই দেশের বিশাল অঞ্চল দখল করে আছে। এই অবৈধ দখলদারী কেবল মাত্র আমাদের আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছেনা, এটা ভারতের মানুষের বাঁচার অধিকার এবং স্বাধীনতার অধিকারকে বিঘ্নিত করছে।

এই মামলায় বর্ণনা করা হয়েছে যে, অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের জন্য আসাম, পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয়, মিজোরাম এবং ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলাগুলির জনসংখ্যা এমন হারে বেড়ে গেছে যা ভারতের গড় জনসংখ্যার থেকে অনেক বেশি। এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের জন্যই আসামের মূলনিবাসীরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে যেমনটি ঘটেছে ত্রিপুরা এবং সিকিমে। এই ভয়ঙ্কর বিষয়কে সবাই প্রাদেশিকতার সাথে গুলিয়ে দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করছেন।  

এই মামলায় আরো বলা হয়েছে যে, রোহিঙ্গিয়া এবং বাংলাদেশীরা হাওয়ালার মাধ্যমে টাকা এনে নানা ধরণের দেশ বিরোধী কার্যকলাপ করার চেষ্টা করছে এবং জাল/অবৈধ উপায়ে ভারতীয় প্রমাণপত্র যেমন প্যানকার্ড, ভোটারকার্ড সংগ্রহ করছে।

 অ্যাডভোকেট অশ্বিনী উপাধ্যায় এই মামলার শেষে সেই সব ট্রাভেল এজেন্ট, সরকারী চাকরিজীবী যারা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে এই অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের প্যানকার্ড, আধারকার্ড, রেশনকার্ড, পাসপোর্ট এবং ভোটারকার্ড পেতে সাহায্য করছেন তাঁদের বিরুদ্ধে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য আদালতে আবেদন করেছেন।

২০১৭ সালেই হাড়িকাঠ সাজিয়ে রেখেছিল বিজেপি। পরিকল্পনা অনুসারে সুপ্রিম কোর্টের তিন বেঞ্চের সিজেআই এসএ বোবদে, জাস্টিস এসএস বোপন্না এবং ভি রামসুব্রমনিইয়ান এর মত বিচারকেরাও তৈরি ছিলেন।

ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ সহ আর ৪টি রাজ্যে নির্বাচনের নির্ঘণ্ট জানিয়ে দেওয়া হল। মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্ব, করোনা নিয়ন্ত্রণের অপারদর্শিতা, কৃষিনীতি, শিক্ষানীতি সব বিসর্জন দিয়ে নাগরিকত্ব পাওয়ার আবেগ বাড়িয়ে তোলা হল মতুয়াদের মধ্যে। তাঁরা বিপুল উৎসাহে বিজেপিকে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আনার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ল। সারদা, নারদা, রোজভ্যালির  কাঁদা, ইডি, সিবিআই’এর প্রতিনিয়ত ভ্রূকুটি থেকে রক্ষা পাবার জন্য বিজেপির পবিত্র গঙ্গাজলে অবগাহন করতে ছুটে এল তৃণমূলের নামি দামী বহু নেতা-নেত্রী। ৮ দফায় ভাগ করে দীর্ঘায়ীত করা হল পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভা নির্বাচন। রাজ্য দখলের দামামা বাজিয়ে দিলেন নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ সহ বিজেপির সমস্ত উচ্চ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। এঁরা কোভিড নিয়ন্ত্রণের কথা  উপেক্ষা করে জাতীয় স্তরের সমস্ত কর্মসূচীকে বন্ধ রেখে বাংলায় ঘাটিগেড়ে বসে নির্বাচনকে একেবারে যুদ্ধের পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। বলিউড, টলিউডের চিত্রতারকা সহ সমস্ত পোষা মিডিয়াগুলি বিজেপির বাংলা দখল নিয়ে এতটাই নিশ্চিত ছিল যে ফল প্রকাশের আগেই সম্ভাব্য মূখ্যমন্ত্রী নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে গেল। বাংলায় গৈরিক ঝড় উঠবে। স্বাগত জানাতে বাঁধা হল বিশাল তোরণ। 

২৭শে মার্চ ভোট শেষ হবে। ২রা এপ্রিলে হবে বিশাল উত্থান। আইবি, সিবিআই এবং রিসার্স এন্ড আনালিসিস উইং এমনই সঙ্কেত দিতে শুরু করল। এমনই এক মহেন্দ্রক্ষণে ২০১৭ সালের পড়ে থাকা মামলাতে শান দেবার জন্য ২৬শে মার্চ সুপ্রিমকোর্টে রিমাইন্ডার দিলেন বিজেপির সাংসদ অশ্বিনী উপাধ্যায়। দাবী রাখলেন অবিলম্বে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে রোহিঙ্গিয়া সহ সমস্ত বাংলাদেশীদের চিহ্নিত করতে হবে এবং দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে এদের তাড়িয়ে দিতে হবে।  

২রা এপ্রিল, ২০২১ একটু বেলা গড়াতেই বোঝা গেল বাংলার সচেতন জনগণ বিজেপির হাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করার জন্য তৃনমূলকেই আবার বিপুল ভাবে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আসছেন। ফল প্রকাশের প্রবণতা থেকে বোঝা গেল যে আদিবাসী এবং মুসলিম ভোটের জোরেই রক্ষা পেল বাংলা। এই জাগ্রত মানুষেরাই বিজেপির পরিকল্পিত সিএএ-২০১৯, এনপিআর এবং এনআরসি মরণ ফাঁদ রুখে দিল। এই জাগ্রত মানুষেরাই নিশ্চিত মরণ ফাঁদ থেকে রক্ষা করলেন মতুয়া এবং নমশূদ্রদের। এঁরাই ট্রাইবুনালের মাধ্যমে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করার ষড়যন্ত্র কার্যত ভোঁতা করে দিল। এক অনিশ্চিত দুর্ভোগের হাত থেকে মতুয়ারা বেঁচে গেলেন। একেবারে ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলে গেল নির্ঘাত মরণ। মতুয়ারা এর পরেও বিজেপি ঘনিষ্ঠতা না কমালে, বিজেপিকে বিষাক্ত বর্জ্য হিসেবে পরিত্যাগ করতে না পারলে তাঁদের মরণ কেউ আটকাতে পারবেনা।