Pages

Wednesday 13 July 2016

রবীন্দ্রনাথের “নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ” গোতমা বুদ্ধের ‘আত্তদীপ ভব” উপলব্ধির গভীরতম অনুরণনঃ




 “Attā hi attanō nāthō
kō hi nāthō parō siyā
attanā hi sudanténa
nātham labhati dullabham” (Dhammapada verse 160)

ত্ত মগ্নতায় নিজের অস্তিত্বের খোঁজে  রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এক অনন্য পরিব্রাজক ভাবুক কবি। অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরা, অজ্ঞানতা থেকে জ্ঞানের মার্গে বিচরণ এবং আত্তোপলব্ধির সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠায় উত্তীর্ণ হয়ে নিব্বানা লাভের মাধ্যমে সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত জীবন এবং বিশ্বমানবতার বিজয় কেতন ওড়ানোই ছিল তার অভিলাষ। “আত্তোদীপ ভব” মহামতি গোতমা বুদ্ধের এই প্রগাঢ় সনাতন বাণী তাঁর জীবন প্রকোষ্ঠের কন্দরে কন্দরে ছড়িয়ে দিয়েছিল এক শুচি শুভ্র চেতনার আলো। বুদ্ধের দয়া, প্রেম, করুণা এবং আত্তমগ্নতা তার জীবনকে এমন ভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল তার প্রকাশ পাই “নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ” কবিতায়। কবিতাটি তার ২২ বছর বয়সের একটি অনন্য রচনা যা “কড়ি ও কোমল” কাব্যে প্রকাশিত হয়েছিল।  


কবিতাটির একেবারে শুরু থেকেই সূচীত হয়েছে এক ঘুম ভাঙ্গানীয়া চেতনার বাণী।
"আজি এ প্রভাতে রবির কর
কেমনে পশিল প্রাণের পর 

কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান।
না জানি কেনরে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ"। 

এ যেন হৃদয়ের গভীর গহন তলদেশ থেকে উঠে আসা প্রবল ঢেউ জাগানিয়া
এক অকৃত্রিম আবেশ। একটি স্নিগ্ধ আলোর উষ্ণতা কি ভাবে দীর্ঘকালীন জড়ত্বকে ভেঙ্গে চুরমার করে আত্তপ্রকাশের উন্মুক্ত আলোয় উদ্ভাসিত করতে পারে তা এই কবিতার সুর ঝংকারে অনুরণিত হয়েছে বার বার  

কবিতাটির মূল ভাব এবং অন্তর্নিহিত বার্তা পরিকল্পিত হয়েছে একটি জলবিন্দুর  ত্তকথনের মাধ্যমে। এক অনন্তের অংশীদার সে। সীমাহীন জলরাশি তার একান্ত আলয়কালের সুগভীর পরিকল্পনা মেনেই তাকে বিবর্তিত হতে হয়। বিভাজিত হতে হয় ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র কনিকায়। জাগতিক নানা বৈষম্য, নানা প্রতিকূলতায় সে সুদীর্ঘ সময় ধরে হিমশৈলের আকারে বন্দী হয়ে পড়ে  পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে কন্দরে কন্দরে। শৈত্য আরো প্রকট হলে সে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যায় হৈমশৃঙ্খলের অটুট বন্ধনে। শৈত্য তাক ঘিরে ফেলে। সুপ্তি তাকে গ্রাস করে। সে ভুলে যায়ঘরে ফেরার তাগিদ। ভুলে যায় তার আত্তপরিচয়।  
একদিন অন্ধকারের আগল ভেঙ্গে প্রখর সূর্য কিরণ তাকে উদ্দীপ্ত করে। ভেঙ্গে ফেলে শৈত্যের বাঁধন। গুহার ভিতর থেকে শুনতে পায় পাখির কূজন। জীবন ঝংকৃত হয়ে ওঠে প্রানের আনন্দে। এক মহামিলনের নেশায় উছলে ওঠে তার প্রানের আবেগ
এ আবেগ কোন বাঁধা মানে না। ছুটে চলতে চায় পাহাড় থেকে পাহাড়ে, লুটতে চায় ভূধর থেকে ভূধরে। আত্তউপলব্ধির এই মহাসন্ধিক্ষণে এসে সে বুঝতে পারে তার জীবন ভাষ্যে আছে অনন্ত কথামালা, আছে অনন্ত প্রানের গান। এ যেন জড়ত্ব থেকে মুক্তির এক প্রবল বিদ্রোহ। সত্য, করুণার নির্মল বারিধারায় ধৌত হয়ে এ শুধু বিশ্বপ্রেমের দুর্বার জয়গান গাওয়া 

"আমি ঢালিব করূণাধারা ,
আমি ভাঙিব পাষাণকারা,
আমি জগত প্লাবিয়া বেড়াব গাহিয়া
আকুল পাগল-পারা।
কেশ এলাইয়া, ফুল কুড়াইয়া
রামধনু-আঁকা পাখা উড়াইয়া,
রবির কিরণে হাসি ছড়াইয়া দিব রে পরান ঢালি।
শিখর হইতে শিখর ছুটিব,
ভুধর হইতে ভূধরে লুটিব,
হেসে খলখল গেয়ে কলকল তালে তালে দিব তালি"।


উথাল পাথাল মন, উদ্বেলিত বারিধারা নিয়ে সে শুনতে পায় মহাসাগরের গান। মহাসাগর জীবনবোধের এক মহাসংগম। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চেতনার সমন্বয়ে পরম সত্যের সন্ধান। জীবন বোধের এই উজ্জীবিত বোধিসত্ত্বের কাছে সমস্ত কারাগারের কঠিন বাঁধনই তুচ্ছ, ভঙ্গুর ও অর্থহীন। 
 "কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্রাণ -
দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান ।
ওরে, চারিদিকে মোর
এ কী কারাগার ঘোর -
ভাঙ্ ভাঙ্ ভাঙ্ কারা, আঘাতে আঘাত কর্ ।
ওরে আজ কী গান গেয়েছে পাখি ,
এসেছে রবির কর" ।।
এই কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ক্ষুদ্রের মধ্যে বৃহতের মেল বন্ধন ঘটাতে চেয়েছেন। বুকের মাঝে বিশ্বলোকের আহ্বান করেছেন। আসলে অষ্টাদশ শতকে ইউরোপের শিল্প বিপ্লবের ফলে যে নবজাগরণের উন্মেষ ঘটেছিল, যে নবজাগরণের ঢেউ লেগে ভেঙ্গে পড়েছিল সুপ্রাচীন কালের ধ্যান ধারনা, ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছিল জীর্ণ পুরাতন ব্যাধি জীব কল্যাণ হয়ে উঠেছিল সভ্যতার অভিমুখ সেই কল্যাণকামী সামাজিক পরিবর্তনের দুর্দম অভিঘাতকে শৈল্পিক ভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে নির্ঝরের স্বপ্ন ভঙ্গ কবিতায়।    

তৎকালীন ভারতীয় সমাজের সাম-দাম-দন্ড-ভেদ নীতির কারণে যে ভাবে মানবিক মূল্যবোধ ধুলায় লুণ্ঠিত হচ্ছিল তার স্বরূপটিকেও উদ্ঘাটন করেছেন কবিসামাজিক ভেদনীতির ফলে খণ্ডিত হচ্ছিল মানবাতা। মানুষে মানুষে ছিল বিভেদের প্রাচীর। মুক্তচিন্তা, স্বাধীন চেতনা আটকা পড়ে যাচ্ছিল দুর্লঙ্ঘ নীতির নিগড়ে। ক্লেদাক্ত পঙ্কিলে ঢাকা পড়েছিল চারধার। তেমনি এক প্রদোষকালে পশ্চিমী ঝঞ্ঝার মত ভারতবর্ষের মনন ক্ষেত্রেও আছড়ে পড়েছিল রেনেসাঁ। ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের ডাক শোনা যাচ্ছিল বাতাসে বাতাসে। জ্ঞানের স্নিগ্ধ আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছিল উপলব্ধির আনাচে কানাচে। মুক্তির এই মরমী বাণী রবীন্দ্রনাথ অগ্রাহ্য করতে পারেননি। তাই সত্য, প্রেম, করুণার বেগবান ফল্গুধারায় স্নাত হয়ে তিনি মিলিত হতে চাইছিলেন বিশ্বপ্রেমের মহাসংগমে।
"Tasmātihānanda, attadīpā viharatha attasaraṇā anaññasaraṇā, dhammadīpā dhammasaraṇā anaññasaraṇā"

2 comments:

  1. অসাধারণ বিশ্লেষণ করেছেন দাদা।রবীন্দ্রনাথের বহু রচনাই গৌতম বুদ্ধের মহান দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত।ধম্মপদে পালি ভাষায় অসাধারণ একটি শ্লোকে বর্ণিত হয়েছে "অত্তাহি অত্তনো নাথো কোহি নাথো পরসিয়, আত্তদীপ ভব’। অর্থাৎ “তুমিই তোমার ত্রাণকর্তা। অদৃষ্ট পরিবর্তনে কোন মাধ্যম বা ত্রাণকর্তা নেই। আত্মশরণ হয়ে নিজের উপায় নিজেই অন্বেষণ কর।" আমাদের প্রিয় কবি রবিঠাকুর সুন্দর অনুবাদ করেছেন
    " আপনারে দীপ করি জ্বালো,
    আপনার যাত্রাপথে
    আপনিই দিতে হবে আলো।"

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক অনেক ভালবাসা নিও ভাই। ভাবছি রবীন্দ্রনাথের কিছু গান এবং কবিতা নিয়ে এইরকম একটি আলোচনা সংকলন তৈরি করব।

      Delete