পাহাড়
কেন ডাকে?
জ্যৈষ্ঠের
কাঠ ফাটা রোদের পর আষাঢ়ের এক পশলা বৃষ্টি পেয়েই পাহাড়টা ডাকে! গম্ভীর এই ডাক! ঝিম মারা গাছগুলি
চমকে ওঠে। একটা দমকা হাওয়ার মত খবরটা ছড়িয়ে
যায় কুলি কুলি ডুংরিতে ডুংরিতে!
শালগিরা……শালগিরা।
সিধু
মাঝি, কানু মাঝি শালগিরা পাঠিয়েছে।
পাতা
সমেত ছোট শালের এই ডাল পৌঁছে গেছে ঘরে ঘরে।
তাই
বুঝি পাহাড়টা আজ ডাকছে।
নিদারুন
যন্ত্রণায়, আহত অভিমান নিয়ে আত্তসম্মান ফিরে পাবার জন্য অনবরত ডেকে চলেছে পাহাড়টা।
এই ডাক অবসম্ভাবী এক ঝড়ের বার্তা বহন করে টাইড়, বাইদ, বোহাল, কানালী পেরিয়ে ডুংরিতে ডুংরিতে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে।
এই ডাক অবসম্ভাবী এক ঝড়ের বার্তা বহন করে টাইড়, বাইদ, বোহাল, কানালী পেরিয়ে ডুংরিতে ডুংরিতে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে।
পাহাড় ডাকছে......
আর বাঁশী ফুঁকা মানুষগুলি, জোষ্ঠা রাতের তুংদা, টমাক বাজানো মানুষগুলি, ছেঁড়া টেনা পরা মানুষগুলি পাথর ভাঙ্গা গতর নিয়ে শার্দূলের মতো ক্ষিপ্রতায় কাঁড়বাঁশ, টাঙ্গি, তরোয়াল, বল্লম নিয়ে হাজির হচ্ছে ভগনা ডিহি গ্রামে। তাঁরা ধরে রাখতে চায় তাঁদের মাটি। তাঁরা ফিরে পেতে চায় জল-জঙ্গলের অবাধ অধিকার। তাঁরা প্রাণ দিয়ে আগলে রাখতে চায় তাঁদের লাই লাকচার, আড়িচালি।
আর বাঁশী ফুঁকা মানুষগুলি, জোষ্ঠা রাতের তুংদা, টমাক বাজানো মানুষগুলি, ছেঁড়া টেনা পরা মানুষগুলি পাথর ভাঙ্গা গতর নিয়ে শার্দূলের মতো ক্ষিপ্রতায় কাঁড়বাঁশ, টাঙ্গি, তরোয়াল, বল্লম নিয়ে হাজির হচ্ছে ভগনা ডিহি গ্রামে। তাঁরা ধরে রাখতে চায় তাঁদের মাটি। তাঁরা ফিরে পেতে চায় জল-জঙ্গলের অবাধ অধিকার। তাঁরা প্রাণ দিয়ে আগলে রাখতে চায় তাঁদের লাই লাকচার, আড়িচালি।
ভগনা ডিহির সভায় পাহাড় ডাকা ক্ষোভ
নিয়ে সিধু, কানু, চাঁদ, বৈরভ গর্জে উঠে বলেন, সুদখোর
মহাজন
এবং
গোরা
পল্টন আমাদের সব কিছু কেড়ে নিতে চায়।
সাঁওতালদের সুখসাচ্ছন্দ দেখতে চায় না দিকু জমিদার। তাঁরা জোর করে আদিবাসীদের কাছে
থেকে খাজনা আদায় করতে চাইছে। অন্যায় ভাবে আমাদের চুরির দায়ে অপরাধী করছে।
প্রকাশ্যে অপমান করছে এবং জোর জবরদস্তি গরু, ছাগল, ভেড়া, মোষ কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে।
জমিদারের সঙ্গে জুটেছে পুলিশ, পাইক, পেয়াদা, জজ, ম্যাজিস্ট্রেট। এরা সবাই মিলে
আদিবাসীদের শেষ করে দিতে চায়। এটা চরম অন্যায়। আমরা
স্ত্রী-পুত্রের
জন্য, জমি-জায়গা
বাস্তু-ভিটার
জন্য, গো-মহিষ
লাঙ্গল ধন-সম্পত্তির
জন্য “হুল সেঙ্গেল” করতে চাই। আমরা আমাদের
মান সম্মান এবং হৃতগৌরব ফিরে পেতে চাই।
‘নুসাসাবোন, নওয়ারাবোন চেলে হঁ বাকো তেঙ্গোন,
খাঁটি গেবোন হুলগেয়া হো
খাঁটি গেবোন হুলগেয়া হো,
দিশম দিশম দেশমৗঞ্জহি পারগানা
নাতো নাতো মাপাঞ্জিকো
দঃ বোন দানাং বোন বাং গেকো তেঙ্গোন
তবে গেবোন হুলগেয়া হো।
বাংলা
করলে দাড়ায়ঃ
‘আমরা বাঁচব, আমরা উঠব,
‘আমরা বাঁচব, আমরা উঠব,
আমাদের পাশে কেউ না দাঁড়ালেও
আমরা সত্যি বিদ্রোহ করব
আমরা সত্যি বিদ্রোহ করব
দেশের মাঝি ও পারগানারা
গ্রামের মোড়লরা আমাদের পাশে থাকবে
আমরা সত্যি বিদ্রোহ করব
আমরা সত্যি বিদ্রোহ করব
দেশের মাঝি ও পারগানারা
গ্রামের মোড়লরা আমাদের পাশে থাকবে
অন্য কেউ পাশে না দাঁড়ালেও
তবুও আমরা নিশ্চয়ই বিদ্রোহ করব’।
১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন অসম বিক্রমে দেশের মাটি থেকে বিদেশি দিকু, সুদখোর মহাজন এবং ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সমূলে উৎপাটন করার জন্য শুরু হয়েছিল এক সশস্ত্র অভ্যুত্থান। যে অভ্যুত্থান “হুল সেঙ্গেল” বা “সাঁওতাল বিদ্রোহ” নামে পরিচিত।
হুলের নেপথ্য কাহিনীঃ
১৮৬৮ সালে প্রকাশিত হান্টার কমিশনের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, বীরভূম, সিংভূম, ধলভূম সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় সাঁওতাল, মুন্ডা, জাওরা পাহাড়িয়া সহ অসংখ্য আদিবাসী সমূদয়ের নিবাস ছিল। ১৭৭০-১৭৯০ সালের খরা ও মন্বন্তরের জন্য এই আদিবাসী সমুদায় রাজমহল পাহাড়ের দিকে আসতে শুরু করে। এই আদিবাসী সমুদায়ের মধ্যে সাঁওতালরা ছিল সব থেকে শক্তিশালী এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ। বড়লাট বেন্টিংক পাহাড়িয়াদের দমন করার জন্য রাজমহল পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে সাঁওতালদের বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। হান্টার উল্লেখ করেছেন যে ১৭৭০ থেকে শুরু করে ১৮৪৭ সালের “দামিনী কোহ” পর্যন্ত এই মাইগ্রেশন চলে এবং প্রায় ১৫০টি সাঁওতাল গ্রামের পত্তন হয়।
ইংরেজরা সাঁওতালদের অঙ্গীকার করেছিল যে এই অঞ্চলে গ্রাম পত্তন করলে তাদের কোন খাজনা দিতে হবে না। যে যতটা জঙ্গল পরিষ্কার করে আবাদ করতে পারবে সেই জমি তার হবে।
প্রায় ১৪ হাজার বর্গমাইল এলাকার জঙ্গল পরিষ্কার করে উর্বর ফসলী জমিতে রূপান্তর করে চাষবাসে সুশিক্ষিত সাঁওতাল জাতি। তারা উদয়াস্ত পরিশ্রম করে, পাথর ভেঙ্গে, জঙ্গল কেটে, কাঁকড় মাটি সরিয়ে যখন সোনার ফসল ফলাতে শুরু করল, যখন পাহাড়ের কোলে, সারি সারি ঘর বানিয়ে মাটির দেওয়ালগুলি বিচিত্র শিল্পকলায় ভরিয়ে তুলল, কুলহির মাঝি থানে তুংদা-টমাকের হিন্দোল তুলে “করম বিন্তি”র সাথে সাথে নিজেদের সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ঘটাতে শুরু করল তখন অধিক খাজনা আদায়ের জন্য এই সব জমি জমিদার এবং মহাজনদের হাতে তুলে দিল ব্রিটিশ কোম্পানি।
লর্ড কর্ণওয়ালিশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তঃ
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ২২ মার্চ লর্ড কর্ণওয়ালিশ জমি থেকে খাজনা নিশ্চিত করার জন্য চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু করেন। এই ব্যবস্থা অনুসারে নিলামে নির্দিষ্ট জমির সর্বোচ্চ দাম যে দিতে পারবে তাকেই জমির সত্ত্ব দেওয়া হয়। উল্লেখ থাকে যে এই ব্যবস্থা অনুযায়ী জমিদারেরা বাংশানুক্রমে জমির স্বত্ব ভোগ করবেন শুধু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্ধারিত রাজস্ব কোম্পানির কোষাগারে জমা দিতে হবে । বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ও বেনারসের জন্য এই ব্যবস্থা চালু হয়।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিণতিঃ
নতুন এই ব্যবস্থায় সাঁওতালদের হাতে থাকা সব জমি, সব প্রাকৃতিক সম্পদ জমিদারদের হাতে চলে যায়। জমিদারেরা নিরীহ সাঁওতালদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করার জন্য লাঠিয়াল ও সুদখোর মহাজন নিয়োগ করে। মহাজনরা টাকা ধার দিয়ে গলায় ফাঁস পরাতে লাগল সাঁওতালদের। শাবন মাসে এক টাকা ধার দিয়ে আঘন মাসে গরুর গাড়ী নিয়ে আসতে লাগল ধান মাপতে। ১ টাকার বদলে ১ সলি ধান। বিশ সেরে এক সলি। মহাজন শুধু ধান মাপে। মুখে বলে রাম...রাম। মাপতে মাপতে সমস্ত ধান শেষ হয়ে গেলেও বিশ বলেনা। এই ভাবে দেনার অজুহাত দিয়ে সমস্ত ধান, সর্ষে, বীজ লুটে নেয় দিকু মহাজনেরা। এই লুটের মাল জঙ্গীপুর, কোলকাতা হয়ে বিলাতে চালান হতে লাগে। দেনা শোধ করতে না পারলে জমি কেড়ে নেয় সুদখোর মহাজন। মহাজনদের অত্যাচার এমন পর্যায়ে নেমে আসে যে অনেক সাঁওতাল পরিবার দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়। না খেতে পেয়ে পাথর ভাঙ্গা শরীর শুকনো দড়ির মত হয়ে যায়। আর বুকের মধ্যে জ্বলতে থাকা আগুন তাই একদিন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। এই সীমাহীন পৈশাচিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে সাঁওতাল পরগণার ভগনাডির নারায়ণ মাঝির চার ছেলে গর্জে ওঠে। সিধু, কানু, চাঁদ আর ভৈরব।
সিধু-কানু ঘোষণা করেন যে, ঠাকুরবাবার আদেশ অনুসারে তারা অত্যাচারী জমিদার ও গোরা পল্টনদের উৎখাত করে সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করবেন।
হুলের প্রকৃতি ও প্রভাবঃ
১০০০০ বাছাইকরা যোদ্ধা নিয়ে সিধু-কানুর নেতৃত্বে সজ্জিত হয় সাঁওতাল রেজিমেন্ট। এদের মধ্যে ৪০/৫০ জন থাকে গরিলা বাহিনী। সাঁওতালদের হুল ঘোষণার কথা শুনতে পায় মহেশ দত্ত। তিনি ছিলেন দায়িত্ব প্রাপ্ত দারোগা। তাচ্ছিল্য ভরে তিনি সাঁওতালদের বেঁধে নিয়ে যাবার জন্য একটি গাড়ি বোঝাই করে দড়ি নিয়ে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিল দুজন সিপাহী এবং সুদখোর মহাজন মানিক রায়। সিধু-কানুর বিশ্বস্ত বাহিনীর কাছে পরাজিত হয় মহেশ দারোগা। সৈন্যরা মহেশ দত্ত এবং মহাজন মানিক রায়কে হত্যা করে। এরপর গোটা ভাগলপুর জুড়ে শুরু হয়ে যায় বিদ্রোহের আগুন। ১৮৫৫ সালের ৭ই জুলাই বিদ্রীদের হাতে খুন হয় কুখ্যাত মহাজন বেনারাম ভগত। ১৮৫৫ সালের ১২ জুলাই বিদ্রোহীরা পাকুড়ের রাজ বাড়ি আক্রমণ করেন। ১৬ই জুলাই পিয়াল পুরের যুদ্ধে সিধু-কানুর হাতে ইংরেজ বাহিনী পর্যুদস্ত হয়। তারা পরাজয় স্বীকার করে। ২০শে জুলাই বীরভূমের তালডাঙ্গা থেকে সাইথিয়া এবং ভাগলপুর রাজমহল পর্যন্ত বিদ্রোহী বাহিনী আধিপত্য বিস্তার করে। ২১শে জুলাই কাতনা গ্রাম এবং ২৩শে জুলাই গণপুর বাজার দখল করে নেয়।
ব্রিটিশের পাল্টা প্রত্যাঘাতঃ
বিদ্রোহীদের কাছে এই শোচনীয় পরাজয়ে ইংরেজ বাহিনী খেপে যায়। তারা ৩০শে জুলাই লেফটেন্যান্ট রুবির নেতৃত্বে ৭টি আধিবাসী গ্রাম সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। এই সময় বিদ্রোহ দমন করার দায়িত্ব পায় মেজর জেনারেল লয়েড। ১৮৫৫ সালের ১৭ই অগাস্ট সরকার বিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করার জন্য নির্দেশ দেন। সিধু-কানু এবং বিদ্রোহীরা এই নির্দেশ ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। পরিস্থিতি ঘোরাল হয়ে উঠলে সরকার সেনাবাহিনী নামিয়ে বিদ্রোহ দমন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সামরিক আইন জারি হয়। একদিকে কামান, বন্দুক অন্যদিকে তীর ধনুক, টাঙ্গি তরোয়ালের অসম লড়াই। সেনাবাহিনীর হাতে শত শত বিদ্রোহী নিহত হতে থাকে। আশ্রয় হীন, খাদ্য হীন অবস্থায় অনেকে ধরা পড়ে। মনোবল ভেঙ্গে পড়ে।
এই সুজোগে ইংরেজ বাহিনী, জমিদার, মহাজন একত্রিত হয়ে কামান, বন্দুক ও হস্তী বাহিনী নিয়ে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৭ জানুয়ারি ১৮৫৬ সালে লেফটেন্যান্ট ফেগন পরিচালিত ভগলপুর হিল রেঞ্জার্স বাহিনীর সংগে মুখোমুখি যুদ্ধে সিদু আহত হন। বিদ্রোহীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। কানু ধরা পড়েন।
আখনো আমরা সিধু-কানু
১৮৫৬ সালের ২ ও ৩ ফেরুয়ারিতে সিদু, কানুকে ফাঁসি দেওয়া হয় আর সেই সাথে সাথে পরিসমাপ্তি ঘটে মাতৃভূমি রক্ষা করার এক তীব্র লড়াই। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে এই “হুল”এ ১৫ থেকে ২৫ হাজার সাঁওতাল নিহত হয়েছিলেন।
" আমরা ত সেই মানুষ বঠি
যে মানুষ একদিন ভগনাডিহির মাঠে হইছিল সিধু
ময়ূরাক্ষীর লদীতে হইছিল কানু
আর আখন
আখনো আমরা তাই আছি
দুজনার থাকে বাড়ে হইছি হাজার হাজার......।"
(আমরা সিধু আমরা কানু, দেবব্রত সিংহ )
সকলকে হুল দিবসের সংগ্রামী অভিনন্দন জানাই
No comments:
Post a Comment