Pages

Saturday, 21 March 2015

ইতিহাসের আলোকে মোগলমারি বৌদ্ধবিহার : শরদিন্দু উদ্দীপন





প্রিয়দর্শী রাজা এমন বলছেন যে, আমি পথে পথে বটবৃক্ষ রোপণ করেছি, তারা পশু মানুষকে ছায়াদান করুক। আম্রবাটিকা প্রস্তুত করেছি তারা সকলকে ফল দান করুক, আধক্রোশ ব্যবধান অন্তর সরবর কুপ খনন করেছি তারা সেই সকল স্থানে জলদান করুক, আশ্রয় স্থান নির্মাণ করেছি তারা মনুষ্য পশুদের আশ্রয় দান করুক (সম্রাট অশোকের ৭ম শিলালিপি)
পশ্চিম মেদিনীপুরের দাঁতন শহরে অবস্থিত ভট্টর কলেজ থেকে কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শরশঙ্কা দীঘিটি দেখতে দেখতে কেন জানি প্রিয়দর্শীরাজা সম্রাট অশোকের জন কল্যাণকারী এই শিলালেখটির কথা মনে পড়ে গেল। এই শিলালেখ স্তম্ভলিপিগুলিতেই তিনি ব্যক্ত করেছিলেন তার জীবনে ধর্মের অবস্থান কোথায় এবং তার স্বরূপ কি। তিনি ব্যাক্ত করেছিলেন যে, অহিংসা, জীবের প্রতি পরম মমত্ব, পিতা মাতার প্রতি কর্তব্য, সাধুদের প্রতি যথার্থ  শ্রদ্ধাই তার ধম্ম দর্শনের ভিত্তিভূমি। সুনীতি কল্যাণই যার মূলাধার            
দীঘিটি ১৪৭ একর জমির উপর বিস্তৃত। চৌদিকে সুউচ্চ মাটির বাঁধ। চারিদিকে উর্বর কৃষি ক্ষেত্র। কিছুদূর দিয়েই প্রবাহিত সুপন্নখা বা সুবর্ণরেখা নদী। এমন একটি জনহিতকর নিবিড় প্রকল্পের নিরব অবস্থান থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, পুরাকালে এলাকাটি জনবহুল ছিল এবং এই বৃহত্তর জলাধার থেকে নানা অভিধায় মানুষ উপকৃত হত।
শোনা যায় রাজা শশাঙ্কের নামানুসারে এর নাম হয়েছে শরশঙ্কা দীঘি। অর্থাৎ অনুমান করা যেতে পারে যে এই প্রাচীন জনপদে রাজা শশাঙ্কের পদার্পণ ঘটেছিল এবং সেই কাহিনীই জনশ্রুতিতে মিশে আছে। প্রাসঙ্গিক কারণেই এই জনপদে রাজা শশাঙ্কের উপস্থিতি আলোচনা করা যাবে। তবে আপাতত আমাদের মূল আলোচ্য বিষয় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের যৌথ উদ্যোগে আবিষ্কৃত সখীসেনার ঢিবি বা মোগলমারির বুদ্ধবিহার।
গত ০৩/০৫/১৪ তারিখে বৌদ্ধ ধর্মাঙ্কুর সভা কনসাস বেঙ্গল এর পক্ষ থেকে ভিক্ষু  বোধিপাল, ভিক্ষু বিনয়শ্রী, হেমেন্দুবিকাশ চৌধুরী, সদানন্দ বড়ুয়া শরদিন্দু উদ্দীপন সহ যে ৫জন প্রতিনিধি এই প্রত্নস্থল পরিদর্শন করেন তাদের ক্ষেত্রাবলোকনের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন।                  

মোগলমারির অবস্থানঃ   
শরশঙ্কা জলাধারের ১০ কিলমিটারের মধ্যে অবস্থিত সখীসেনার ঢিবি যা বর্তমানে মোগলমারি নামে পরিচিতি লাভ করেছে বিদ্যাধর নামে অনুরূপ আর একটি দীঘি আছে দাঁতন শহরের সন্নিকটে  মোগলমারি থেকে এই দীঘিটির দূরত্ব ৫ কিলোমিটারের মধ্যে। এই প্রত্নস্থলের পূর্ব দিকে ৬০নং  জাতীয় সড়ক যার মধ্যদিয়ে উড়িষ্যা হয়ে দক্ষিণ ভারতের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিস্তৃত হয়েছে। খড়গপুর রেল ষ্টেশন  থেকে দাঁতন শহরের দূরত্ব ৪৬ কিমি। আর পূর্বগামী জাতীয় সড়কের ১৮০ কিমি দূরে অবস্থিত কোলকাতা শহর। অর্থাৎ অবস্থানগত দিক দিয়ে মোগলমারি বা সখীসেনার ঢিবি পুরাকালে গ্রাম পত্তনের নিরিখে একটি আদর্শ গ্রাম। অধ্যাপক নীহার রঞ্জন রায় তার বাঙালীর ইতিহাস গ্রন্থে (তৃতীয় অধ্যায়, দেশ-পরিচয়, পৃ ৯১) উল্লেখ করেছেন যে, “যে সব গ্রামের উল্লেখ প্রাচীন বাংলার লিপিগুলিতে পাওয়া যায় সেগুলি একটু বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, গ্রামের প্রান্তসীমায় রাজপথের উল্লেখ; অনেক সময় এই পথগুলি এক বা একাধিক দিকে গ্রামসীমা অথবা কোন ভূমিসীমা নির্দেশ করে, এবং সেই হিসাবেই পথগুলির উল্লেখ এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক যে পূর্বজনপদের আদিজনেরা ক্রমবিবর্তন ক্রমবিকাশের নানা ধাপে জঙ্গল কেটে মাটি ভরাট করে নতুন নতুন গ্রাম নগর পত্তন করেছিল এবং সেই গ্রাম নগরের সাথে সম্পর্কের সেতু নির্মাণের জন্য তৈরি হয়েছিল নানা পথ। এইসব স্থলপথগুলি যুক্ত হয়েছিল নানা জলপথের সাথে কেননা নদীমাতৃক পূর্বজনপদের গৌরব জনক অধ্যায়ের সাথে জলপথের অবদান ছিল সর্বাধিক। তৎকালীন তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদক অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁরপ্রাচীন হিন্দুদের সমুদ্রযাত্রা বানিজ্য বিস্তার(প্রকাশক, রজনী নাথ দত্ত) গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, লোহা  আবিস্কারের পূর্বে বাংলার সওদাগরেরা বেতে বাঁধা ডিঙ্গায় চড়ে ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের ফেনিল জলধিকে হেলায় পরাভূত করে নানা দেশে ব্যবসা করতে যেতেন। সেকালে মিশর, রোম, ফিনিসিয় বিত্তশালী বণিকদের মতই বাংলার সওদাগরেরা মর্যাদা বানিজ্য বিস্তারে সমান ক্ষমতা সম্পন্ন ছিলেন।  তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে, আর্যরা যখন মধ্য এশিয়া থেকে পাঞ্জাবে এসে উপস্থিত হয়, তখন  সপ্তডিঙ্গা মধুকরসমৃদ্ধ বাংলার বনিকেরা সমুদ্রের বন্দরে বন্দরে সুদৃশ্য পণ্যের পশরা সাজিয়ে বিদেশী ক্রেতাদের চিত্তবিনোদন করতেন। মিশর, রোম ফিনিসিয় বনিকেরা সেই সব পণ্য সংগ্রহ করে আরব সাগর নীলনদের মধ্য দিয়ে ভূমধ্য সাগরের পথে প্রেরণ করতেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, তাম্রলিপ্ত বন্দর ছিল পূর্ব জনপদের অন্যতম সমুদ্র শায়িত বন্দর যার মধ্য দিয়ে বাংলার গৌরবোজ্জ্বল দীপ্তি সমগ্র বিশ্বে প্রতিফলিত হত। প্রাচীন তন্ডবুত্তি, দন্ডভুক্তি বা বর্তমান দাঁতন ছিল তাম্রলিপ্ত জনপদেরই অন্তর্ভুক্ত একটি সমৃদ্ধ অঞ্চল যার উত্তর শিমূলিয়া মৌজায় অবস্থান করেছে এই সখীসেনার ডিবি বা মোগলমারি বুদ্ধবিহার

নামকরণের অন্তরালে
কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের যৌথ উদ্যোগে ২০০৩ থেক ২০১২ সাল পর্যন্ত মোট  ৬টি পর্যায়ে খননকার্য হয়েছে। নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে এই খননকার্য অতিসামান্য বা আংশিক। এই খননকার্যের থেকে পাওয়া যৎসামান্য প্রত্ন বিষয়ক নমুনা থেকে এই বুদ্ধ বিহারটির সম্পর্কে প্রায় কিছুই বলা অনুচিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও খননকার্য শুরু হওয়ার সাথে সাথে মোগলমারি বুদ্ধবিহার নামে এটি প্রচারের আলোয় চলে আসে। বিশেষজ্ঞরা আইনআকবরি গ্রন্থের বিবরণ তুলে মেদিনীপুর জেলায় সংঘটিত সম্রাট আকবরের সেনাপতি মুনিম খাঁ সেনাধ্যক্ষ টোডরমলের বিরুদ্ধে কালাপাহাড়ের যুদ্ধের বিবরণ তুলে ধরেন। অমরাবতী নামক অঞ্চলে এই যুদ্ধে মোগলরা নাকি সৈন্য শিবির হিসেবে এই বুদ্ধ বিহারটি ব্যবহার করে। কালাপাহাড়ের কাছে প্রচুর মোগল সৈন্য মারা যায়বাকি সৈন্যরা পলায়ন করার সময় এই বুদ্ধ বিহারটি ধ্বংস করে দেয়। প্রচুর মোগল সৈন্য মারা যাওয়ার কারণেই অঞ্চলের নাম হয়েছে মোগলমারি। এরকম একটি কল্পকাহিনী অবতারণা করা হচ্ছে অবলীলাক্রমে।    
সখী সেনার কাহিনীটি হয়তো আরো পুরানো। আরো চিত্তাকর্ষক। শোনা যায় এই বুদ্ধ বিহারটি ছিল একটি মহাবিদ্যালয়। বাংলার কোন এক রাজার মেয়ে সখীসেনা এই মহাবিদ্যালয়ে পড়াশুনা করত। একটি ভিন্ন  জাতের ছেলের সাথে তার প্রণয় হয়। তারা উভয়ে বিবাহ  বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাইলে রাজা তা কঠোর  ভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। উপায়ন্তর না দেখে সখী সেনা এবং তার প্রেমিক এই মহাবিদ্যাল্যের কোন একটি কুয়োতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বিসর্জন করে। সেই থেকে এই অভিশপ্ত মহাবিদ্যালয়টি একটি পরিত্যক্ত খন্ডহর। ভয়ে কেউ এখানে বাড়ি করার সাহস দেখায়নি। শুধু এলাকার তরুণেরা মিলে ঢিবিটির একেবারে মাথার উপরে সখীসেনা ঢিবি, মোগল মারী তরুণ সংঘ পাঠাগার নামে একটি সংঘ গড়ে তুলেছে।
সাম্প্রতি গবেষকেরা মোগলমারী বুদ্ধ বিহারের প্রাচীন নামবান্দানহিসেবে উল্লেখ করেছেন। শব্দটি বর্তমান বন্দর শব্দের সমগোত্রীয়। অর্থাৎ এই অঞ্চলটি জলপথে যোগাযোগের একটি অন্যতম স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল তা এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির গঠন দেখলেই অনুমান করা যায়।  কাঁসাই, কপিশা বা কংসবতী নদী যে একসময় এই অঞ্চলেই সমুদ্রের সাথে মিলিত হয়েছিল এখানকার ভূমির আন্তর্গঠনই সেই সাক্ষ্য বহন করে। বর্তমানে কাঁসাই নদী বালিয়াপালের কাছে গিয়ে সমুদ্রের সাথে মিলিত হয়েছে।

তাম্রলিপ্তে বুদ্ধ বিহার নির্মাণের প্রয়াসঃ  
২৬১ খ্রিষ্টপূর্বে কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে সম্রাট অশোকের জীবনে এক আমূল পরিবর্তন সূচীত হয়। সম্রাট অশোকের নেতৃত্বে এবং তার গুরু ভন্তে মোগলীপুত্ত তিস সভাপতিত্বে পাটলিপুত্রে সংঘটিত তৃতীয় বুদ্ধধম্ম সম্মেলনধম্মবিজয় শোকাতুর রাজা ঘোষণা করেন,  'অসুপুত্ত পপৌত্ত মে নবম্ বিজয়ম বিজিতব্যম  আমার পুত্র এবং প্রপৌত্ররাও কোন নতুন রাজ্য যুদ্ধবিজয় করবেনা যদি বিজয় করতে হয় তা হবে ধম্মবিজয়(১৩ নং রক এডিক্ট)কলিঙ্গ অনুশাসনে তিনি লিখেছিলে, “সকল মানুষই আমার পুত্রতুল্য। আমার পুত্রেরা সকল মঙ্গল সুখের অধিকারী হোক। মানুষ পশুর জন্য দাতব্য চিকিৎসালয়, বিশ্রাম গৃহ, ঔষধি ফলমূল, লতাগুল্ম রোপণ, পানীয় জল কৃষিকার্যের জন্য সরোবর খনন শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ এবং এগুলিকে সুচারু রূপে পরিচালনার জন্য তৈরি করলেন বুদ্ধবিহার। কালজয়ী ধম্ম প্রচারকদের প্রেরিত করলেন সমগ্র বিশ্বে। মানব মনে প্রেম,ভক্তি, দয়া, করুণা স্থাপন করে সিঞ্চিত করলেন ভগবান বুদ্ধের চিরন্তন বাণী বসুধৈবকুটুম্ব।  দ্বিতীয় গিরিলিপিতে সমস্ত সত্তার সার্বিক কল্যাণের জন্য উৎকীর্ণ করলেন তার ধম্মানুভূতি।
সম্রাট অশোক বাংলার বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য বুদ্ধবিহার নির্মাণ করেছিলে তা প্রমান পাওয়া যায় শিলালিপি, স্তম্ভলিপি গিরিলিপিগুলি থেকে। সাম্প্রতি ডঃ পরম আনন্দ সাত্যজিত মৌর্যের গবেষণায় উঠে এসেছে এরকম অসংখ্য বুদ্ধ বিহারের নাম তারা দবী করছেন যে সমগ্র বাংলায় ৭০টির বেশি বুদ্ধ বিহার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন  সম্রাট অশোক। তাম্রলিপ্ত অঞ্চলেই ২২টি বুদ্ধবিহারের হদিস পাওয়া যাচ্ছে। তাদের কাজগুলি সমাপ্ত হওয়ার পথে। খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হবে এই গ্রন্থ। সম্রাট অশোক কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধ বিহারের যে তালিকা এই বন্ধু দ্বয় আমাকে পাঠিয়েছেন নিম্নে সংযুক্ত করা হলঃ
১। রক্তমিত্তিকাঃ
মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের লিপি থেকে জানা যায় তিনি ছিলেন রক্তমিত্তিকা বা রাঙামাটির বাসিন্দা। হিউয়েন- সাং এর বিবরণীতে রক্তমিত্তিকার উল্লেখ আছে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, কর্ণসুবর্ণের রাজধানীর সন্নিকটে ছিল এই Lo-to-mo-chi যেখানে গড়ে তোলা হয়েছিল বৃহৎ বৌদ্ধ বিহার। প্রাচীন কাল থেকে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের কাছে অবস্থিত রাঙামাটিও বুদ্ধধম্ম ও দর্শনের প্রাণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। সম্ভবত এই রক্তমিত্তিকা কর্ণসুবর্ণে বা বর্তমানে মুর্শিদাবাদ জেলায় অবস্থিত।      
২।  আশ্রম বিহার
৩। রাজা বিহার
৪। পাত্তিকেরা বিহার
৫। ফুল্লহারী বিহার
৬। সোনাগারো বিহার
৭। শালিবর্ধক বিহার
৮। ত্রৈকূট বিহার
৯। বিক্রমপুরি বিহার
১০। ভরতপুর বিহার
১১। জগদল্লা বিহার
১২। সুবন্ন বিহার
১৩। সোমাপুরি বিহার
১৪। বদনগড়ি বিহার
১৫। বালান্দ বিহার
১৬। কানসোনা বিহার (এটিই মুর্শিদাবাদের কর্ণসুবর্ণ)
১৭। সিদ্ধেশ্বর বিহার (বাঁকুড়া জেলায়)
১৮। বুধপুর বিহার (পুরুলিয়া জেলার কালুহার অঞ্চলে)
১৯। বর্গরাম বিহার (বীরভূম জেলায়)
এইসব নামের আড়ালে বর্তমানের মোগলমারি আছে কি নেই বা কি নামে লুকিয়ে আছে  তা বলা দুষ্কর।  স্তূপটির সার্বিক খননকার্য সম্পূর্ণ হলে এই বিভ্রম খানিকটা দূর হতে পারে বলে আমাদের ধারনা। তবে মোগল সৈন্য পলায়নকালে এই বুদ্ধ বিহারটি ধ্বংস করেছে, এটা যে আরোপিত কাহিনী তা সহজেই বোঝা  যায়। মোগলরা এই ধ্বংসকার্যে কামান ব্যবহার করে থাকলে প্রত্ন নিদর্শনগুলিও যে গুঁড়িয়ে যেত এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। কোদাল শাবল হাতুড়ি, গাইতির সাহায্যে এবং বেশ কিছুদিন ধরে যে এই ধ্বংসকার্য  চালানো হয়েছিল ধ্বংসাবশেষের নমুনাই তার প্রমানইটের ইমারতগুলিকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তার উপর দিয়ে আলগা মাটি ছড়িয়ে দেবার প্রবনাতা থেকে ধরা পড়ে যে আক্রমণকারী বুদ্ধবিহারের নাম নিশানা মাটিতে মিশিয়ে দেবার জন্য কতটা নিষ্ঠুর ছিলেন? এই ধ্বংসের চরিত্রকে তুলনামূলক আলোচনার নিরিখে বিচার করলে তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা, পাহাড়পুর, মহাস্থানগড় প্রভৃতি মহান বুদ্ধ বিহারগুলির সাথে মিল পাওয়া যায়। পাওয়া যায় জিঘাংসা প্রতিক্রিয়াশীলতার এক উন্মত্ত ইতিহাস।

ধ্বংসের  নেপথ্য কারণ সমূহঃ    
রাজা শশাঙ্কের কাল পর্যন্ত প্রবুদ্ধ বঙ্গে ধম্ম ও দর্শনের মূলধারা ছিল “বহুজন হিতায় বহুজন সুখায়”। সৃজন, নির্মাণ ও প্রকাশের নিবিড় ব্যবস্থায় গড়ে উঠেছিল এক সমৃদ্ধ বাংলা। জৈন, বৌদ্ধ ও কৌম্য ধর্মগুলির মধ্যে ছিল পারম্পরিক সহাবস্থানের শৃঙ্খলা। এই বহু স্রোতবাহিত প্রাজ্ঞ বাংলায় বিভেদের বীজ প্রথম প্রথিত হয় পৌরাণিক যুগে। বুদ্ধের পঞ্চশীল ও অষ্টাঙ্গিক মার্গের বিরুদ্ধে প্রতিবিপ্লব সংগঠিত করার জন্য রচিত হয় পঞ্চানন তথা অষ্টবক্র শিবকাল্ট। তান্ডব, সংহার ও পুরাতনকে ধ্বংস  করে  নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার আহ্বান জানান হয় শিবকাল্টের মধ্য দিয়েবাংলায় এই শিবকাল্টের পুষ্টি লাভ করে রাজা শশাঙ্কের পৃষ্ঠপোষকতায়।  
রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বর্ণনা করেছেন যে শশাঙ্ক ছিলেন গুপ্ত রাজাদের বংশধর। ইনি  রাঙামাটির সামন্ত ছিলেন। কালক্রমে গৌড়, রাঢ়, তাম্রলিপ্ত থেকে শুরু করে সমস্ত বঙ্গদেশে  তার রাজ্য বিস্তৃত হয়। ৬০৬- খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিনি গৌড়ের স্বাধীন রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন এবং কর্ণসুবর্ণে নিজের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় মৌখরী গুপ্তদের সাথে কয়েক পুরুষ ধরে যুদ্ধ চলতে থাকে। গৌড় মগধের অধিকারই এই দীর্ঘ দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ। গ্রহবর্মা যখন মৌখরীর রাজা হন তখন দেবগুপ্ত মালবের সিংহাসনে আরোহণ করেন। গ্রহবর্মা থানেশ্বর রাজ প্রভাকরবর্ধনের কন্যা এবং রাজ্যবর্ধনহর্ষবর্ধনের ভগিনী রাজ্যশ্রীকে বিবাহ করেন। দেবগুপ্ত মৌখরীরাজ গ্রহবর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আগ্রসর হলে শশাঙ্ক দেবগুপ্তের পক্ষে যোগদান করেন। এই যুদ্ধে শশাঙ্ক এবং দেবগুপ্ত গ্রহবর্মাকে হত্যা করেন এবং রানী রাজ্যশ্রীকে বন্দী করে কনৌজে নিয়ে আসেন দেবগুপ্ত এরপর থানেশ্বরের দিকে অগ্রসর হলে রাজ্যবর্ধন তাকে পরাজিত নিহত করেন। রাজ্যবর্ধন নিজ ভগিনীর শৃঙ্খল মোচনের জন্য কনৌজের  দিকে অগ্রসর হলে শশাঙ্ক তাকে বাঁধা দেন। রাজ্যবর্ধন একদিকে সৎ সাধু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। অন্যদিকে ছিলেন পরাক্রমশালী। শশাঙ্ক তার সাথে মধুর ব্যবহার করে মনের সমস্ত সন্দেহ দূর করে গৌড়ে নিমন্ত্রণ করে পাঠান এবং রাজধানীতে নিয়ে এসে নিরস্ত্র অবস্থায় গোপনে হত্যা করেন। সাময়িক ভাবে কনৌজের দখল আসে শশাঙ্কের হাতেকিন্তু এই স্বল্পকালীন সময়ের মধ্যেই তিনি বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সৌধগুলি ধ্বংস করতে শুরু করেন। বানভট্টের হর্ষচরিত, হিউএন-সাং এর বিবরণী এবং সমকালীন গ্রন্থ মঞ্জুশ্রীমুলকল্পে শশাঙ্কের এই বিদ্বেষ কাহিনীর সমস্ত ঘটনা লিখিত আছে। হিউএন-সাং এর বিবরণী থেকে পাওয়া যায় যে, রাজা শশাঙ্ক কুশীনগরের বুদ্ধ বিহার থেকে সমস্ত ভিক্ষুদের বের করে দিয়ে ছিলেন। বুদ্ধের পদচিহ্ন অঙ্কিত পবিত্র পাথর গঙ্গার জলে নিক্ষেপ করেছিলেন, জিঘাংসায় উন্মত্ত হয়ে বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষকে  সমূলে উৎপাটন করে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং বুদ্ধের মূর্তি ধ্বংস করে সেখানে শিবের মূর্তি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন কিন্তু এই কাজে ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী বুদ্ধের মূর্তি ভাঙার সাহস পাননি।  তিনি একটি প্রাচীর  তুলে বুদ্ধ মূরতিকে আড়াল করে দেন। এরপর পাটলিপুত্র, কুশী নগর, কর্ণসুবর্ণ, রক্তমৃত্তিকা থেকে শুরু করে তাম্রলিপ্ত পর্যন্ত সমস্ত বুদ্ধ বিহারগুলি ধ্বংস করার নির্দেশ দেন শশাঙ্ক এই গ্রন্থগুলিতে উল্লেখ করা  হয়েছে যে, বুদ্ধ বিহার গুলি ধ্বংস করার পর শশাঙ্ক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বিশেষত হর্ষবর্ধন থানেশ্বররাজ হিসেব অভিষিক্ত হলে এই আতঙ্ক এক বিভীষিকায় পরিণত হয়। হর্ষবর্ধন তাকেগৌড়ভুজঙ্গনামে অভিহিত করেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, ‘যে পর্যন্ত এই গৌড়াধিপ শশাঙ্ককে আমি হত্যা না করিতে পারিব, সে পর্যন্ত আহার বিষয়ে দক্ষিণ হস্তের ব্যবহার করিব না’ (বৃহৎ বঙ্গ, দীনেশ চন্দ্র সেন, পৃ ২২০) কথিত আছে যে, এই কালান্তক ঘোষণায় ভীত হয়ে শশাঙ্ক রাজ্যশ্রীর বন্ধনমুক্ত করেন হর্ষবর্ধন কনৌজ মুক্ত  করার পর রাজ্য বর্ধনের হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য গৌড়ের দিকে অভিযান শুরু করেন। দীর্ঘ কালীন এই যুদ্ধে শশাঙ্কের রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। খাদযুক্ত স্বর্ণমুদ্রা মুদ্রা প্রচলন করেও তিনি রাজস্বের ঘাটতি  আটকাতে অসক্ষম হন। পরিশেষে হতাশা, আতঙ্ক, পরাজয়ের গ্লানি রোগভোগে তিনি মারা যান।
অধ্যাপক নীহার রঞ্জন রায়, শশাঙ্কের এই বৌদ্ধ বিদ্বেষের কারন স্বাভাবিক হিসেবে বর্ণনা করে বলেছেন যেপ্রথমত, এই যুগে ব্রাহ্মণ্যধর্ম সংস্কৃতি ক্রমশ বিস্তার লাভ করিতেছিল বাংলা আসামের সর্বত্র... কোন কোন রাজ বংশ এই নবধর্ম সংস্কৃতির গোঁড়া পোষক ধারক  হইবেন, ইহা কিছু অস্বাভাবিক নয়। ......দ্বিতীয়ত, শশাঙ্কের অন্যতম প্রধান শত্রু হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ ধর্মের অতিবড় পোষক; শত্রুর আশ্রিত লালিত ধর্ম নিজের ধর্ম না হইলেও তাহার প্রতি বিদ্বেষ স্বাভাবিক (বাঙালীর ইতিহাস, পৃ ৩৭৪)  

বৌদ্ধ বিহার গুলি ধ্বংস করার আর একটি পর্যায় শুরু হয় হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর। পুলকেশীর সাথে যুদ্ধে পরাজয় ঘটলে তারই ব্রাহ্মণ আমত্যের হাতে নিহত হন হর্ষবর্ধন তার মৃত্যুর পর কনৌজ ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয় কুমারিল ভট্টের নেতৃত্বে শুরু হয় ধ্বংসলীলা বুদ্ধ বিহারগুলি মন্দিরে পরিবর্তিত করে তার সমস্ত সম্পদের উপর দখল নেয় কুমারিল ভট্টের বাহিনী। গুড়িয়ে দেওয়া হয় বুদ্ধবিহার।   হাজার হাজার বৌদ্ধ শ্রমণকে হত্যা করা হয় জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বৌদ্ধ শাস্ত্ররাশি অনেক বৌদ্ধ শ্রমণ পুঁথিগুলি বাঁচানোর জন্য হিমালয়ের রাজ্যগুলিতে আশ্রয় নিতে বাদ্ধ হন
পালযুগের সুশাসনে পূর্ব জনপদ আবার স্বমহিমায় প্রকাশিত হলেও সেনেদের সময় বুদ্ধ বিহারগুলির উপর আবার নেমে আসে ধ্বংসের খাড়া   বিশেষত লক্ষন সেনের সময় বুদ্ধ বিহারগুলির গাত্র থেকে অপূর্ব গান্ধার শিল্প সমন্বিত বুদ্ধের মূর্তিগুলি ভেঙ্গে ফেলে তার জায়গায় ভোগ, বিলাস, কামনা, বাসনা ও যৌনাচারের মূর্তি প্রতিস্থাপন করা হয়। ছেনি, হাতুড়ির ঘায়ে বিকৃত করে দেওয়া হয় শিলালিপি, স্তম্ভলিপি ও গিরিলিপিগুলিকে। ধ্বংস করা হয় অশোকস্তম্ভ এবং ধম্মচক্র। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা বা আসামের সমস্ত বুদ্ধ বিহারগুলির উপর দখল নিয়ে তাকে পরিবর্তিত ও হিন্দুভুত করা হয়। এই ধ্বংসকার্যের মধ্যে বীরত্বের পরম্পরা দেখে স্বামী বিবেকানন্দ গর্বের সাথে উল্লেখ করেছিলেনঃ      
 “To any man who knows anything about Indian history, that very statement proves that the whole thing was a fraud, because the temple of Jagannath is an Old Buddhistic Temple. We took this and others over and re-Hinduised them. We shall have to do many things like that yet”. (Complete Works of Swami Vivekananda, vol-3 p-264).    
এরপর বংলায় বুদ্ধ বিহার ধ্বংসের ইতিহাস পাওয়া যায় বক্তিয়ার খিলজির আক্রমণের সময়। খিলজি নদীয়ায় আসার পথে একটি বিরাট সঙ্ঘারামকে দুর্গ মনে করে তা ধ্বংস করে দেন। নিরিহ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের হত্যা করেন এবং গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দিয়ে বিজয়ীর গর্ব অনুভব করেন। বক্তিয়ার খিলজি পরবর্তীকালে এই বৌদ্ধ বিহার ও গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেবার জন্য লজ্জিত হন কেননা বাংলার ঐতিহাসিক তথ্য জোগাড় করতে গিয়ে যখন বুঝতে পারেন যে তিনি নিজে হাতেই ইতিহাস ধ্বংস করেছেন তখন তিনি অনুতাপ বোধ করেন।   

ধ্বংসের এই ইতিহাসগুলি থেকে সহজেই ধরে নেওয়া যায় যে তাম্রলিপ্ত অঞ্চলে অবস্থিত বান্দান বা মোগলমারি বুদ্ধ বিহারটি শশাঙ্ক বা সেন আমলের কোন এক সময় ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। কেননা বক্তিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের পরিকল্পিত পথ তাম্রলিপ্তের প্রাচীন পথ থেকে ভিন্ন।       
                    
মোগলমারির প্রত্ন নিদর্শনঃ
বান্দান, সখীসেনার ঢিবি বা মোগলমারিতে এপর্যন্ত যে ৬টি খননকার্য চালানো হয়েছে তা নিতান্তই সীমিত এখনো সিংহভাগ কাজ পড়ে আছে। এই  খননকার্য  থেকে পাওয়া প্রত্ন নিদর্শনগুলি নিয়ে পুরাতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা একটি সম্ভাব্য কালে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করছেন। বিশেষ করে মোগলমারির প্রত্ন নিদর্শনগুলি নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের, দাঁতনে অবস্থিত ভট্টর কলেজের অধ্যাপক মাননীয় অন্নদাশঙ্কর পাহাড়ি মহাশয় একটি মনোজ্ঞ প্রবন্ধ লিখেছেনযে প্রবন্ধটি কোলকাতার বৌদ্ধ ধর্ম্যাঙ্কুর সভা পরিচালিত, মাননীয় হেমেন্দুবিকাশ চৌধুরী সম্পাদিত জগজ্জোতি পত্রিকায় ‘বিবেকানন্দ মননে বুদ্ধ’ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। মাননীয় অন্নদাশঙ্কর পাহাড়ি মহাশয় এখানে প্রাপ্ত প্রত্ন নিদর্শন গুলির উপরে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন। তাই এই ধরণের বিশ্লেষণের পুনরাবৃত্তি করা থেকে বিরত থাকছি। কিন্তু প্রাপ্ত সামগ্রীর কিছু নিদর্শন এখানে রাখলে এই বুদ্ধ বিহার সম্পর্কে পাঠকদের একটি প্রাথমিক ধারনা তৈরি হতে পারে। এই কারণেই এখানে খননকার্যে পাওয়া কিছু নিদর্শনের উল্লেখ করা হলঃ  

-      বুদ্ধ বিহারটি চতুস্কোনাকৃতি (৬০/৬০ মিটার)। চারিদিকে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা।
-      প্রাচীরের বাইরে একটি পরিখা। পরিখাটি জলনিকাশি ব্যবস্থার সাথে যুক্ত।
-      দেয়ালগুলিতে সুচিত্রিত নানা মূর্তি।
-      পাওয়া গেছে ভগবান বুদ্ধের একটি প্রস্তর মূর্তি।
-      এছাড়া পাওয়া গেছে নানা রঙের মাটির বাসন, মাটির প্রদীপ এবং পিলসুজ
-      বিহারটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে ৪০ প্রকার বিভিন্ন আকারের ইট।
-      একটি জাঁতাকল, হামানদিস্তার মোটা পাথর।
-      লাল রঙের একটি মাটির পাত্রের মধ্যে অনেক লোহার পেরেক।
-      কাঠ কয়লার স্তুপ।
-      কতগুলি কড়ি।
-      পাওয়া গেছে ব্রাহ্মী লিপিতে লেখা মাটির তৈরি শিলমোহর।
-      প্রাচীরের বাইরের দেয়ালে পাওয়া গেছে বুদ্ধের উপবেশন মুদ্রায় নানা মূর্তি, যক্ষিণী-মূর্তি,  রমণী মূর্তি যার হাতে আছে প্রস্ফুটিত পদ্মফুল।           
বুদ্ধ বিহারটির পরিপূর্ণ খননকার্য শেষ হলে আরো গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন সামগ্রী আবিষ্কৃত হবে সন্দেহ নেই। সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বুদ্ধ বিহারটির স্তুপমূলের খনন এখনো বাকি। এই খনন আশু প্রয়োজন। এই খননকার্য তরান্বিত হলে বেরিয়ে আসতে পারে আরো অসংখ্য প্রত্ন সামগ্রী এবং সেই সামগ্রী গুলির যথার্থ বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা নিরীক্ষার মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে যাবে এর সমকালীন সভ্যতার ইতিহাস।   
                  
বিজ্ঞপ্তি বিজ্ঞাপনের তারতম্য  
নব আবিষ্কৃত এই বুদ্ধ বিহারের ক্ষেত্র সমীক্ষা করতে গিয়ে আমাদের কাছে সরকারী বেসরকারি উদ্যোগে যে ব্যবস্থাপনা নেওয়া হয়েছে তার নানা অসংলগ্ন চিত্র ধরা পড়ে। প্রথমতঃ এমন একটি ঐতিহাসিক নিদর্শনের একেবারে স্তুপমুলে যে ভাবে একটি ক্লাব বা পাঠাগার গড়ে উঠেছে এবং তাকে সরকারি শিলমোহর দেওয়া হয়েছে তা অপরিণামদর্শিতার চূড়ান্ত নমুনা। প্রত্ন নিদর্শনগুলিকে যে অবজ্ঞায়  উপস্থাপন করা হয়েছে তা সর্বকালের সভ্য সমাজকে লজ্জা দিতে পারে। খোলা আকাশের নিচে শুধু মাত্র তাবু দিয়ে মূর্তিগুলিকে ঢেকে রেখে চোরাকারবারীদের উৎসাহিত করা হয়েছে। কোনধরনের নিরাপত্তারক্ষী রাখার তাগিদ সরকারের নেই।
এই বুদ্ধ বিহারের দক্ষিণ পূর্বদিকের জমিগুলিতে অবৈধ দখলদারী শুরু হয়েছে। একেবারে গাঁ ঘেসে তৈরি হয়েছে বসতি। এই দখল করা জমির উপর গড়ে উঠেছে কংক্রিটের বাড়ি। বর্তমান প্রবেশ পথের ডানদিকে একটি বিজ্ঞপ্তি রয়েছে। বিজ্ঞপ্তিটিতে জানান হয়েছে যে, এই পুরাকীর্তিটি “পশ্চিমবঙ্গ ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি ও পুরাবস্তু সংরক্ষণ এবং প্রত্নক্ষেত্র খনন আইন, ১৯৫৭(৩১নং আইন, ১৯৫৭) –এর ৩ ধারার ১ উপধারা অনুসারে, ‘রাজ্য সংরক্ষিত’ (বিজ্ঞপ্তি নং ৪১৯৫/ আই.সি.এ তাং মার্চ ৭, ২০১৩) হিসাবে ঘোষণা করা হইয়াছে।
কোন ব্যক্তি এই পুরাকীর্তির ক্ষতি, অঙ্গনাশ, বিকৃতি সাধন, স্থানচ্যুত, অপসারণ, পরিবর্তন বা ধ্বংস করিলে উক্ত আইনের ১৬ ধারা অনুসারে তাহার অর্থ–দন্ড অথবা ৩ মাস পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হইবেন”।

এই বিজ্ঞপ্তির পাশেই আর একটি বিজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে দাঁতন ভট্টর কলেজ এবং তরুণ সংঘ ও পাঠাগারের পক্ষ থেকে। অর্থাৎ জ্ঞাতে হোক বা অজ্ঞাতে হোক বিজ্ঞপ্তি আর বিজ্ঞাপনের মধ্যে একটি দ্বান্দ্বিক অসামঞ্জস্য ইতিমধ্যেই প্রকট হয়ে উঠেছে। ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে নানা আরোপিত কাহিনী। কয়েকটি মূর্তিকে যে ভাবে সিমেন্ট-বালি দিয়ে জোড়াতালি বা বিকৃত করে প্রদর্শন করা হচ্ছে তাতে “পশ্চিমবঙ্গ ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি ও পুরাবস্তু সংরক্ষণ এবং প্রত্নক্ষেত্র খনন আইন, ১৯৫৭(৩১নং আইন, ১৯৫৭) –এর ৩ ধারার ১ উপধারার প্রত্যক্ষ অবমাননার সামিল! সরকারী ব্যবস্থাপনা বা নিরাপত্তার অভাবে স্থানীয় মানুষেরা বুদ্ধ বিহারটির ইট এবং নানা মূল্যবান প্রত্ন সামগ্রী বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন তার প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে সব মিলিয়ে প্রত্ন খনন, সংরক্ষণ, তার পরীক্ষা নিরীক্ষা, বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনের আন্তরিকতার অভাবে নানা অনভিপ্রেত জটিলতা দেখা যাচ্ছে। দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস উদ্ঘাটনের স্বার্থে এগুলি বন্ধ হওয়া দরকার। দরকার স্বচ্ছতার ও বিশ্বাসযোগ্যতার।

নির্বাক ইতিহাস, ধবংসের মলিন চাদর জড়িয়ে শুয়ে  আছেবিগত কোন বিস্মৃতির এক অজ্ঞাত   আস্তরণের নীচে ঢাকা পড়ে আছে তার আত্তপরিচয়। নিথর, নির্লিপ্ত পাষাণ বুক জুড়ে হয়তো লেখা আছে কোন কালের কবিতা। বর্ণে বর্ণে হয়তো ছড়িয়ে আছে পুঞ্জিভূত অভিমান। একটি ভরসার জন্য হয়তো সে এখনো আগলে রেখেছে ভাঙ্গা বুকের সমস্ত সম্পদ ভাবিকালের কাছেই তার দাবী, তার সমস্ত অভিযোগআমরা সচেতন হলে,  একটু যত্নবান হলে হয়তো অর্থবোধক হয়ে উঠতে পারে তার সরল সাঙ্কেতিক ভাষা এটাই বিবর্তনের পথ, উত্তরণের নবতম সিঁড়িঅতীত সজীব হলে, উত্তরণের এই সিঁড়ি বেয়ে আমরাও উজ্জ্বল ইতিহাসের উত্তরসূরি হিসেবে দাবী জানাতে পারব।           



তথ্য সূত্র ঃ
   পরিদর্শক দলের প্রাথমিক ক্ষেত্রসমীক্ষা,  ০৩/০৫/১৪
  বাঙালীর ইতিহাস, অধ্যাপক নীহার রঞ্জন রায় (তৃতীয় অধ্যায়, দেশ-পরিচয়, পৃ ৯১)
 প্রাচীন হিন্দুদের সমুদ্রযাত্রা ও বানিজ্য বিস্তার, অক্ষয় কুমার দত্ত(প্রকাশক, রজনী নাথ দত্ত)
 বাংলার ইতিহাস, রমেশচন্দ্র দত্ত, প্রথম খণ্ড।
বৃহৎ বঙ্গ, দীনেশচন্দ্র সেন, প্রথম খণ্ড।
সোনার দাঁড় পবনের বৈঠা, শরদিন্দু বিশ্বাস, গণশক্তি শারদ সংখ্যা, ১৯৯৯
Complete Works of Swami Vivekananda, vol-3 p-264
মোগলমারি বৌদ্ধ বিহারঃ বিহঙ্গ অবলোকন, অন্নদা শঙ্কর পাহাড়ী, জগজ্জোতি,‘বিবেকানন্দ মননে বুদ্ধসংখ্যা
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা ও গঙ্গারিডি সংস্কৃতি, নরোত্তম হালদার, পশ্চিমবঙ্গ, ১৪০৬
বাঙালীর ধর্ম ও সমাজ, যতীন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, নিউ এজ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড।
১০The Root of Bengali Culture, Samaren Roy, FIRMA, KLM Private Limited, Calcutta,1981.     
             
                                  

1 comment:

  1. অসাধারণ আলোকপাত করেছেন। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে

    ReplyDelete