Pages

Thursday, 22 October 2015

ওরা বড় দূর্গা দেখতে দিল না... প্রবীর মজুমদার।

বাংলার কমিউনিস্টগণ একটা সময় গাইতেন "ওরা জীবনের গান গাইতে দেয় না।" কিন্তু তাঁরা কয়দিন ধরে গাইতে শুরু করেছেন, "ওরা বড় দূর্গা দেখতে দিল না...।" প্রগতিশীলতার স্বঘোষিত কান্ডারী কমিউনিস্টগণ তাঁদের পিতা মার্কসসাহেবের মার্কামারা বক্তব্য পরিহার করে ধর্ম-আফম সেবনের উপকারীতা অনুধাবন করেছেন। একটা ক্লাবের পুজো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যেন জাতীয় শোক নেমে এসেছে! তাই ফেসবুকের পাতায় পাতায় কেঁদে ভাসাচ্ছেন কিছু দূর্গা-ভক্ত। ভক্তগণের তালিকায় উগ্র-হিন্দুত্ববাদীও যেমন আছেন, তেমন আছেন তথাকথিত প্রতিক্রিয়াশীল কিংবা সেকুলার ডানপন্থী। কিন্তু এই গড্ডলিকা প্রবাহে কমিউনিস্টদের দেখছি কেন? পুজো বন্ধ হওয়ায় অনেক কমিউনিস্টই নাকের জলে চোখের জলে ভাসছেন। কেউ কেউ বলছেন, পুলিস মন্ত্রী নাকি দেবীদূর্গাকে বোরখা পরিয়ে ছেড়েছেন! এই রকম মন্তব্য কি সম্প্রদায়িক উস্কানি মূলক নয়? রাজনৈতিক ক্ষুদ্র স্বার্থসর্বস্বতা নয়? নাস্তিকতা প্রকৃত কমিউনিস্টের একটা বৈশিষ্ট, কারণ ধর্ম শোষনের একটা যন্ত্র। তাহলে কি কমিউনিস্ট নামে যাঁরা নিজেদের পরিচয় দেন তাঁদের বেশির ভাগই আদৌ কমিউনিজমে বিশ্বাসী নন, কিংবা আদৌ কমিউনিজম জানেন না? নাকি, কমিউনিজম তাঁদের একটা মুখোস। মুখোসের আড়ালে রয়েছে উগ্র-হিন্দুতাবাদী মুখ?

আসলে ধর্মীয় উন্মাদনার মধ্যে যুক্তিবাদ অসহায় হয়ে পড়েছে, খুঁজে নিয়েছে কুযুক্তির সান্তনা। কী সেই কু-যুক্তি? পুজোর আনন্দ নাকি মৌলিক অধিকার! কিন্তু একজনের আনন্দ অন্যের অসুবিধার কারণ হতে পারে না। আনন্দ করার জন্য যদি পথ অবরোধ করা হয়, তাহলে সেই আনন্দ বর্জনীয়। পাড়ায় পাড়ায় পথ আটকে যে সব পুজো হচ্ছে সে-গুলোকে কী করে সরকার অনুমতি দেয়? পুজোর মন্ডপ যদি খোলা মাঠে গড়ে ওঠে তাতে আপত্তি করা সাজে না, কিন্তু পুজোর জন্য সাত-আটদিন রাস্তা আটকে রাখা কি সমর্থন করা যায়? অন্ততপক্ষে অ্যাম্বুল্যান্স কিংবা ফায়ার ব্রিগেডের গাড়িকে নির্বিগ্নে চলার পথ দেওয়া সম্ভব না হলে তা যথেষ্ট বিপজ্জনক নয় কি? পথ পথচারীর জন্য। পথচারীর গতিরোধ করা কোন ধর্মের অধিকারের মধ্যে পড়ে না। যদি কোন আন্দোলনকারী কিংবা ধর্মাবলম্বীদল সেই অপচেষ্টা করে তাহলে সরকার বল প্রয়োগ করুক। প্রকৃত প্রগতিবাদী শুভবুদ্ধ সম্পন্ন জনতা সরকারকে সাধুবাদ জানাবে। কিন্তু ভারতবর্ষ, যেখানে ভোটের চিন্তায় সকল নীতি নির্ধারণ করা হয়, সেখানে কোন সরকারের সেই হিম্মত হবে কী?
বড় চেয়ে বড় দূর্গা পুজো বন্ধ হল কেন, সরকারের কোন গাফিলতি আছে কিনা-- সে-সব ভিন্ন প্রশ্ন। আসল চিন্তার বিষয় হল, দূর্গা-পুজোর এই জাঁকজমক সামাজিক, মানসিক, অর্থনৈতীক ও আদর্শগত অবক্ষয়ের কারণ হয়ে উঠছে কিনা! বন্‌ধের বন্ধা সংস্কৃতির মতই দূর্গাপুজোর উন্মাদনাও অনর্থ বয়ে আনছে কিনা অনুগ্রহ করে একটু ভেবে দেখবেন।
-------------------------------------------------------------
© প্রবীর মজুমদার।

Sunday, 11 October 2015

সুরালোকে জয় জয় হে মহিষাসুর মর্দিনী !!!




বেদের সময় দেবতারা দুটো প্লানেট বানিয়েছিলেন।
স্বর্গলোক আর মর্তলোক।
দেবতারা আবার আকাশকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন এই দুই লোকের মধ্যে।
কি বিশ্বাস হচ্ছেনা?

আরে বাবা বিশ্বাস করুন দেবতারা সব পারেন।
পারেন বলেই তারা আবার একটি প্লানেট তৈরি করলেন।
তার নাম দিলেন পিতৃলোক।
আপনারা বলতেই পারেন আবার “পিতৃলোক” কেন বাবা?
স্বর্গেতো খানাপিনার অভাব নেই!
অবাধ ফুর্তি আর অবাধ সুরা!
ওটাই তো দেবতাদের স্থায়ী ঠিকানা!

আরে বোঝেন না কেন?
ওটাতো অমর লোক!
ওখানে জন্ম নেই মৃত্যুও নেই!
আর ওখানে দেবতাদের সংখ্যা এতো বেশি!
বাপ রে বাপ অত সংখ্যায় উর্বশী নেই!
কোথাও না কোথাও দেবতাদের বংশ রক্ষা করতে হবেতো?

তাই দেবতারা মাঝে মাঝে মর্তলোকে আসেন।
লীলা করেন।
হাজার হাজার মর্তের নারীকে সুরাসংস্কৃতি শেখান।
দেবালয় স্থাপন করেন।
দেবদাসী সংগ্রহ করেন।
দেবালয়ের পাশেই সুরাপল্লী গড়ে তোলেন।
আবার এই সুরাপল্লীর সংস্কৃতিকে একেবারে অন্দরমহল পর্যন্ত নিয়ে যাবার জন্য পুরুতগিরি করতে হয়।
ঝক্কি তো কম নয় বাবা!
ঝুকিও আছে।
এই ঝুকি পূর্ণ কাজ করতে গিয়ে মর্তের নিয়মানুসারে দেবতাদের মৃত্যু হতে পারে।
ওহ থুড়ি! থুড়ি!
আগেই বলে রাখা উচিৎ ছিল যে, মর্তের বামুনেরা হল দেবতাদের এলিয়েন( যজুর্বেদ অনুসারে)।
তা এই মর্তের বাতাস লেগে দেবতাদের মৃত্যু হলেতো চলবেনা বাপু!
তাদের আবার স্বর্গলোকে ফিরতে হবে।
তাই স্বর্গলোকে ফেরার আগে বিশুদ্ধতা যাচাই করার প্রয়োজন।
কিন্তু ততদিন ওই দিদেহী এলিয়েনের একটা থাকার জায়গা করে দিতে হবে তো?
তাই পিতৃলোকের পরিকল্পনা।
ওই পিতৃলোকে অবস্থান কালে এলিয়েনেরা স্বর্গলোকে যাবার জন্য প্রেতাত্মা হয়ে ঘুরে বেড়াবে।
তাদের ক্ষেত্রজেরা পৃথিবীতে অবস্থানকারী আর একটা বামুন ডেকে আদ্যশ্রাদ্ধ করবেন।
গুষ্টির পিণ্ডী দেবেন।
তারপর পিতৃপক্ষের শেষ হবে।
সুচনা হবে মাতৃপক্ষের।
অর্থাৎ পৃথিবীতে আরো কত মাকে সুরা সংস্কৃতির আওতায় নিয়ে আসা যায়, আরো কত সুরাপল্লী বানানো যায়, সুরা সংস্কৃতিকে একেবারে প্রত্যহিক করে তোলা যায় তার প্রস্তুতি সুরু হবে। এই মহান কাজকে আলয় আলয় পর্যন্ত ধ্বনি প্রতিধ্বনিত করে তুলতে হবে। মানুষের ঘুম ভাঙবে মহালয়ার এই পূন্য সুরাসংস্কৃতির আহ্বানে। “ইয়া দেবী সর্ব ভুতেসু মাতৃরূপেন সংস্থিতা”।
১৯৩১ সালে মর্তের এলিয়েনরা বাংলার বুকে এমনি এক সুরা সংস্কৃতির অবতারণ করলেন। পিতৃকুলকে সুরালোকে পাঠানোর জন্য, মর্তের মাকে সুরাপল্লীর উপযুক্ত করে গড়ে তোলার জন্য তৈরি হল মহিষাসুর মর্দিনীর উপখ্যান।

www.durgautsav.com/mahalaya-mahishasura-mardini-full-mp3-download/
 
 https://www.google.co.in/url?sa=t&rct=j&q=&esrc=s&source=web&cd=12&cad=rja&uact=8&ved=0CE8QtwIwC2oVChMIy8SBkoC8yAIV0EqOCh3XwQAd&url=https%3A%2F%2Fwww.youtube.com%2Fwatch%3Fv%3D1X2kjzMjMC4&usg=AFQjCNHqEUrPmz-n_aRS3LlsSEjHr3295g&sig2=SCPSDLEj0KPCnDJyppHuHA
বানীকুমার রচনা করলেন স্তোত্র।
পঙ্কজ মল্লিক দিলেন সুর ও তাল।
বীরেন্দ্র কুমার ভদ্র দায়িত্ব নিলেন গ্রন্থনার।
গন্ধর্ব, কিন্নর, কিন্নরীদের সুললিত কণ্ঠে আকাশবাণীর মাধ্যমে ধ্বনিত হল “আয়ে গিরি নন্দিনী নন্দিতা মেদিনী... জয় জয় হে মহিষাসুর মর্দিনী...।।

Monday, 5 October 2015

বাজাও ডাংকা উড়াও নিশান : শরদিন্দু উদ্দীপন



 









শরীর জুড়ে ঘুন পোকা
অহরাত্র জীর্ণ করছে হাড়মাস
পঞ্চ ইন্দ্রিয় অসাড়
তাই রূপ রস গন্ধ বিবেচনা যুক্তিহীন।
এমন ঘোরের ঘরেই চোর ঢোকে বারবার
সিঁধেল ছিচকে নানা বেশে
লুটে নেয় পিতৃধন
সঞ্চিত পুঁজি
লুটে নেয় আত্তপরিচয়।
তারপর...
গায়ে ছেড়া কাঁথা
কাঁধে ভাঙ্গা ঢোল
পারের কান্ডারী খুঁজে এ ঘাট ওঘাট
অবিন্যস্ত দিশাহীন
মুখে হরিবোল!!

Thursday, 1 October 2015

অসুর ধম্ম ও দর্শনঃ




সুরাসুর ধারণা এবং দ্বন্দ্বটি ব্রাহ্মন্যবাদী সাহিত্যেরই উৎপাদিত ফসল। মূল ভারতীয় অসুর সাহিত্যে বিশেষ করে আজীবিকা, চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ বা মতুয়া সাহিত্যে এই দ্বন্দ্বকে একেবারে ধর্তব্য বিষয় হিসেবে দেখা হয়নি। মূল ভারতীয় দর্শনেরর ধারা বরং সমগ্র জগতের মূর্ত-বিমূর্ত, জীব-জড়, অক্ষয়-ক্ষয়িষ্ণু, অচল-চলমান বস্তু জগতের মধ্যে প্রেম, প্রীতি, দয়া, মায়া, করুনা ও ক্ষমার মধ্য দিয়ে বসুধৈবকুটুম্ব নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বুকের মাঝে বিশ্বলোকের সাড়া পাবার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে
শৈশব থেকেই উপলব্ধি করছি যে, সুর এবং অসুর দ্বন্দ্বটি বাংলা তথা ভারতবর্ষে একটি প্রবাহমান বিবাদের প্রকট অংশ। এটিও উপলব্ধি করতে পারছি যে এই দ্বন্দ্বদের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলেই মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ সুরালোকে উন্নিত হয়ে সমস্ত মধুভান্ডকে চেটাপুটে খেয়ে সাবাড় করছে আর একদল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে অসুর বা অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারার চেষ্টা হচ্ছে। জীব সত্তার সার্বিক বিকাশের কারণেই এই সুর এবং অসুর দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।

সুর, সুরা ও সুরালোকঃ   
১।‘হে ইন্দ্র এবং অগ্নি ...হে সর্ব ক্ষেত্রের বীরগণ, এখানে আস এবং যে সুরা (সোমরস) ঢালা হয়েছে তা পান করো’।। ঋগ্বেদ ১।১০৮।৮
২। “হে ইন্দ্র! তুমি সুরাপানে মত্ত হয়ে যজ্ঞবিহীন জনসংঘদের পরস্পর বিরোধী করে উভয়কেই বিনাশ করো”। ঋগ্বেদ ৮।১৪।১৫
৩। “হে ইন্দ্র, যারা যজ্ঞাদি অনুষ্ঠান করে না, যারা ব্রাহ্মণ ও মন্ত্রাদির প্রতি বিদ্বেষ করে তারা সঙ্গতি সম্পন্ন হলেও তাদের অন্ধ করে বিনাশ কর”।
ঋগ্বেদ ৫।৪২।৯
৪। “হে ইন্দ্র, তোমার ঘূর্ণায়মান অস্ত্রের আঘাতে ঐ সব অস্ত্ররহিত অসুর যারা দেবতা ও ব্রাহ্মণ বিরোধী তাদের তাড়িয়ে দাও”।  ঋগ্বেদ ৮।৯৬।৯
৫। “হে ইন্দ্র, তুমি মহান। তুমি অসুরদের কাছ থেকে লুন্ঠন করা ভোগ্যবস্তু ও ধন সকল দান করে পুরোহিতদের ধনবান করো”। ঋগ্বেদ ৮।৯৭।১
সুরসমাজ বা দেবসমাজের চরিত্র এবং দর্শন বোঝাতে  ঋগ্বেদ থেকে  কয়েকটি শ্লোক এখানে দেওয়া হল। প্রিয় পাঠকদের এগুলিকে যাচাই করে নেবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। এগুলি থেকেই অনুমান করতে পারবেন যে সুরসমাজ ছিল লোভী, লুণ্ঠনকারী, ভোগী, বর্বর, যজ্ঞব্রতী, ব্রাহ্মন্যবাদী, অসহিষ্ণু এবং হত্যাকারী।

অসুর, অসুরা ও অসুরলোকঃ
বেদের বর্ণনা থেকেই পরিষ্কার যে অসুর সমাজ ছিল প্রজ্ঞাবান ও যুক্তিবাদী। অসুরেরা ছিলেন যজ্ঞরহিত, অস্ত্ররহিত বা নিরস্ত্র। এদের ধম্ম ছিল আলাদা। দেবসমাজ (এক জাতীয় বর্বর যাযাবর মানুষ। আবেস্তাতে দেবতাদের দুশ্চরিত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে) তাই এদের অন্য ব্রত বলে অভিহিত করেছে।

সব থেকে মজার ব্যাপার হল যে, সুরাপানের মধ্য দিয়ে দেবতারা যে শক্তি সঞ্চয় করত তা যাতে কিছুতেই অসুরদের হস্তগত না হয় তার জন্য দেবতারা সদা সতর্ক ছিল।
অর্থাৎ অসুর সমাজের মধ্যে যে সুরাপানের প্রচলন ছিলনা তা সহজেই বোঝা যায়। অথবা সমাজ বিবর্তনের কোন এক বাকে এসে অসুর সমাজের মধ্যে যে সুরাপানের অভ্যাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তা অনুমান করা যায়।   
অসুর রাজা ত্বস্টা আবার এই সুরা উৎপাদন করার চেষ্টা করলে ইন্দ্র ত্বষ্টার সব সুরা পাত্র ভেঙ্গে ফেলেছিল। (ঋগ্বেদ ১০।৮।৯) সমুদ্র মন্থন থেকে জানা যায় কি ভাবে সুধা বা মদ উৎপন্ন করার পরেও অসুরদের  বঞ্চিত করা হয়েছিল।
 
সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল আসুরেরা ছিলেন অস্ত্ররহিত। পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় যে অসুর দর্শন এমন উচ্চমার্গে উন্নিত হয়েছিল যে ন্যায়ের শাসন বলবত করতে কোন অস্ত্রের প্রয়োজন হত না। প্রজ্ঞা এবং ন্যায় দণ্ডই ছিল অসুর শাসনব্যবস্থার মূল স্তম্ভ।

মানুষে মানুষে বিভেদের বেড়া ভেঙ্গেছিল অসুর সমাজ। সাম–দাম-দন্ড-ভেদ নয়, বৈরি দিয়ে বৈরিতাকে ধ্বংস নয়, বরং ভালবাসার মধ্য দিয়ে হৃদয় জয় করে শত্রুতার অবসান ঘটানোই ছিল অসুর সমাজের সনাতন বিশ্বাস। এই সনাতন বিশ্বাস বা ধম্মের বানীই আমরা শুনতে পেয়েছিলাম মহামতি গোতমা বুদ্ধের কাছে। রোহিনী জল বিবাদ নিয়ে শাক্য ও কৌল্য সংঘের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ আসন্ন হলে তিনি শুনিয়েছিলেন অমর ভালবাসার সেই চিরন্তন বাণী।           
নাহি বেরানা বেরানি সম্মন্তিধ কুদাচনং
অবেরেনা সম্মন্তি এস ধম্ম সনাতন, আত্তদন্ড সূত্ত
 “Dhamma as I understand it consists in recognizing that enmity does not disappear by enmity. It can be conquered by love only”
বৈরি দিয়ে বৈরিতাকে ধ্বংস করা যায় না। একে কেবলমাত্র প্রেম ও ভালবাসার মধ্য দিয়ে জয় করা সম্ভব। সমস্ত সত্তার পারস্পরিক সম্পর্কের মূলাধার হল প্রেম। প্রেমই আসল ধর্ম। হত্যা কখনো কারো ধর্ম হতে পারেনা। ক্রোধ, ঘৃণা কখনো ধর্মের পরিভাষা হতে পারেনা, পরন্তু প্রেম, ভক্তি, দয়া, করুণাই হল ধর্মের আকর।

অসুর ধম্মের এই বেগবান প্রবাহ যুগে যুগে নিষ্পেষিত হলেও ফল্গুধারার মত বয়ে চলেছে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কদাকারের গ্লানি ঝেড়ে ফেলার জন্য ভগবতো হয়েছেন যুগ পুরুষেরা। ( ভগ শব্দের অর্থ যোনি বা সৃজন ক্ষেত্র। এখানে ভগবতো কথাটির অর্থ হল যিনি পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাই তিনি ভগবান। ভগবান ঈশ্বরের প্রতিশব্দ নয়)। এবং এই সব যুগ পুরুষেরাই তাদের নিজেদের কর্ম ধারার মাধ্যমে ধম্ম বা জীবন শৈলীকে আবার কলুষ মুক্ত করেছেন। ক্যাটালহক, মেহেরগড়, সুমের, মেসোপটেমিয়া, হরপ্পা, মহেঞ্জোদড়ো, গঙ্গারিডি প্রভৃতি সভ্যতার ধাপে এসে তারাই উড়িয়েছেন জীব ধম্মের সেই সনাতন নিশান।
জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।
ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।


Saturday, 15 August 2015

The death of CHUNI KOTAL : The death of Indian Democracy




There is no doubt that, Chuni’s death symbolized the Brahmin dominated characteristics of a country. Chuni’s death identified Brahmanism as a brutal system of intoxicating hate, discrimination and killing. I am attaching here the write-up of renowned writer, activist Mahasweta Devi for relooking of a SUNSET committed in 16th of August, 1992.  


 Story of Chuni Kotal

Mahasveta Devi
Chuni Kotal’s suicide has ripped the mask off the face of West Bengal under Left Front rule: the caste prejudice and persecution and the government callous indifference
                                
Chuni Kotal, a girl of 27, from the denotified Lodha tribe, the first graduate woman among the Lodha Savara and Kheria Savara of West Bengal, hanged herself on August 16, at her husband’s one room residence in Kharagpur, a railway town.
The reasons that led Chuni, a unique woman, to take her own life, are palpable ones and she “became a victim of sheer injustice and callousness of the university authorities and the West Bengal government” (The Statesman, 23/08/1992)
Chuni was appointed a Lodha social worker in 1983 at Jhargram ITDP office. From childhood she had starved , worked in the fields, had had no money to purchase books, yet doggedly she continued to study.
As a social worker she cycled 20-25 kms a day and made extensive surveys of the Lodha villages. In 1985, she graduated. In 1987, she was appointed suprintendent of Rani Shiromani SC and ST girls’ hostel at Medinapur.
Her working hours were 24 hours a day and working days were 365. No holidays, no break. If she had to leave the hostel for a few hours or a day, she had to take prior permission from the office which was very unsympathetic to her.
On one occasion her ailing father came from the village and had to stay in her room for one or two days as a hospital bed was not available. An officer of the district office accused her of entertaining men in her room.
Chuni felt suffocated in the job. Countless times she had come to Calcutta to Writer’s Building pleading for (a) transfer to her original job, or (b) better working conditions. The department remained brutally indifferent.
Matters became worse when Chuni enrolled her name with the local Vidyasagar University as an MA student in Anthropology.
Falguni Chakravarty, a male professor, from the very first day started abusing her as one coming from a criminal tribe, a low-born, who had no ‘right’ to study MA. The university authorities, the head of the department, did nothing about it.
This man was allowed to mark her ‘absent’ though she was present for days. And Chuni was debarred from sitting for examination for ‘irregular attendance’. She lost one year. The district office made life hell for her for ‘leaving the hostel’ and going to study.
In West Bengal, after so many years of Left Front rule, the first woman graduate from a very backward tribe was openly abused because of her low-caste and birth and nothing was done about it. No one was ashamed. Only Chuni suffered.
The second time Chuni sat for exam. The professor gave her low marks. Thus she lost two years. In desperation, she complained and complained and, in 1991, the education minister ordered an enquiry commission which constituted of three principals from three district colleges.
All through this man was allowed to refer to the criminal nature of her tribe, abuse her. The commission just went to sleep.
On August 13 (just 3 days prior to her suicide), there was a seminar in the university. By that time Chuni knew where she stood. She had no hope that the enquiry commission would do justice to her and punish the ‘bhadra log’, the babu, who pointed to her low birth and low-caste relentlessly. She went to the university.
Thereafter, she weepingly told a few co-students, ” today in the seminar Falguni babu, quite off the context, refered to the Lodhas as thieves and robbers. In the corridor, he threatened me, I’ll see that you don’t sit for the examination in September. I am a Lodha. So I shouldn’t have dreamt of higher studies. I complained against the offenders, but they remain untouched. Unnecessarily I wasted two years, attended classes but was not allowed to sit for the examination” (Letter to the editor, Daily Bartoman, August 25, 1992)
By August 13, she had made up her mind. Death was the only way to escape the hunters. On 14th she went to her husband. They had married in a court in 1990, but due to her job had not been able to stay together.
Her husband is a Lodha youth who is a High School and works in the railways workshop. That Chuni was a graduate and he was not had never created any friction. They had been in love with each other from 1981. They were to leave for Chuni’s village, Gohaldohi, on the 16th to talk about formal reception, a community feast after marriage.
On the 16th he left for the workshop at 6.15 am. He returned at 10.45 am and found Chuni hanging.
Chuni’s death has revealed what West Bengal truly is. Brutal caste and class hostility and persecution has been allowed to continue. The government allowed the district babu to abuse her.  The university authorities did nothing to throw out the caste-baiter.
And the commission appointed by the government submitted its report three days after her death.
স্বাধীনতা
লেবেঞ্চুস নেবেন দাদা
প্যাকেট দুটাকা
একসঙ্গে ছ’টা নিলে দশ
একেবারে দিশি
আঁটি ছাড়া খাঁটি লেবু
নেবেন লেবেঞ্চুস ?


কালতো আবার দেশ জুড়ে উৎসব
কত রং রসের সমারোহ
কত লম্ফ-
এক ফালি ন্যকড়ার এ উৎসাহ।
ঝম্প কত গান

ওখানেতো আসবে ছেলেমেয়ে
আমারা যেমন যেতাম নেচে নেচে
ক্লান্ত হবে দেশেরই গান গেয়ে
ওদের গানেই স্বাধীনতা বাঁচে।

 তোমরা খাবে মটন বিরিয়ানি সাঙ্গ হলে তেরাঙ্গাটি নাড়া
ওদের জন্য কোথায় যে জলপানি
কোথায় মিঠাই? কোথায় ছানাবড়া?
লেবেঞ্চুস নেবেন দাদা
একসঙ্গে ছ’টা নিলে দশ
দেশের গর্ব এমন পরম্পরা
ভাবিকাল যে লেবেঞ্চুসেই বশ !!

Thursday, 26 March 2015

ফেরুর পালে সিংহসাবক : শরদিন্দু উদ্দীপন, কোলকাতা।



“...সিংহ শিশু হায় ভুলি পরিচয়
মেষ দলে রহে পড়ি’। ...
আঁধার গুহায় সিংহ ঘুমে রয়
দুরন্ত ফেরুর দল।
সিংহে মৃত ভাবি মিশিয়াছে সবি
করিতেছে কোলাহল” ।। (গুরু চাঁদ চরিত/ ১৩১)


(গুরু চাঁদের বাণী অবলম্বনে ছোট গল্প)


সে ছিল প্রসব যন্ত্রণা পীড়িত একটি সিংহী। পেটে দীর্ঘ দিন অভুক্ত থাকার মরণ খিদে। সন্তানের সুস্থ্যতার জন্য তার কিছু একটা খাওয়া ভীষণ জরুরী। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে সিংহীটি শিকারের জন্য উঠে দাঁড়ায়। কিছুটা তাড়া করে ঝাঁপিয়ে পড়ে একপাল ভেড়ার পালে।

Sunday, 22 March 2015

সনাতন বিচার ধারার দুই মহান যুগপুরুষ গোতমা বুদ্ধ এবং হরিচাঁদ (১) ঃ শরদিন্দু উদ্দীপন


  

ভূমিকাঃ 

গোতমা বুদ্ধ এবং হরিচাঁদ ভারতীয় সূক্ষ্ম সনাতন ধম্ম দেশনার দুই যুগ পুরুষ। একজনের জন্ম হয়েছিল আজ থেকে ২৫৫৯ বছর আগে। আর এক জন জন্মে ছিলেন ২০৩ বছর আগে ইংরেজী ১৮১২ সালের ১১ই মার্চ। দুজনের আবির্ভাবের মধ্যে পার্থক্য ২৩৫৬ বছর। মানব সভ্যতার বিবর্তনের নিরিখে কালচক্রের এত দূরত্ব থাকা সত্ত্বেও অদ্ভুত ভাবে দুজনের চরিত্রে রয়েছে একই দৃঢ়তা, একই বিভঙ্গ, একই দীপ্তি। ধম্ম দেশনার প্রতীক হিসেবে দুজনেই বেছে নিয়েছিলেন বোধি বৃক্ষ (Tree of wisdom) গোতমা উদ্ঘাটন করেছিলে দুঃখের কারণ, দেখিয়েছিলেন দুঃখকে জয় করার প্রকৃত পথ, পঞ্চ শীল এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গ। হরিচাঁদ এনেছিলেন মতুয়া ধর্ম। ব্রহ্মন্যবাদের প্রভাব খর্ব করার জন্য দিয়েছিলেন দ্বাদশ আজ্ঞা। অবজ্ঞার গ্লানি ব্যাথায় জর্জরিত বঞ্চিত,  মানুষদের স্বশক্তিকরণের মূল মন্ত্র শিখিয়েছিলেন হরিচাঁদ।  
এই দুই যুগ পুরুষের কর্মধারা ও দার্শনিক চিন্তা চেতনার সামঞ্জস্য খুঁজে বের করার একটা অনুভূতি বহুদিন ধরে তাড়া করছিল আমাকেএই অনুভূতি আরো প্রবল হয়েছিল মায়ের কাছ থেকে পাওয়া লাল কাপড়ে বাঁধা একটি হরিলীলামৃত পড়ার পর হরিচাঁদের জীবন, কর্মধারা ও দার্শনিক চিন্তার উপর রচিত এই লীলামৃত গ্রন্থ।  এই লীলামৃতের ১৫-১৬ পাতায়  বর্ণিত হয়েছে হরি ঠাকুরের জনম বিবরণ। এই জন্ম বিবরণীর ভাষ্যে হরিচাঁদের প্রবর্তিত ধর্মের স্বরূপ, কর্ম পদ্ধতি ও ব্যপ্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে   হরিলীলামৃতে বর্ণনা করা হয়েছে যে মহামতি বুদ্ধের কামনা পূর্ণ করার জন্যই হরিচাঁদ যশোমন্তের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছেন  
“নীচ হয়ে করিব যে নীচের উদ্ধার।
অতি নিম্নে না নামিলে কিসের অবতার।।
নীচ জন উচ্চ হবে বুদ্ধ তপস্যায়
বুদ্ধ দেব অবতার যে সময় হয়।।
বুদ্ধের কামনা তাহা পরিপূর্ণর জন্য।
যশোমন্তের গৃহে হরি হইলা অবতীর্ণ”।।  (হ।লী। ১৫/১৬)

হরিলীলামৃতে এমন সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও মতুয়াদের একটি বৃহত্তর অংশ মহামতি গোতমা বুদ্ধের প্রদর্শিত মার্গের সাথে হরিচাঁদের মতুয়া ধর্মের সামঞ্জস্য বিধান মেনে নিতে এখনো রাজি নয়। তারা বরং হরিচাঁদকে ব্রাহ্মন্যবাদী মাইথলজীর বিভিন্ন কাল্পনিক চরিত্র রাম, কৃষ্ণ, নারায়ন, বিষ্ণুর সাথে একাসনে বসানোর জন্য বেশি আগ্রহী। এটা নিশ্চিত ভাবেই মতুয়াদের একটি আত্মঘাতী প্রবণতাএই প্রবণতার একমাত্র পরিণতি মতুয়া ধর্ম এবং মতুয়া সমাজের সার্বিক অবলুপ্তি তার নমুনা বা চিহ্ন আমরা সর্বত্র লক্ষ করছি।  লক্ষ করছি মতুয়া সমাজের অন্দরে অন্দরে কাল সাপের মত ঢুকে পড়েছে এই বিষাক্ত ব্রাহ্মন্যবাদ। মতুয়া পরিবারের জন্ম  থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের প্রতিটা পর্যায়ের প্রতিটি আচার অনুষ্ঠানই এখন নিয়ন্ত্রণ করছে  ব্রাহ্মণ সমাজ। ঘটনাটি এমন নয় যে, দোর্দণ্ড প্রতাপ কোন রাজা বা জমিদার নিষ্ঠুর ভাবে ব্রাহ্মন্যবাদী   শাসন চাপিয়ে দিচ্ছে মতুয়া সমাজের উপরবরং এ কথাটি চরম সত্য যে, আজন্ম সেবাদাস  হয়ে বেঁচে থাকার জন্যই দশ গ্রামের মতুয়ারাই খুঁজে নিচ্ছে একজন অশিক্ষিত ব্রাহ্মণ প্রভুকে যে মতুয়াদের  গোলামীর মন্ত্রে বশীভূত করতে পারে। এমন স্বেচ্ছা মৃত্যুর প্রতিফলন মতুয়া সমাজের সর্বত্র লক্ষ করা যাচ্ছে। পরিতাপের বিষয় এই মারন  ব্যধির প্রকোপ উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। থামার কোন লক্ষণ নেই।
ঘরের নিভৃত কোনে যে আসনে হরিচাঁদকে বসানো হয়েছে, ঠিক তার পাশের জায়গা দখল করে নিয়েছে কাল্পনিক হিন্দু দেবদেবীগণ। যোগে জাগে শুরু হয়েছে নৈবেদ্যর ঘনঘটা। বারো মাসে তেরপার্বণের উচ্চকিত উল্লাস। আর এই গগনভেদী উল্লাসের জৌলুসে ফ্যাকাসে হতে বসেছে জয়ডঙ্কার ধ্বনি। ত্রিকোন লাল নিশানের মোচা দখল করে নিচ্ছে ত্রিশূল। এ যেন হাড়িকাঠের দিকে স্বেচ্ছায় গলা বাড়িয়ে দেবার জন্য ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে বলীর উৎসর্গকৃত পশু। 
অথচ এই আত্মঘাতী মোহমুদ্গরের থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্যই বজ্রনির্ঘোষে হরিচাঁদ উচ্চারণ করেছিলেন “হরিনাম”, এর গূঢ়ার্থ এবং নির্দিষ্ট করে দিয়েছিলেন মতুয়াদের আসল পথ।
হরি বোলা সাধুদের ভক্তি অকামনা।  
তন্ত্র মন্ত্র নাহি মানে ব্রজ উপাসনা।
 বিশুদ্ধ চরিত্র প্রেমে হরি হরি বলে।
অন্য তন্ত্র মন্ত্র এরা বাম পদে ঠেলে।। (হ লী)

কালের দাবীতে এই আলোচনা আমার কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যাদেশ। একে অস্বীকার করা সম্ভব হল না। পরিসরের অভাবে সমস্ত তথ্য এখানে তুলে ধরা সম্ভব হল না। কেননা এত স্বল্প পরিসরে বুদ্ধ এবং হরিচাঁদ এই দুই যুগপুরুষের অন্তহীন কর্মধারার পরিমাপ করা সম্ভব নয়। বিভিন্ন গ্রন্থ, প্রবন্ধ, ক্ষেত্রসমীক্ষা ও ভিক্ষুদের সন্নিধানে এসে এই দুই মহামানব সম্পর্কে মনের মধ্যে যে ভাবের সঞ্চারণ ঘটেছে এই প্রবন্ধটি তারই এক  বিনম্র নিবেদন    

গোড়ার কথাঃ সনাতন ধর্ম বা ধম্মসনাতন
আলোচনার গোড়াতেই বৈদিক সাহিত্য তথা ব্রাহ্মণ সাহিত্যে সনাতন ধর্ম সম্পর্কে কি বর্ণনা আছে তা দেখে নিতে চাই।  বারবার এমনই দাবী করা হয়ে থাকে যে, সনাতন এবং ধর্ম দুটি শব্দই প্রাচীন সংস্কৃত ভাষা থেকে নেওয়া হয়েছে এবং এই শব্দ দুটির মাধ্যমে এমন ভাব বিস্তার করা হয়েছে যে যার আদি নেই বা অনাদি এবং অন্ত নেই বা অনন্ত তাই সনাতন” এমনও বোঝান হয়েছে যে সনাতন হল অজর, অমর এবং  অক্ষয়। “ধৃ” ধাতু থেকে উৎপন্ন হয়েছে ধর্ম যার প্রকৃত অর্থ ধারণ করা। সুতরাং সনাতন ধর্মের প্রকৃত অর্থ করা হয়েছে “প্রকৃতির নিয়ম” বা “প্রাচীন প্রাকৃতিক শাশ্বত পথ” যা ধারণ করে নশ্বর এবং অবিনশ্বর জগৎ দাঁড়িয়ে আছে।      
এমন ও দাবী করা হয়েছে যে বৈদিক সাহিত্যেই নাকি কেবল এই সনাতন ধর্মের উল্লেখ আছে এবং শব্দ  দুটি অন্য কোন ভাষাতে এই শব্দ নেই।
এখন বৈদিক সাহিত্য বলতে আমারা বুঝি বেদ, ব্রাহ্মণ, আরন্যক ও উপনিষদকে, শ্রুতি ও পুরাণকে। এখানে বলতে দ্বিধা নেই যে ঋক, সাম, যজু, অথর্ব এই চারটি বেদ, ব্রাহ্মণ, আরন্যক বা উপনিষদে সনাতন শব্দের বা ধর্মের কোন উল্লেখ নেই। সনাতন ধর্মের উল্লেখ পাওয়া যায় মনুস্মৃতির চতুর্থ অধ্যায়ের ১৩৮ শ্লোকে           
·  Manusmriti (4-138), ... "Satyam bruyatpriyam bruyanna bruyatsatyamapriyam. Priyam cha nanrtam bruyadesa dharmah sanatanah."
(Translation: "Speak the truth, speak the truth that is pleasant. Do not speak the truth to manipulate. Do not speak falsely to please or flatter someone. This is the quality of the eternal dharma")
সত্য কথা বল, সত্য কথা বল যা মধুর। তেমন কথা বলনা যা বিকৃত। কাউকে সন্তুষ্ট করার জন্য মিথ্যে বল না। এটাই সনাতন ধর্মের শ্রেষ্ঠ গুন   

ভগবত পুরানে লেখা হল যে, চার যুগের প্রত্যেক বিবর্তনের শেষে ঋষিগণ ধ্যান যোগে সংগৃহীত শ্রুতি সকল অবলোকন করলেন, কণ্ঠে ধারণ করলেন এবং তার পরেই সনাতন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করলেন।    
Bhagvata Purana,(12) ... "At the end of each cycle of four yugas, the rishis, through their asceticism, saw the collections of srutis swallowed up by time, after which the eternal dharma (was re-established)  

ব্রাহ্মন্য সাহিত্যের অন্যতম মূল গ্রন্থ হল গীতাগীতার কয়েকটি অধ্যায়ে সনাতন শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু অধিকাংশ বর্ণনাই আত্মার অবিনশ্বরতা এবং সৃষ্টিকর্তার সর্বময় ক্ষমতা সম্পর্কিত। গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের ২৪ শ্লোকে বলা হয়েছেঃ
Acchedyo 'yam adahyo 'yam
akledyo 'sosya eva ca
nityah sarva-gatah sthanur
acalo 'yam sanatanah”.
The soul cannot be cleft, he cannot be burnt, he cannot be wetted, and
he cannot be dried. He is eternal, all pervading, unchangeable, immovable and
ever lasting.
আত্মা কখন খণ্ডিত করা যায়না। তাকে পোড়ানো যায়না, তাকে সিক্ত করা যায়না, তাকে শুকনো করা যায়না, সে অনড় এবং অব্যয়, সর্বত্র পরিব্যাপ্ত।
গীতার একাদশ অধ্যায়ের ১৮ শ্লোকে বর্ণনা করা হয়েছেঃ    
“Tvam aksaram paramam veditavyam
tvam asya visvasya param nidhanam
tvam avyayah sasvata-dharma-gopta
sanatanas tvam puruso mato me"
You are inexhaustible, the Supreme Being, worthy to be known, the best
in all the universes; You are unchangeable, the maintainer of religion and the
eternal personality of Godhead.

তুমি অক্ষয়,  মহাবিশ্বের সর্বময় ক্ষমতার মধ্যে তুমিই মহত্তর, তুমি অপরিবর্তনীয় সনাতন ধর্মের নিয়ন্ত্রক ও রক্ষক। 
 
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল, যে সনাতন ধর্ম নিয়ে এত কথা, এত গরিমা প্রকাশ করা হল তার স্বরূপ এবং সংজ্ঞা নির্ধারণে জন্য কোথাও কোন  ব্যাখ্যা করা হল না? আবার অদ্ভুত ভাবে এটাও দেখা গেল যে, গীতায় যেখানে ধর্মের স্বরূপ ও তার সংস্থাপনের অব্যর্থ কারণ দর্শানো হল সেখানে সনাতন কথাটিই উচ্চারণ করা হলনা! গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের ৭ এবং ৮ শ্লোকে কৃষ্ণের মুখে উচ্চারিত হল ধর্ম সংস্থাপনার মূল কারণ।   
yada yada hi dharmasya
glanir bhavati bharata
abhyutthanam adharmasya
tadatmanam srjamy aham
TEXT 8
paritranaya sadhunam
vinasaya ca duskrtam
dharma-samsthapanarthaya
sambhavami yuge yuge
এখানে সনাতন ধর্মের মূখ্য বার্তাকার সদম্ভে ঘোষণা করলেন যে, “O descendant of Bharata, whenever there is decline of religion and rise of irreligion, I manifest Myself. I descend Myself in all ages to deliver the devotees, to annihilate the miscreants and to re-establish the principles of religion.
অর্থাৎ ধর্ম সংস্থাপনের জন্য দরকার হয় অভ্যুত্থানের। সাধুদের পরিত্রাণের জন্য দরকার হয় দুষ্কৃতের বিনাশ। ধর্ম সম্পর্কে এটাই বৈদিক সাহিত্যের বা ব্রাহ্মণ সাহিত্যের মূল ভাষ্য।

প্রশ্ন উঠতেই পারে এটাই কি সনাতনের মূল বাণী !? এটাই কী সেই চিরন্তন প্রাকৃতিক বার্তা। এই গভীর  বার্তার মধ্যে দিয়ে কি সকল সত্ত্বার মঙ্গল সাধিত হয়? এই ধর্ম ধারণ করে কি প্রত্যেক জীবকে নিজের সত্ত্বা, নিজের আপনজন, নিজের আত্মীয়, পরমাত্মীয়, হিসেবে আলিঙ্গন করা যায়? অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কি ন্যায়, সাম্য, স্বাধীনতা ও শান্তির বাণী প্রতিষ্ঠা সম্ভব ? একজনকে হত্যা  করে অপরজনকে পালন করার মধ্য দিয়ে কি বিশ্বমানবতা রক্ষিত হয়?

এই সমস্ত প্রশ্নের যথার্থ উত্তর পেতে হলে পাহাড় প্রমান সংস্কৃত সাহিত্যের মধ্যে কী প্রহেলিকা লুকিয়ে আছে তা আমাদের বুঝে নিতে হবেখুঁজে দেখতে হবে সংস্কৃত সাহিত্যের প্রদর্শিত এই ভাষ্য প্রকৃত  সনাতনের পথ কিনা। যুক্তি, বুদ্ধি ও জ্ঞানের আলোকে জহুরীর মত যাচাই করে  নিতে হবে আসল ও নকল। বিজ্ঞান, দর্শন, ভাষাতত্ত্ব ও ঐতিহাসিক উপকরণগুলির সাহায্যে নিয়ে একটি নিশ্চিত গন্তব্যে পৌঁছাতে হবে এবং এই নিরন্তর ক্রিয়া প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে মিথ্যাকে বিসর্জন দিয়ে সত্য প্রতিষ্ঠার কাজে ব্রতী হতে হবে।     

সনাতন ধর্ম সম্পর্কে সংস্কৃত ভাষ্যের ঐতিহাসিক সত্যতাঃ     
সমস্ত ব্রাহ্মন্য সাহিত্য বেদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। চারটি বেদকে তাই সংস্কৃত সাহিত্যের মূলাধার বলা  যেতে পারে। বেদের স্বীকৃতি না থাকলে কোন ধারনা, মত, ধ্বনি বা শব্দ কৌলীন্য লাভ করতে পারেনা। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, বেদ, ব্রাহ্মণ, আরন্যক বা উপনিষদে সনাতন ধর্মের কোন ব্যাখ্যা নেই। সনাতন ধর্মের উল্লেখ  পাই মনুস্মৃতিতে, ভগবত পুরাণে এবং গীতায়। তাই একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে এই শাস্ত্রগুলি রচনার  কাল পর্যন্ত “সনাতন” শব্দ বা তার মূল অর্থের সাথে ব্রাহ্মন্য শাস্ত্রের কোন পরিচয় গড়ে ওঠেনি। কেননা খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০০ সাল থেকে সম্রাট অশোকের প্রোপৌত্র বৃহৎদ্রোথের শাসন কা খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৫ সাল পর্যন্ত আর্যরা কোল, চন্ডাল, অসুর, নাগ প্রভৃতি মূলনিবাসী ভারতীয় রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধ বিগ্রহে ব্যস্ত ছিল। ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীর ধ্বংস, নারী ও সম্পদ লুন্ঠন এবং ভারতীয় সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে তার উপরে আর্য ধর্মের বিজয় কেতন উড়াতে ব্যস্ত ছিল ব্রাহ্মণ সমাজ। যুদ্ধের এই ক্রান্তিকালেই আর্যদের সাথে ভারতীয় ভাষা, লিপি ও সংস্কৃতির সাথে পরিচয় ঘটে। পরবর্তীকালে আর্যরা এই ভাষা, লিপি ও সাহিত্যের উপর তাদের আধিপত্য বিস্তার করে এগুলিকে তাদের সংস্কৃতির সাথে সংযুক্ত করে নেয় এবং নিজেদের সুবিধার্থে এগুলিকে আর্যধর্ম প্রচারের মাধ্যম করে নেয়। এই প্রসঙ্গে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা সাহিত্যের প্রসঙ্গে আলোচনাটি প্রনিধান যোগ্য।  
"...বৈদিক কাল ও বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কেও আমরা সেই কাথা বলতে পারি। এই সুদীর্ঘ সময় ছিল  ধ্বংসের যুগ, অনুকরণের কাল। প্রাচীন দেশীয় শব্দ, লিপি, ভাষা আত্মসাৎ করার অন্ধকার যুগ। অর্থাৎ মূলত এদেশের ভাষা ও শব্দ সম্ভার, সাহিত্যরচনার রীতি এবং লেখকদের আশ্রয় করেই বিজয়ী আর্যরা নিজেদের প্রয়োজন সিদ্ধিমূলক বৈদিক রচনা করে নিয়েছিল। বেদ বা বৈদিক সাহিত্য তাই মূলতঃ ঔপনিবেশিক সংবিধান। ............... এ সাহিত্য তাই উপনিবেশবাদের মূল সুর, ঘৃণা এবং জাত বিদ্বেষ, শোষণ ও পীড়নের কাহিনী কথায় ভরা। ........চূড়ান্ত বর্ণ -বিদ্বেষ চলেছে, ঈশ্বরের নামে ও ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে"।

প্রাচীন দেশীয় লিপি, ভাষা, শব্দগুলিকে আত্মসাৎ করে পরিবর্তন করেই যে ব্রাহ্মণ সাহিত্য গড়ে উঠেছিল তা বলার অপেক্ষা রাখেন। এই প্রক্রিয়ার গোড়ার দিকে বিজয়ী আর্যরা ভারতীয় জনপুঞ্জের ভাষার শব্দ ভান্ডার থেকে নিজেদের প্রয়োজন মত শব্দ সংগ্রহ করে সুবিধা মত পরিবর্তন করে আর্যিকরণ বা সংস্কৃতায়ণ করে নেয়। একটু এদিক ওদিক করে দেশি শব্দগুলিকেই ঢুকিয়ে নেওয়া হয় সংস্কৃত শব্দকোষে এবং পরবর্তী কালে শব্দগুলিকে সংস্কৃত শব্দ হিসেবে দাবী করা হয়।
একটি মিথ্যা তথ্যকে হাজার বার বলতে বলতে সত্য বলে প্রতিয়মান হয়এরকমই হেঁয়ালির উপরই দাঁড়িয়ে আছে সমগ্র ব্রাহ্মণ সাহিত্য। এর প্রতিটি পরতে পরতে সংশয় ছিল বলেই এই মিথ্যার মিথোলজিকে ধর্মের রসায়নে জারিত করে  সচতুর ভাবে পরিবেশন করা হয়েছে। যাতে প্রশ্ন উঠেলে বা ঐতিহাসিক তথ্য যাচাইয়ের প্রয়োজন পড়লে ধর্মে আঘাতের অজুহাত তোলা যায় এবং মিথ্যা ধারনাকেই লালিত পালিত করে অচলাবস্থা সৃষ্টি করা যায়। বর্তমানের বাবরি মসজিদ রাম জন্মভূমি বিতর্ক এই সুচতুর পরিকল্পনার জ্বলন্ত উদাহরণ।
এই সমস্ত ব্রাহ্মণ সাহিত্যের ক্ষেত্রেও একই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে বিভিন্ন লেখক চিন্তাবিদদের রচনায় এইসব সাহিত্য রচনার সময়কাল নির্ধারিত হলেও শুধু মাত্র প্রচারের জোরে এগুলিকে কালজয়ী করে তোলা হয়েছে এবং এই সাহিত্যগুলি যে মানুষের জন্মের আগে কোন স্বর্গীয় ছাপাখানায় মূদ্রিত হয়ে পারিজাত বাগানের কোন গ্রন্থাগারে গচ্ছিত ছিল এমন বদ্ধমূল ধারনা চালান করে দেওয়া হয়েছে। এখনো এই প্রচারের ক্ষামতি নেই। অধিকাংশ ব্রাহ্মন্যবাদী সংঘ এবং সংগঠন একযোগে এই মিথ্যা প্রচারকেই হাতিয়ার করে ব্রাহ্মণ সাহিত্যকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করছে।         
অধিকাংশ গবেষণা থেকেই প্রতিপাদিত হচ্ছে যে, মনুস্মৃতি, রামায়ন, মহাভারত, ভগবৎ পুরাণ গীতার রচনাকাল মহামতি গোতমা বুদ্ধের অনেক পরে। গত ২০১৩ সালে ভারত বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান রামকৃষ্ণ মিশন আলোচনা সহশ্রীমদ্ভাগবত গীতা একটি সংস্করণ পুনঃ  প্রকাশ করেছে। তার মুখবন্ধে দাবী করা হয়েছে  যে, “গীতার রচনা কাল গৌতম বুদ্ধের আগে এই প্রসঙ্গে বন্ধুপ্রতিম চন্দন বড়ুয়ার একটি খোলা চিঠি আত্মনিরীক্ষণ পত্রিকার ২১শে ডিসেম্বর, ২০১৩ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাধর্মী চিঠি। তাতে চন্দন বড়ুয়া বিভিন্ন লেখক, গবেষক, স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব ঐতিহাসিকদের লেখাগুলিকে পরপর সাজিয়ে প্রমান করেছেন যে গীতা তথা অধিকাংশ ব্রাহ্মনবাদী সাহিত্যগুলিই মহামতি গোতমা বুদ্ধের অনেক পরে লেখা হয়েছে। এই লেখায় সেই ধরণের কিছু তথ্য সংযোজিত হল। এতে ব্রাহ্মন্যবাদী সাহিত্যকে কেন্দ্র করে যে কুহেলিকার বাতাবরণ সৃষ্টি করা হয়েছে তা কেটে গিয়ে সত্য প্রকাশিত হবে বলে মনে করি।
প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে, দীর্ঘকাল ধরে গীতাকে মহাভারতের সারাংশ বলে প্রচার করা হয়েছে। এই  “গীতাসার” মহাভারত কাব্যের অন্তর্গত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের (যদিও এই যুদ্ধের কোন ঐতিহাসিক সমর্থন পাওয়া যায় না) প্রাগকালীন বর্ণনা। অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়ের মুখ থেকে এই যুদ্ধকালীন বর্ণনার সাথে সাথে কৃষ্ণ ও অর্জুনের মধ্যে যে কথোপকথন হয় তা শ্রবণ করেন। ভ্রাতৃঘাতি এই যুদ্ধে অনিচ্ছুক অর্জুনকে কৃষ্ণ যে ভাবে ইতিহাস, দর্শন, নীতিকথা ও নির্দেশের মাধ্যমে যুদ্ধে অনুপ্রাণিত করেছিলেন তারই সংক্ষিপ্তসার এই গীতা।
নিশ্চিত ভাবে গীতার এই সংক্ষিপ্তসার মহাভারতের যুদ্ধের পরবর্তী সংকলনকেননা যুদ্ধের অভিজ্ঞতার বর্ণনা যুদ্ধের পরবর্তীকালেই সংকলিত হবে এটাই স্বাভাবিক ঘটনা।   

এ বিষয়ে আমরা সর্বপ্রথম ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান, ভারতীয় সংবিধানের মূল কারিগর বাবা সাহেব ডঃ বি আর আম্বেদকরের উদ্ধৃতি থেকে শুরু করতে পারি। “The writings of Mahabharata was not completed till 1200 A.D. ( W&SVol.3)
ভগিনী নিবেদিতা তার “Foot Falls of the Indian History” গ্রন্থে লিখেছেন যে, মহাভারত সংকলিত হয়েছিল খ্রিস্টীয় ৪০০ সালে।           
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর “ভগবান বুদ্ধ ও তাঁর বাণী” গ্রন্থে লিখেছিলেন, “কতশত ব্রহ্মা আদি এই মানব দেবতার চরণে প্রণত। ভারতবর্ষের এই যে সব সন্ন্যাসীর মঠ-ফট দেখতে পাচ্ছিস-এ সব বৌদ্ধদের অধিকারে ছিল, হিন্দুরা সেই সকলকে এখন তাদের রঙে রাঙিয়ে নিজস্ব করে বসেছে। ভগবান বুদ্ধদেব হতেই যথার্থ সন্ন্যাসাশ্রমের সূত্রপাত হয়েছিল।
মহামান্য তিলক ভগবৎ গীতা সম্পর্কে একেবারে খোলাখুলি স্বীকার করেছিলেন যে, বুদ্ধের বাণীকে আত্মস্থ করেই গীতার কলেবর বাড়ানো হয়েছিল। “Geeta barrowed ideology from Buddhism. The illustration I have given will be enough to show how greatly the Bhagvat Geeta is permeated by Buddhistic ideology and how much the Geeta has has borrowed form Buddhism”. (WUS-vol-3-P-371)
পণ্ডিত অঘোরনাথ গুপ্ত তাঁর “শাক্যমুনিচরিত নির্বাণতত্ত্ব” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, বাল্মিকী রামায়নের অযোধ্যা কান্ডে লিখিত হয়েছেঃ
“যথা হি চোরঃ স’তথা হি বুদ্ধ
স্তথাগতং নাস্তিকসত্র বিদ্ধি।
ন নাস্তিকে নাভি মুখো বুধঃ স্যাত”।
প্রখ্যাত অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য তাঁর “প্রাচীন ভারত- সমাজ ও সাহিত্য” গ্রন্থে আলোচনা করেছেন যে, “ পণ্ডিতেরা বলেন মহাভারত রচনার কাল খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতক থেকে খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতকের মধ্যে.....আমার মনে হয় বেদ রচনার কাল ছিল সেই সময়টা’।  
বেদ রচনার কালেও আর্যরা ভারতীয় মূলনিবাসীদের যজ্ঞহীন, যজ্ঞবিরোধী, যজ্ঞরোহিত, অন্যব্রত হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন। “ইন্দ্র যেন চোরের মত এই সব যজ্ঞ বিরোধীদের সব সম্পদ লুন্ঠন করে যারা যজ্ঞ করে তাদের মধ্যে বন্টন করে এমন প্রার্থনা ঋকবেদের প্রায় সর্বত্রই দেখা যায়”    

গীতার তৃতীয় অধ্যায়ের ৪০, ৪২ এবং ৪৩ শ্লোকে বুদ্ধকে ইন্দ্রিয়, বস্তু, মন ও বুদ্ধির সর্বোচ্চজ্ঞান হিসেবে মেন নেওয়া হয়েছে। এই জ্ঞানকে আত্মা এবং পরমাত্মার সাথে তুলনা করলেও বুদ্ধের নাম প্রকট ভাবে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠেছে গীতায়                    
Indriyani parany ahur
indriyebhyah param manah
manasas tu para buddhir
yo buddheh paratas tu sah Geeta text 42, Chapter -3

evam buddheh param buddhva
samstabhyatmanam atmana
jahi satrum maha-baho
kama-rupam durasadam (Geeta text 43, Chapter -3)    (চলবে...)




জীবে দয়া, নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠাঃ 
হরি লীলামৃতে যে কারনে তাঁকে অবতার বলা হয়েছে তার প্রকৃত অর্থ হল সমাজ সংস্কারক। এই সংস্কার কাজে তিনি তৎকালীন বাংলার সমস্ত বঞ্চিত মানুষকে মানবতা বন্ধনে আবদ্ধ করতে পেরেছিলেন সকলের মঙ্গল চেয়েছিলেন হরিচাঁদ।

হরিচাঁদ যে চণ্ডাল সমাজে জন্মে ছিলেন সেই চণ্ডাল সমাজ ছিল স্বাধীন বোধিচিত্ত সম্পন্ন জাতি। প্রাগার্যকাল থেকেই এঁরা ছিলেন বুদ্ধ। এদের পূর্বপুরুষ কাশ্যপ ছিলেন ২৭তম বুদ্ধ। স্বাভাবিক কারণেই চণ্ডাল সমাজের সংস্কৃতি এবং পারম্পরিক জ্ঞানের মধ্যেই ছিল বুদ্ধ ধম্মের প্রভাব। হরিচাঁদ এই প্রজ্ঞাবান সমাজ থেকেই স্বশিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন।

গোতমা বুদ্ধ বলেছিলেন যে মানুষের “কামনা”   (desire is the soal cause of suffering )” হল মানুষের সব দুঃখের কারণ। ঠিক একই ভাবে হরিচাঁদের দেশনায় ছিল “অকামনা”। তাইত হরিলীলামৃতের একেবারে প্রারম্ভেই প্রকাশিত হয় যে “অকামনা প্রেম ভক্তির” মাধুর্য বিতরণ করার জন্যই অবতারের প্রয়োজন হয়ে পড়ে।
তবেতো প্রভুর মনে কামনা রহিল।  
......অকামনা প্রেমভক্তি কই পাওয়া গেল।।
...তাদের ভজনগ্রন্থ পড়ে দেখ ভাই।
অকামনা প্রেমভক্তি তাতে বর্ত্তে নাই।।
......সে কারণে অবতার হৈল প্রয়োজন।
সফলা নগরী যশোমন্তের নন্দন।। (ওড়াকান্দি থেকে প্রকাশিত, হরিলীলামৃত, আদি খন্ড, ০৩পৃষ্ঠা)                
                
শুধু নিম্নবর্গের মানুষ নয় কাতারে কাতারে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা মতুয়া নিশানের তলায় হাজির হয়েছিল। তিনকড়ি মিঞার দল আগে গিয়ে মতুয়া নিশান তুলত ওড়াকান্দিতে। মঠবাড়ি শুকতৈলের ইয়ার আলি ফকির পাগোল উপাধি পেয়েছিলেন। বল্লাবাড়ির পাচুশাঁ ছিলেন ইয়ার আলির গুরু। তিনিও মতুয়া ছিলেন। ফাদার সিএস মীডের ব্যাপটিস্ট মিশন থেকেসাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল মতুয়াদর্শ বিকাশের জন্য। অর্থাৎ মতুয়া দর্শনের চুম্বক শক্তিতে কেন্দ্রীভূত হতে শুরু করেছিল মানব কল্যাণের ধারা। সমতা, স্বতন্ত্রতা ও বন্ধুত্ব ছিল এর মূল মন্ত্র।
খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৩ সালে মহামতি গোতমা বুদ্ধের মহাপরি নিব্বানের পর রাজা অজাতশত্রুর পৃষ্ঠপোষকতায় রাজগৃহে আয়োজিত হয় প্রথম বুদ্ধ মহাসঙ্গীতি এই প্রথম বুদ্ধ মহাসঙ্গীতিতে সভাপতিত্ব করেন ভিক্ষু মহা কাশ্যপ। কয়েক সহস্র অরহত প্রাপ্ত ভিক্ষুদেরা আসেন নানা দেশ থেকে। মহামতি গোতমা বুদ্ধের অত্যন্ত কাছের সেবক আনন্দ এই সভায় উপস্থিত করেন কয়েকটি মহামঙ্গলম সুত্ত যা গোতমা বুদ্ধ অনাথ পিন্ডিক নির্মিত জেতোবন বিহারে অবস্থান কালে একজন প্রভাবশালী আর্য পুরুষের কাছে ব্যক্ত করেছিলেনএই দিব্যকান্তি পুরুষ গোতমা কে অভিবাদন করে বলেছিলেন ঃ  
বহু দেবা মনুসসা চ মঙ্গলানি অচিন্তয়ুং 
আকঙ্ক্ষামানা  সোত্থানং ব্রুহি মঙ্গলমুত্তমং ।     
বহু দেব এবং মনুষ্য মঙ্গল বিষয়ক চিন্তা ব্যক্ত করেছেন, কিন্তু কেহ  সম্যক অবগত হয়ে ব্যক্ত করতে পারেন নি। আপনি ওনুগ্রহ করে দেব ও মানবের হিত-সুখদায়ক মঙ্গল সমূহ ব্যক্ত করুণ। এরপর ভগবান বুদ্ধ ঐ প্রভাবশালী আর্য পুরুষের জ্ঞানাগ্রহ মেটানোর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ মঙ্গল সুত্রগুলি ব্যক্ত করতে থাকেন। এগুলি ত্রিপিটকের মহামঙ্গল সুত্তং হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়। এই মহামঙ্গল সুত্তমএর নানা সুত্তের সাথে হরিচাঁদের বহু বানীর চমৎকার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। হরিচাঁদের এই বানীগুলি হরিলীলামৃত গ্রন্থের নানা অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এই পরিসরে কিছু বানীকে পাশাপাশি রেখে আলোচনা করা যেতে পারে।                  
মানবের হিত-সুখদায়ক মঙ্গলের জন্য বুদ্ধ ব্যক্ত করেছিলেন ঃ
“Non-association with fools,
And association with wise men,
Worship of respect worthy persons,
This is the highest blessing”


হরিচাঁদ বললেনঃ
শুনেছি সাধুর মুখে কহে পরস্পর
অধর ধরিবি যে ধরেছে তারে ধর।। অথবা
অসতের সঙ্গ ছাড়ি হরি হরি বল।
কুফল বিফল হবে পাবে প্রেম ফল।।
গোতমা বললেন ঃ
 “Great learning and skill at work,
And well-practiced moral observances,
Words which are well spoken,
This is the highest blessing.

হরি চাঁদ বললেন ঃ
সংসারে সংসারী থাক তাতে ক্ষতি নাই।
চরিত্র পবিত্র রাখি সত্য বলা চাই।।
গৃহ ধর্ম রক্ষা কর বাক্য সত্য কও।
হাতে কাম মুখে নাম দেল- খোলা হও।।
গোতমা বললেন ঃ
 “Taking care of father and mother,
Caring for wife and children,
And acting without confusion,
This is the highest blessing


Those who act in this way
Are undefeated in all circumstance
And attain happiness everywhere,
These are the highest blessings.

হরিচাঁদ বললেনঃ
পুরুষে করিবে ভক্তি পিতা মাতা ভাই।
নারী পক্ষে পতি ভিন্ন অন্য গতি নাই।
পরপতি পর সতী স্পর্শ না করিবে।
না ডাক হরিকে হরি তোমাকে ডাকিবে।।
গৃহ ধর্ম রক্ষা কর বাক্য সত্য কয়।
যোগী, ন্যাসী কি সন্ন্যাসী কেহ তুল্য নয়।।
গৃহেতে থাকিয়া যার হয় ভাবোদয়।
সেই যে পরম সাধু জানিও নিশ্চয়।।

মহামতি গোতমা বুদ্ধ  বলেছিলেন "Desire is the soal cause of sufferings" কামনা হল দুঃখের মূল কারণ। আর এই দুঃখের কারণ খুঁজতে গিয়ে গোতমা বুদ্ধ আবিস্কার করেছিলেন চারটি মূল সত্যঃ
ক) জীবনে দুঃখ আছে
খ) এই দুঃখের একটি নির্দিষ্ট কারণ আছে
গ) দুঃখ থেকে নিস্তার পাওয়া যায়
ঘ) দুঃখ থেকে পরিত্রাণ পেতে গেলে মানুষকে অবশ্যই অষ্টাঙ্গিক মার্গ অনুসরণ করতে হবে। এই অষ্টাঙ্গিক মার্গ এবং পঞ্চশীল হল অকামনা, প্রেম ভক্তির মার্গ।  

আর হরি চাঁদ বললেন ঃ
হরি বোলা সাধুদের ভক্তি অকামনা।
তন্ত্র মন্ত্র নাহি মানে ব্রজ উপাসনা ।।
বিশুদ্ধ চরিত্র প্রেমে হরি হরি বলে।
অন্য তন্ত্র মন্ত্র এরা বাম পদে ঠেলে।।

একই ভাবে হরি চাঁদের জন্মের ২৩৫৬ বছর আগে বুদ্ধ এনেছিলেন এই মঙ্গলবার্তা।  বুদ্ধের কামনা ছিলঃ   (METTĀ — GOOD WILL)

Sabbe sattā sukhitā hontu.
May all living beings be happy.

Sabbe sattā averā hontu.
May all living beings be free from animosity.

Sabbe sattā abyāpajjhā hontu.
May all living beings be free from oppression.

Sabbe sattā anīghā hontu.
May all living beings be free from trouble.

Sabbe sattā sukhī attānaṃ pariharantu.
May all living beings look after themselves with ease.

দুই যুগপুরুষের বানীর মধ্যে এত নিগুঢ় প্রমান থাকা সত্ত্বেও আমরা হরিচাঁদের ধারাকে ধর্ষক বিষ্ণু ও তার  হত্যাকারী অবতারগুলির সঙ্গে এক আসনে বসাচ্ছি ! এটা আমাদের মস্তিষ্কের জড়ত্ব, অজ্ঞতা এবং অজ্ঞানতার নিন্দনীয় দিক! আশার কথা যে, গবেষণা যত এগোচ্ছে, আলোচনা যত বাড়ছে ততই বুদ্ধ এবং হরিচাঁদের বিচার ধারা প্রবাহমান ভারতীয় মূলধারার সাথে মিলিত হয়ে আরো বেগবান হয়ে উঠছে তাই আমরা অধীর আগ্রহে বিভোর হয়ে আছি সেই মহাসঙ্গীতের সুরঝঙ্কারের অপেক্ষায় যখন সমগ্র বিশ্বের মানুষ ভ্রাতৃত্ব প্রেমে আবদ্ধ হয়ে  বন্দনাগীতে সামিল হবে ঃ 
হোতু সব্বম সুমঙ্গলম
সত্যি হোন্তু নিরন্তরম।
সব্ব বুদ্ধানু ভবেন
সত্যি হোন্তু নিরন্তরম।
সব্ব ধম্মানু ভবেন
সত্যি হোন্তু নিরন্তরম।
সব্ব সঙ্গানু ভবেন
সত্যি হোন্তু নিরন্তরম।
জয় ডঙ্কা বেজে উঠবে। শিঙ্গার ধবনিতে মুখরিত হবে চৌদিশ। সিংহনাদে উচ্চারিত হবে মানবতাবাদের বিজয়জয়ধ্বনি “হরিবোল, হরি বোল”। জগজন শ্রদ্ধাবনত হয়ে উচ্চারণ করবেন সাধু সাধু সাধু। (সনাতন বিচার ধারার অংশ বিশেষ)