Pages

Thursday 1 October 2015

অসুর ধম্ম ও দর্শনঃ




সুরাসুর ধারণা এবং দ্বন্দ্বটি ব্রাহ্মন্যবাদী সাহিত্যেরই উৎপাদিত ফসল। মূল ভারতীয় অসুর সাহিত্যে বিশেষ করে আজীবিকা, চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ বা মতুয়া সাহিত্যে এই দ্বন্দ্বকে একেবারে ধর্তব্য বিষয় হিসেবে দেখা হয়নি। মূল ভারতীয় দর্শনেরর ধারা বরং সমগ্র জগতের মূর্ত-বিমূর্ত, জীব-জড়, অক্ষয়-ক্ষয়িষ্ণু, অচল-চলমান বস্তু জগতের মধ্যে প্রেম, প্রীতি, দয়া, মায়া, করুনা ও ক্ষমার মধ্য দিয়ে বসুধৈবকুটুম্ব নীতিকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বুকের মাঝে বিশ্বলোকের সাড়া পাবার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে
শৈশব থেকেই উপলব্ধি করছি যে, সুর এবং অসুর দ্বন্দ্বটি বাংলা তথা ভারতবর্ষে একটি প্রবাহমান বিবাদের প্রকট অংশ। এটিও উপলব্ধি করতে পারছি যে এই দ্বন্দ্বদের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলেই মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ সুরালোকে উন্নিত হয়ে সমস্ত মধুভান্ডকে চেটাপুটে খেয়ে সাবাড় করছে আর একদল সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে অসুর বা অশুভ শক্তির প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারার চেষ্টা হচ্ছে। জীব সত্তার সার্বিক বিকাশের কারণেই এই সুর এবং অসুর দ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।

সুর, সুরা ও সুরালোকঃ   
১।‘হে ইন্দ্র এবং অগ্নি ...হে সর্ব ক্ষেত্রের বীরগণ, এখানে আস এবং যে সুরা (সোমরস) ঢালা হয়েছে তা পান করো’।। ঋগ্বেদ ১।১০৮।৮
২। “হে ইন্দ্র! তুমি সুরাপানে মত্ত হয়ে যজ্ঞবিহীন জনসংঘদের পরস্পর বিরোধী করে উভয়কেই বিনাশ করো”। ঋগ্বেদ ৮।১৪।১৫
৩। “হে ইন্দ্র, যারা যজ্ঞাদি অনুষ্ঠান করে না, যারা ব্রাহ্মণ ও মন্ত্রাদির প্রতি বিদ্বেষ করে তারা সঙ্গতি সম্পন্ন হলেও তাদের অন্ধ করে বিনাশ কর”।
ঋগ্বেদ ৫।৪২।৯
৪। “হে ইন্দ্র, তোমার ঘূর্ণায়মান অস্ত্রের আঘাতে ঐ সব অস্ত্ররহিত অসুর যারা দেবতা ও ব্রাহ্মণ বিরোধী তাদের তাড়িয়ে দাও”।  ঋগ্বেদ ৮।৯৬।৯
৫। “হে ইন্দ্র, তুমি মহান। তুমি অসুরদের কাছ থেকে লুন্ঠন করা ভোগ্যবস্তু ও ধন সকল দান করে পুরোহিতদের ধনবান করো”। ঋগ্বেদ ৮।৯৭।১
সুরসমাজ বা দেবসমাজের চরিত্র এবং দর্শন বোঝাতে  ঋগ্বেদ থেকে  কয়েকটি শ্লোক এখানে দেওয়া হল। প্রিয় পাঠকদের এগুলিকে যাচাই করে নেবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। এগুলি থেকেই অনুমান করতে পারবেন যে সুরসমাজ ছিল লোভী, লুণ্ঠনকারী, ভোগী, বর্বর, যজ্ঞব্রতী, ব্রাহ্মন্যবাদী, অসহিষ্ণু এবং হত্যাকারী।

অসুর, অসুরা ও অসুরলোকঃ
বেদের বর্ণনা থেকেই পরিষ্কার যে অসুর সমাজ ছিল প্রজ্ঞাবান ও যুক্তিবাদী। অসুরেরা ছিলেন যজ্ঞরহিত, অস্ত্ররহিত বা নিরস্ত্র। এদের ধম্ম ছিল আলাদা। দেবসমাজ (এক জাতীয় বর্বর যাযাবর মানুষ। আবেস্তাতে দেবতাদের দুশ্চরিত্র বলে বর্ণনা করা হয়েছে) তাই এদের অন্য ব্রত বলে অভিহিত করেছে।

সব থেকে মজার ব্যাপার হল যে, সুরাপানের মধ্য দিয়ে দেবতারা যে শক্তি সঞ্চয় করত তা যাতে কিছুতেই অসুরদের হস্তগত না হয় তার জন্য দেবতারা সদা সতর্ক ছিল।
অর্থাৎ অসুর সমাজের মধ্যে যে সুরাপানের প্রচলন ছিলনা তা সহজেই বোঝা যায়। অথবা সমাজ বিবর্তনের কোন এক বাকে এসে অসুর সমাজের মধ্যে যে সুরাপানের অভ্যাস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তা অনুমান করা যায়।   
অসুর রাজা ত্বস্টা আবার এই সুরা উৎপাদন করার চেষ্টা করলে ইন্দ্র ত্বষ্টার সব সুরা পাত্র ভেঙ্গে ফেলেছিল। (ঋগ্বেদ ১০।৮।৯) সমুদ্র মন্থন থেকে জানা যায় কি ভাবে সুধা বা মদ উৎপন্ন করার পরেও অসুরদের  বঞ্চিত করা হয়েছিল।
 
সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল আসুরেরা ছিলেন অস্ত্ররহিত। পরিষ্কার ভাবে বোঝা যায় যে অসুর দর্শন এমন উচ্চমার্গে উন্নিত হয়েছিল যে ন্যায়ের শাসন বলবত করতে কোন অস্ত্রের প্রয়োজন হত না। প্রজ্ঞা এবং ন্যায় দণ্ডই ছিল অসুর শাসনব্যবস্থার মূল স্তম্ভ।

মানুষে মানুষে বিভেদের বেড়া ভেঙ্গেছিল অসুর সমাজ। সাম–দাম-দন্ড-ভেদ নয়, বৈরি দিয়ে বৈরিতাকে ধ্বংস নয়, বরং ভালবাসার মধ্য দিয়ে হৃদয় জয় করে শত্রুতার অবসান ঘটানোই ছিল অসুর সমাজের সনাতন বিশ্বাস। এই সনাতন বিশ্বাস বা ধম্মের বানীই আমরা শুনতে পেয়েছিলাম মহামতি গোতমা বুদ্ধের কাছে। রোহিনী জল বিবাদ নিয়ে শাক্য ও কৌল্য সংঘের মধ্যে ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ আসন্ন হলে তিনি শুনিয়েছিলেন অমর ভালবাসার সেই চিরন্তন বাণী।           
নাহি বেরানা বেরানি সম্মন্তিধ কুদাচনং
অবেরেনা সম্মন্তি এস ধম্ম সনাতন, আত্তদন্ড সূত্ত
 “Dhamma as I understand it consists in recognizing that enmity does not disappear by enmity. It can be conquered by love only”
বৈরি দিয়ে বৈরিতাকে ধ্বংস করা যায় না। একে কেবলমাত্র প্রেম ও ভালবাসার মধ্য দিয়ে জয় করা সম্ভব। সমস্ত সত্তার পারস্পরিক সম্পর্কের মূলাধার হল প্রেম। প্রেমই আসল ধর্ম। হত্যা কখনো কারো ধর্ম হতে পারেনা। ক্রোধ, ঘৃণা কখনো ধর্মের পরিভাষা হতে পারেনা, পরন্তু প্রেম, ভক্তি, দয়া, করুণাই হল ধর্মের আকর।

অসুর ধম্মের এই বেগবান প্রবাহ যুগে যুগে নিষ্পেষিত হলেও ফল্গুধারার মত বয়ে চলেছে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কদাকারের গ্লানি ঝেড়ে ফেলার জন্য ভগবতো হয়েছেন যুগ পুরুষেরা। ( ভগ শব্দের অর্থ যোনি বা সৃজন ক্ষেত্র। এখানে ভগবতো কথাটির অর্থ হল যিনি পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাই তিনি ভগবান। ভগবান ঈশ্বরের প্রতিশব্দ নয়)। এবং এই সব যুগ পুরুষেরাই তাদের নিজেদের কর্ম ধারার মাধ্যমে ধম্ম বা জীবন শৈলীকে আবার কলুষ মুক্ত করেছেন। ক্যাটালহক, মেহেরগড়, সুমের, মেসোপটেমিয়া, হরপ্পা, মহেঞ্জোদড়ো, গঙ্গারিডি প্রভৃতি সভ্যতার ধাপে এসে তারাই উড়িয়েছেন জীব ধম্মের সেই সনাতন নিশান।
জীবে দয়া নামে রুচি মানুষেতে নিষ্ঠা।
ইহা ছাড়া আর যত সব ক্রিয়া ভ্রষ্টা।।


4 comments:

  1. লেখাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। শারদুৎসবের প্রক্কালে এমন লেখা সময়ের দাবিতেও খুবই প্রাসঙ্গিক হয়েছে। লেখক ধন্যবাদ এমন সুন্দর রচনার জন্য।

    অসুর নিয়ে এখন বেশ চর্চা হচ্ছে। এটা যত বাড়বে মূলনিবাসী জনগনের আত্ম-মর্য্যাদার আন্দোলন ততই তীব্র রূপ নেবে। এটা খুবই ভাল হবে।

    সম্প্রতি আমরা এই বিষয়ের উপর একটা বই প্রকাশ করেছি, যার নাম- 'অসুর সভ্যতার উৎস সন্ধানে।' লেখক- গোবর্দ্ধন মান্না।

    ReplyDelete
  2. লেখাটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। শারদুৎসবের প্রক্কালে এমন লেখা সময়ের দাবিতেও খুবই প্রাসঙ্গিক হয়েছে। লেখক ধন্যবাদ এমন সুন্দর রচনার জন্য।

    অসুর নিয়ে এখন বেশ চর্চা হচ্ছে। এটা যত বাড়বে মূলনিবাসী জনগনের আত্ম-মর্য্যাদার আন্দোলন ততই তীব্র রূপ নেবে। এটা খুবই ভাল হবে।

    সম্প্রতি আমরা এই বিষয়ের উপর একটা বই প্রকাশ করেছি, যার নাম- 'অসুর সভ্যতার উৎস সন্ধানে।' লেখক- গোবর্দ্ধন মান্না।

    ReplyDelete
  3. আরো সমৃদ্ধ হলাম। আপনার অসুর গবেষণার সমস্ত তথ্য সমৃদ্ধ একটি বইয়ের আশা করছি। জয় অসুর।

    ReplyDelete