Pages

Saturday 4 October 2014

পুরুলিয়ায় অসুর পরবঃ একটি প্রতিবেন

MAHISASSURA in Terracotta Art, Adra Rly Station 
গত ৩রা অক্টোবর পুরুলিয়া জেলায় কাশীপুর থানার অন্তর্গত ভালাগাড়া  উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ভাব গম্ভীর পরিবেশে অনুষ্ঠিত হল অসুর উৎসব। বিহার,  ঝাড়খণ্ড ও পশ্চিমবঙ্গের ৩০টি মূলনিবাসী সংগঠনের প্রতিনিধিরা এই বিস্মৃত মহান  যোদ্ধা হূদুড় দুর্গার স্মরণ সভায় উপস্থিত থেকে অনুষ্ঠানটিকে মূল ভারতীয় সংস্কৃতির প্রতীকী সভার মর্যাদা প্রদান করেন। সভা থেকে প্রত্যেক প্রতিনিধিদের মনে মূলভারতীয় সংস্কৃতির পুনর্জাগরণের শপথ সঞ্চারিত হয়। বিশিষ্ট ব্যক্তি বর্গের মধ্যে এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সমাজ সংগঠক সৃষ্টিধর মাহাত, ম্নোহ্র মৌলী বিশ্বাস, আই পি এস নজরুল ইসলাম এবং প্রখ্যাত আদিবাসী দিসম মাঝি ডঃ নিত্যানন্দ হেম্ব্রম মহাশয়। 

সকাল ১১টার সময় আদিবাসী প্রথা অনুযায়ী নাইকে  কুডাম নাইকে মহান হুদুড় দুর্গার মূর্তির সমানে করম গাছের ডাল পুতে স্মরণ অনুষ্ঠান উদযাপন করেন। আগত প্রতিনিধিরা মাতৃভূমিনর স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধে নিহত হূদুড় দুর্গার মূর্তিতে মালা দিয়ে সম্মান জানান। 
এর পরেই আরম্ভ হয় মহান সম্রাটের স্মরণে আয়োজিত আলোচনা সভা। বিভিন্ন রাজ্যের থেকে আগত প্রতিনিধিরা এই আলোচনায়  অংশগ্রহণ করেন। আলোচক সৃষ্টিধর মাহাত মহাশয় হুদুড় দুর্গার মহান যুদ্ধের সাথে সাথে মূল নিবাসী সংস্কৃতির স্বতন্ত্রতা রক্ষার লড়াইয়ে রাঢ় অঞ্চলের অংশগ্রহণের বিশদ আলোচনা করেন। মাননীয় নজরুল ইসলামের আলোচনায় উঠে আসে আর্য-অনার্য লড়াইয়ের দ্বান্দ্বিক বাস্তবতা। আর্য শাসন ব্যবস্থা এখনো কি ভাবে মূলনিবাসীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে চলেছে এবং সেই বঞ্চনার কাজ সুচারু রূপে সংঘটিত করার জন্য কোন ধরণের ষড়যন্ত্র করে চলেছে তার বিশদ বর্ননা করেন। তিনি এ কথা বলতে ভোলেন নি যে, এদেশের মুসলমান সমাজ এই মূলভারতীয় সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর্য-অনার্য লড়াইয়ের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তিনি দলিত মুসলিম সংহতির উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। এই লড়াইয়ে এদেশের মুসলমানদের কী করনীয় তাও তিনি আলোচনা করেন।

হুদুড় দুর্গা স্মরণের মূল উদ্দেশ্য ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের উপর বিশেষ ভাবে আলোকপাত করেন শ্রদ্ধেয় দিশম মাঝি ডঃ নিত্যানন্দ হেম্ব্রম। তিনি নানান ঐতিহাসিক তথ্য থেকে উল্লেখ করেন যে প্রাচীন কালে এই জনপদের নাম ছিল  “বোঙ্গাদিশম” এবং যার মহান সম্রাট ছিলেন এই বোঙ্গাসুর বা মহিষাসুর। হূদুড় (বজ্রের ধ্বনি কে হুদুড় বলা হয়) বা বজ্রের মত ছিল তার প্রভাব ও প্রতাপ। তাই তার আর এক নাম হুদুড় দুর্গা। মহাতেজা এই রাজার পরাক্রান্ত শক্তি ও যুদ্ধ কৌশলের কাছে আর্য বাহিনী মুহুর্মুহুর  পর্যুদস্ত হয়। কোন ভাবেই বোঙ্গাদিশমে জয় করতে পারেনা আর্য বাহিনী। অবশেষে ছলনা ও কপটতাকেই তারা বঙ্গ বিজয়ের উপায় হিসেবে বেছে নেয় এবং স্বর্গের অপ্সরা মেনকার কন্যা দুর্গাকে মহিষাসুর বধের জন্য প্রেরণ করে। মাননীয় নিত্যান্দ হেম্ব্রম উল্লেখ করেন যে দেবতাদের স্বর্গকে মহান অসুরেরা পতিতালয় বলে মনে করতেন। দেতারা মূলভারতীয় রাজাদের পরাজিত ও নিহত করার পর তাদের স্ত্রী ও নারীদের এই দুর্গ বা স্বর্গে নিয়ে আসত এবং যথেচ্ছ যৌন নিগ্রহ করে তাদের নর্তকী বা  দাসীতে পরিণত করত এবং পরবর্তী কালে যুদ্ধের প্রকৌশল হিসেবেই এই নারীদের ব্যবহার করত। দুর্গাও দেবতাদের পতিতালয় থেকে আসা এমন এক নারী যে মহিষাসুরের সাথে প্রেমের ছলনা করে যৌন সংসর্গে লিপ্ত হয় এবং সুযোগ বুঝে মহিষাসুরকে হত্যা করে। এই ঘটনায় অসুরপুরিত শোকের ছায়া নেমে আসে। অসুর যোদ্ধারা নারীর ছদ্মবেশ ধারণ করে যাতে এবং “ ও হায়রে ও হায়রে’ গানের সুরে ভুয়াং নাচ করতে করতে বেরিয়ে পড়ে। শোক পালনের এই লোকাচারকে “দাশাই পরব” ও বলা হয়।
আলচনা সভার মাঝে মাঝে চলে প্রাচীন এই ঘটনার উপর সংগৃহীত লোকসঙ্গীত। যে লোকসঙ্গীতগুলির কথা ও ভাবের মধ্যে হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসের কারণ হিসেবে আর্য বাহিনীকেই দায়ী হিসেবে বর্ণনা করা হয়। কিছু গানে উঠে আসে আক্ষেপের সুর। নিজস্ব সংস্কৃতি ত্যাগ করে আর্য সংস্কৃতির বশ্যতা স্বীকার করার অনুতাপ। ত

রাত ৮টার সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনুষ্ঠান বাতিল করতে হয়। ফলে ভুয়াং, করম, শড়পা ও দাশাই নাচের অনুষ্ঠান করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। আগত প্রতিনিধিরা বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে মিলিত হয়ে এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেবার জন্য শপথ করেন। মাননীয় নজরুল ইসলাম সাহেব আগামী বছর এই অনুষ্ঠান কোলকাতায় করার জন্য সকলকে অনুরোধ করেন এবং সেই অনুষ্ঠানে সকলকে সহযোগিতা করার জন্য আবেদন জানান।    

No comments:

Post a Comment