মতুয়া
জীবন কেমন হওয়া উচিৎ ২ -কালিদাস বারুরী
প্রথম অধ্যায়ে যথার্থ মতুয়া
জীবন গঠনতন্ত্রের উপর হরি-গুরুচাঁদীয় দর্শনের ভাবাদর্শ আপনাদের কাছে উপস্থান করা
হয়েছে । এবার দ্বিতীয় পর্ব। (মতুয়া দর্পণ ৫৮সংখ্যা থেকে হুবহু তুলে দেওয়া হ'ল)
রাজর্ষি গুরুচাঁদ ঠাকুরের ক্ষুরধার
শিক্ষাবপ্লবের ফলে লক্ষ লক্ষ উচ্চ শিক্ষিত ফসল দিয়ে গোলা ভরেছে শত লক্ষ পরিবার।
সেসব অর্থমূল্যে মূল্যায়িত শক্ষিত সমাজ এখন 'এলিট' শ্রেনীতে পৌছে গিয়ে
ভুলে গেছেন হরি-গুরুচাঁদ ঠাকুরকে তাঁদের কাছে চালচুলাবিহীন সাদামাটা হরিভক্তরা
তুচ্ছ-চাচ্ছিল্লে হরিব্বোলার দল নামে অভিহিত । কিন্তু বৈদিক অনুশাসনে সমৃদ্ধ
বহিরাঙ্গ রঞ্জিত বাক্পটু সুকৌশলী বর্ণচোরা শোষক গুরুদের পদলেহন করে ওনারা ধন্য
হন। নিজেদের পিতৃপরিচয় লুকিয়ে জাতে ওঠার সিড়ি খুঁজে বেড়ান। অথচ তপসিলী কোটায়
সরকারি সুযোগ সুবিধার নিযার্সটুকু নির্লজ্জের মত চুষে খাচ্ছেন বংশ পরম্পরায়। পিছনে পড়ে থাকা ভাইবোনদের দিকে
একবারও তাকান না । সামাজিক দায়িত্ব বোধ তাদের মধ্যে কদাচিৎ দেখা যায় মাত্র।
অথচ সরকারি চাকুরির কোটা তাদের জন্য প্রথম
আদায় করেছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। নিজের জন্য নয়, সমাজের জন্য, স্ব-জাতির
জন্য। দূরদর্শী গুরুচাঁদ ঠাকুর বহুপূর্বে তাঁদের উদ্দেশ্যে ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন,-
"আজি যারা তপসিলী
জাতি সাজিয়েছে।
শিক্ষা ছাড়া উন্নতি কি
সম্ভব হয়েছে।।"
ঘৃণক আর দলকের নিষ্পেষণি ধর্মীয় ফতোয়ার
বিরুদ্ধে, আর্ত-ক্ষুধার্ত বহুজনের পরিত্রাণের জন্য হরি-গুরুচাঁদের ছিল আপোষহীন
মুক্তি সংগ্রাম। এই ইতিহাস যারা স্বীকার করেন না, তাদের
কি মতুয়া বলা যায় ? তাঁরা কি বিবেকীবিধানে 'মানুষ' পদবাচ্যে পড়ে ? তারা কি সত্যদর্শী শিক্ষিত?
শুধু মতুয়া ঘরাণায় কথা ভাবলে ভুল হবে ।
তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় পতিত বহুজন সমাজের ছেলেমেয়েদের যেমন শিক্ষা গ্রহণের অধিকার
ছিল না তেমনি তাঁদের জন্য শিক্ষার কোনো ব্যবস্থাও ছিল না । এমন কঠিক পরিস্থিতির
সঙ্গে মোকাবিলা করে রাজর্ষি গুরুচাঁদ ঠাকুর শিক্ষার বন্ধ দুয়ার খুলে দিলেন ।
রাতারাতি তাঁর শিক্ষারূপ কল্পবৃক্ষ থেকে উঠে এলো শত সহস্র মাণিক রতন ।
এখন তাদের বংশধরেরা হরি-গুরুচাঁদকে চেনে না
-চিনতে চায়ও না । এভাবেই সমাজে জন্ম হয় অকৃতজ্ঞ, বেইমান, বিভীষণদের । তাঁরা নিজেদের প্রতিপত্তি নিয়েই ব্যস্ত । গুরুচাঁদের মত
সমাজ গড়ার কারিগর হয়ে বন্ধুত্বের বা স্ব-জাতি উন্নয়নী চেতনাদ্দীপ্ত
ভ্রাতৃত্ববোধদিপনায় হাত পম্প্রসারিত করে না । অথচ গুরুচাঁদ ঠাকুর প্রেম প্রক্ষালনী
দরদী ভাষায় বারবার বললেন-
"জাতির উন্নতি লাগি, হও সবে
স্বার্থত্যাগী
দিবারাত্র চিন্তা কর তাই
জাতি ধর্ম, জাতিমান,
জাতি মোর ভগবান
জাতি ছাড়া অন্য চিন্তা নাই
।।"
আহা রে ! এমন দরদ দিয়ে আমার চিন্তা অতীত এবং
বর্তমান কুচক্রী সমাজ ব্যবস্থায় আর কে
করেছে ? শিক্ষিত সমাজ জীবন কেমন হওয়া উচিৎ , একটু ভেবে
দেখবেন কি ?
গুরুচাঁদীয় শিক্ষা বিপ্লবের তীব্রতায়
দ্রুতগতিতে বেরিয়ে আসা শিক্ষিত যুবকদের সরকারী চাকুরীর ব্যবস্থাও রাজর্ষি নিজ
ক্ষমতায় করে দিলেন । তিনি বললেন-
"বিদ্যাহীন নর যেমন পশুর সমান ।
বিদ্যার আলোকে প্রাণে জ্বলে
ধর্মজ্ঞান ।।
-----------------------------------
আইন সভায় যাও আমি বলি রাজা হও ।
ঘুচাও এ জাতির মনের ব্যথা
।।"
কিন্তু গুরুচাঁদ ঠাকুর পশুবৎ জীবন থেকে
যাঁদের শিক্ষা, ধন, মান, যশ
প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছিলেন পরবর্তীকালে তাঁদের বংশধরেরা কেউ জাতির মনের ব্যথা ঘুচাতে
এগিয়ে আসেনি । গুরুচাঁদের মনের ব্যথা গুরুতর হল নাকি ? প্রশ্ন
থেকে যায়,
বিদ্যার আলোকে তাঁদের অন্তরে মতুয়া ধর্মজ্ঞান জ্বলে উঠেছিল কি ? সমাজিক দায়বদ্ধতা, ঋণ জ্ঞানে ভাবা উচিৎ ছিল
নাকি ?
আমরা সংঘব্দধ হতে পারি নাই । নিজেদের মধ্যে
হিংসা, দ্বেষ, ঈর্ষা, স্বার্থপরতা
ছড়িয়ে দিয়েছি । আমরা ব্রাহ্মণবাদীর বর্ণাশ্রয়ী
শিক্ষা নিতে ভালবাসি । তাই নিজেদের মধ্যে বিবাদ করি, হিংসাকরি, শিক্ষিত অশিক্ষিত বিভাজন করি ।
হরি-গুরুচাঁদীয় শিক্ষায় আছে প্রেম-জ্ঞান-সাম্য-স্বাধীনতার তত্ত্ব-দর্শন, চেতনা প্রদীপ্ত চৈতন্য শক্তির উষ্ণ-প্রস্রবণ । ভ্রাতৃপ্রেম, সঙ্গ এবং সংঘবদ্ধ এককিভুত মানব কল্যাণকামী সৃজনশীল প্রবহমান মহানশক্তির
উৎস এই মতুয়াধর্ম । আমরা এই মহান ধর্মের মর্মকথা না বুঝে মুখপোড়া বাঁদরের মত এই
ধর্মকে কালিমা লিপ্ত করে বলেছি "লোকায়ত
ধর্ম" । পক্ষান্তরে কল্পিত হিংসাশ্রয়ী দেব-দেবী আরাধনায় মেতে
উঠে হারিয়ে ফেলেছি মাণীক রতন, ভুলে গেছি
ভ্রাতৃপ্রেম, শিথিল করেছি স্ব-জাতি উন্নয়ন ।
গুরুত্ব দিয়ে গুরুর কথা না মেনে গরুবৎ
বিশৃঙ্খল জীবন-যাপন করতে করতে আমার আর রাজা হওয়া হল না বরং বরণ করেছি প্রভু ভক্ত
দাসত্বের জীবন ।
"ইতর পশুরা আছে বেঁছে যেই ভাবে
তোরাও তাদের মত কাজে কি
স্বভাবে
এমন জীবনে বল বেঁচে কিবা ফল ।
আকারে মানুষ বটে পশু একদল
।।"
বহুস্থানে দলপতিদের মধ্যে ভেদাভেদ অর্থাৎ
সহাবস্থানের আন্তরিক ফারাক লক্ষ্য করেছি । যেমন, মল্লিক বাবুর বাড়ির হরিসভায় 'রামের দল' গেলে শ্যামের দল যাবে না । কারণ,
ওদের মধ্যে মতবিরোধ বা মনোমালিন্য । অথচ উভয় দল মতুয়া, 'হরিবোল' নামগানে আসর মাতায়, অশ্রু পাত করে, শতবার পদ ধূলি মাথায় নেয় ।
প্রশ্ন এখানে, আমরা কি মতুয়া না ভন্ড ? আমরা ভ্রাতৃপ্রেমে বিশ্বাসী না ভ্রাতৃবিচ্ছেদে বিশ্বাসী ? মতুয়া জীবন কেমন হওয়া উচিৎ ভেবে দেখার সময় এসেছে ।
ব্রাহ্মণ্যবাদীরা তাদের সুখসুবিধার জন্য কৌশলী বর্ণ প্রকরণ করে মানুষকে শত শত জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত করে গোষ্ঠীদাঙ্গা
বাঁধিয়ে একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে । আর আমরা নিজেরা নিজেদের বিচ্ছন্ন করে
কি উপকার করছি ? এই বিচ্ছিন্নতাবাদের বিরুদ্ধে দলিত বহুজন
পরিত্রাতা হরি-গুরুচাঁদ বললেন,-
"যে জাতির দল নেই, সে জাতির বল
নেই ।
যে জাতির রাজা নেই, সে জাতি তাজা
নেই ।।
------------------------------------
ভিন্ন ভিন্ন দল কেহ কর না গোসাঁই ।
---------------------------------------
দুই ভাই এক ঠাই রহ মিলেমিশে ।
ভাই মেরে বল কেন মর হিংসা বিষে ।।"
স্বজনের অশ্রুসিক্ত সুর মুর্ছনায় আমাকে টেনে
নিয়ে গেছে বাংলার অজানা প্রান্ত সীমায় । সর্বত্র লক্ষ্য করেছি ভেদাভেদহীন অকাতরে
প্রণাম নিবেদনের দৃশ্য । যে দৃশ্য স্মরণ করায়, নবদিগন্তের নিষ্পাপ আত্মজাগরণী মন্ত্র "আত্ম
দীপ ভব", হে সচ্চিদানন্দময় আনন্দ এসো মোর মন
মন্দিরে ।
"প্রেমের নিগড়ে বাঁন্ধি, সবে করে
কাঁদাকাঁদি
ভ্রাতৃভাব আনিল সংসারে ।"
কিন্তু পরক্ষণেই দেখি শিক্ষিত অশিক্ষিতের
ভেদাভেদ । তাদের কথা, "নেহা ফড়া জানা বাবুরা আমাগো ফচন্দ করে না । ওয়াগো সাথে মেলামেশা
নাই । ওনারা মতুয়া ধম্মে দীক্কা মানে না, গুরুকরণ মানে না,
নক্কীপূজা কালীপূজা, দুগ্গা পূজা -
কোনো পূজাই মানে না । ঠাহুর তো খ্যারোদের সাঁদ । উনি গুরু অয় ক্যাম্বালে । ওনারা
বামুন ঠাহুরেও মানে না । য-ত্-ত্য সব নোম্বার শিক্ষিতের দল ।"--ইত্যাদি ।
এনারা যুক্তিতর্কের ধার ধারে না । বোঝালেও
বুঝতে চান না, কারণ এই শিক্ষা তাঁরা তাঁদের দীক্ষাগুরুর কাছ থেকে পেয়েছে । তাঁরা
দীক্ষাগুরুর ছবি ঠাকুরের আসনে রেখে ধূপ-দীপ জ্বালিয়ে ডঙ্কা কাশী বাজিয়ে পূজা করেন । হরি-গুরুচাঁদ ঝুলে
থাকে দেওয়ালে । এনাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে যে, ঠাকুর ক্ষীরোদের সাঁই । তিনি থাকেন
অমৃতলোকে । ধরাধামের লীলা শেষ করে আবার অমৃত লোকে চলে গেছেন । যিনি ক্ষীরোদসাঁই ,
স্বর্গধামে যাঁর বিশ্রামাগার । তিনি দীক্ষা দেবেন কমন করে । অতএব
গুরুর মধ্য দিয়ে তাঁর পূজা পূর্ণতা পায় ।
গুরুচাঁদ ঠাকুর বজ্রকন্ঠে
বললেন,-
"বিদ্যার অভাবে
অন্ধ হয়ে সবে ।
অন্ধকারে আছো পড়ে ।।
জ্বেলে দাও আলো মোহ
দূরে ফেলো ।
আঁধার ছুটিবে দূরে ।।
মতুয়া ধর্মে যেনারা গুরুগিরি করছেন তাদের
সর্বনাশা ব্যাক্তিস্বার্থ ত্যাগ করে সাবধান হওয়া উচিৎ । ভুল পথে ভক্তদের পরিচালিত
করে মহান মতুয়া ধর্মের সর্বনাশ ডেকে আনবেন না । ব্রাহ্মণ্য ভেদনীতি পূর্ণ বৈদিক
আচরণ ও গুরুবাদ বর্জন করে ভক্তদের হরি গুরুচাঁদীয় বেদ-বিধি তন্ত্র-মন্ত্র মুক্ত
শিক্ষার আলোতে নিয়ে আসুন । তাতে আপনারাও বাঁচবেন, দেশ-জাতি
পঙ্কিল বাতাবরণ থেকে স্ব-মহিমায় জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করবে । সাবধান । বেশী
চালাচালি করতে গিয়ে চুলোচুলি না হয়ে যায় । বিদ্যার অভাবে ভক্তদের অন্ধ করে রেখেছেন
কেন ? তাদের জীবনে জ্ঞানের আলো জ্বালালেন ন কেন ? গুরুচাঁদের নামে ধ্বনি দিচ্ছেন অথচ তাঁর শিক্ষা নীতি মানছেন না কেন ?
গুরু-গোসাঁই-পাগল-দলপতিদের একটাই প্রশ্নকরি,- গুরুচাঁদ ঠাকুর উঠে যাবার পর(১৯৩৭-২০১৪)-৭৭ বৎসরে লেখাপড়া না শিখে
তাঁদের প্রবর্তিত মহান মতুয়া ধর্মের সহজ-সরল নীতি বিধির অর্থ বুঝে অথবা না বুঝে
ভক্তদের ভুল পথে পরিচালিত করে এসেছেন বলেই ভক্তজন মানসে নিগুড় ভ্রাতৃত্ববোধের
বিবেকী দানা বাঁধতে পারে নাই ।
আপনাদের কাছে জানতে চাই
ক) গুরুচাঁদ ঠাকুরের শিক্ষা বিপ্লবের প্রথম
সারির সৈনিক হয়েও নিজেরা শিক্ষিত (অন্তত সীমিত শিক্ষায়) হলেন না ? আর
পর্যন্ত কোনো শিক্ষা আন্দোলন করেছেন কি ?
খ) আপনারা গুরুগিরি করছেন অথচ ঘরে ঘরে
শিক্ষা বিপ্লব না করে ভক্তদের অশিক্ষার অন্ধকারে রেখে কোন চাঁদের হাট মিলিয়েছেন ?
গ) মতুয়াধর্মে বেদ-বিধি কল্পিত মূর্তিপূজা
নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও আপনাদের উৎসাহে ঘরে ঘরে এসবের প্রচলন বিদ্যমান কেন ?
"হরিবোলা মোতোদের ভক্তি
অকামনা ।
নাহি মানে তন্ত্র-মন্ত্র বজ্র
উপাসনা ।।
বিশুদ্ধ চরিত্র প্রেমে হরি হরি
বলে।
অন্য তন্ত্র-মন্ত্র এরা মাব
পদে ঠেলে ।।
তন্ত্র-,মন্ত্র
ভেক ঝোলা সব ধাঁ ধাঁ বাজী ।
পবিত্র চরিত্র থেকে হও কাজে
কাজী ।।(" হঃ লীঃ)
ঘ) শিক্ষিত মতুয়ারা আপনাদের চক্ষুশূল কেন ? তাঁরা
হরি-গুরুচাঁদের মূল আদর্শ অনুযায়ী সমাজ
পরিবর্তনের পথে বিপ্লব ঘটাতে চায় বলেই কি
আপনাদের ঘরে ঘরে অমাবস্যা নেমে আসার ভয়ে শিক্ষার বিরুদ্ধাচারণ করে ছলেছেন ?
আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আবেদন করছি,
"অনুগ্রহ করে শিক্ষাকে মর্যাদা দিন, 'ভুল' কে 'ভুল' বলুন,
সত্যকে জানুন এবং সত্য প্রচার করুন । গুরুচাঁদ ঠাকুরের
মর্মস্পর্শী ইচ্ছা ও নির্দেশ,-
"অনুন্নত জাতি যদি
বাঁচিবারে চাও
যাক প্রাণ সেও ভাল বিদ্যা শিখে
লও ।"
ভক্তদের
অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নিয়ে আসুন ।
বহু শিক্ষিত মতুয়া পরিবারে ও
জাঁকজমকপূর্ণ বেদাচারী আচার অনুষ্ঠান ও দেব-দেবী পূজা পার্বণের প্রাচুর্যতা
লক্ষ্যনীয় । আপনারা ঠাকুরের প্রিয়জন হয়ে ঠোক্কর খাবেন কেন ? আপনারা মতুয়া
ঘরাণার যথার্থ ক্রিয়াকাজে উদাহরণ হয়ে উঠলে পিছনের সবাই আপনাদের অনুকরণ ও অনুসরণে
উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠবে সন্দেহ নেই । শিক্ষা আনে চেতনা । চেতনা আনে বিপ্লব । এই বিপ্লবে
আপনারাই সৈনিক । ঘরে ঘরে বিপ্লবের প্লাবন বইয়ে মতুয়া ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার
গুরুদায়িত্ব আপনাদের । দলিত বহুজন সমাজের হরি-গুরুচাঁদের মত পরিত্রাতা পেয়েও যদি
দৈব দাসত্বের অর্গল কল্পিত ঐশ্বরিক শৃঙ্খল ভেঙে শিক্ষিত সমাজ যদি এগিয়ে না আসে তবে
এই জাতি কোনোদিন জাগবে না । তাঁরা বিবেক হীন চামচেয় পরিণত হবে । আসুন আমরা স্মরণ
করি দলিত মহাজনের অমৃত বাণী-
"ব্রাহ্মণ্য ধর্মেতে পুষ্ট
ভেদবুদ্ধি দ্বারা দুষ্ট ।
স্বার্থলোভী ব্রাহ্মণের দল ।।
---------------------
হিংসা দ্বেষ দন্দনীতি আনে ঘরে ঘরে
।
আর্য মল হিন্দু হল বীর্য গেল মরে
।।
----------------------
অন্ধজনে দিতে আলো অমানীরে মান ।
ওড়াকান্দি অবতীর্ণ হলো ভগবান
।।"
প্রশ্ন থেকে যায়, সহজ সরল দলিত
বহুজন সমগোত্রীয়দের মধ্যে ভেদাভেদ দ্বন্দ্ব, বৈষম্য,
হিংসা, দ্বেষ অতি সুক্ষ্মচাতুর্যে
প্রবেশ করালো ব করাচ্ছে কারা ? তাকি একবার ভেবে দেখেছি ?
আমার মনে হয়, আমরা যতটা মনোযোগ দিয়ে
ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র দর্শন অধ্যয়ন করি তার সিকি ভাগ মনোনিবেশ করি না শ্রীশ্রী
হরিচাঁদ জ্ঞান-দর্শন তত্ত্বের উপর । যে দর্শন মতুয়াদের জীবনে এনেছে অপরা-বিদ্যা
শিক্ষার তিরন্দাজী জোয়ার । আমরা ভুলে গেছি আমাদের পূর্বের অবস্থানের কথা ।
"অনুন্নত জাতি যত এ বঙ্গ মাঝারে ।
শিক্ষাশূন্য ছিল সবে ঘোর
অন্ধকারে ।।"
সেই অন্ধকার অজ্ঞানতা থেকে আজকের শিক্ষা
সভ্যতা, গাড়ি, বাড়ি, এক কথায়
বিশ্ব এসেছে হাতের মুঠোয়- যার আঙ্গুলী লেহনে, তাঁকে স্মরণ
,মনন,তর্পণ করবো না ? তিনিই তো আমার জীবন প্রদীপ, একমাত্র আরাধ্য
দেবতা । সেই মধুমাখা হরিনাম বেজে উঠুক আমার মনোবীণায় । এসো হে মনের মানুষ থাকো মোর
হৃদয় জুড়ে । এসো হে মতুয়াধীশ তাপিত তৃষিত প্রাণে তুমি প্রাণারাম ।
বহুস্থানে লক্ষ্য করেছি, নানাস্থান
থেকে আগত ভক্তেরা ডঙ্কা, কাশী, নিশান
নিয়ে শ্রীহরি মহোৎসব আসরে মন্দির পরিক্রমা করে হরিনামের মাতাম দিয়ে ছড়িয়ে পড়েন আশে
পাশের বাড়ি বা পাড়ায় । শুরু করেন আষাঢ়ে গল্প । নিন্দা মন্দের ধামা উবুড় করে জাহির
করেন নিজের বুদ্ধিমত্তার কেরামতির অলীক ভক্তবিটেল চর্চা । অন্যান্য শ্রোতা বর্গ
রসিয়ে কসিয়ে উপভোগ করেন । অপ্রচলিত বিশেষণ প্রয়োগ চলতে থাকে পরনিন্দা পরচর্চা এবং
বক্তার বুদ্ধিমত্তা ও জ্ঞানগরিমার পদাবলী । গপ্প দাদুর গালভরা গপ্পে মশগুল ভক্তরা হাসি ঠাট্টায় বুঁদ হয়ে যায় ।
ওদিকে হরিবাসর ফাঁকা । হরি ভক্তের চলন এমন হওয়া উচিৎ কি ? তাঁদের উচিত ছিল, শ্রী বিগ্রহের মন্দির
পরিক্রমা ও মাতাম দিয়ে উপবেশন করে ধ্যানস্থ হওয়া । এতে শরীর মন শান্ত হয়, কূ-চিন্তা দূরে সরে যায় ।
মতুয়া ভক্তেরা পেটুক আখ্যা পেয়েছে । এনাদের
অন্নপ্রসাদ গ্রহণ বা ভোজনের নির্দিষ্ট কোন সময় নেই । আমি নিজে দেখেছি এক বাড়ির
হরিসভায় হরিভক্তরা ভোর ৪টার সময় গোগ্রাসে গরম গরম ডাল, ভাত তরকারি
আহারে ব্যস্ত । রাত বারোটার পর সকাল ৬-৭টা পর্যন্ত এরূপ ভোজন করতে আমি বহু স্থানে
দেখেছি । প্রত্যুষ কাল থেকে সকাল সাড়ে ছটার মধ্যেকার সময়টুকু "ব্রাহ্ম
মুহুর্ত" বলে । সাধারণত ভজন সাধন-পূজা পাঠ -প্রার্থনা
ইত্যাদি করার এটাই উপযুক্ত সময় । অথচ এই ঊষাকালে ভক্তদের মচমচে শুকনো লঙ্কা ভাজা
দিয়ে মহানন্দে পান্তা ভাত খেতে দেখেছি । অর্থাৎ ভোজন পর্বের জন্য নির্দিষ্ট কোনো
বাধা নিষেধ মানামানির বালাই নেই । এটা স্বাস্থের পক্ষে হানিকর । অন্ন প্রসাদ
গ্রহণের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারিত হওয়া শরীর স্বাস্থ্য ও সাধন ভজনের পক্ষে অতি
উত্তম প্রবন্ধ । একে মেনে চলা উচিত বলে মনে করি । আবার অধিক ভোজন রোগের কারণ ।
অতএব পরিমিত আহার করা মহাজনের নির্দেশ । এতে দেহরথ ভালো থাকে । দীর্ঘ পরমায়ু সহ
গতি সম্পন্ন হয় । সাধন ভজনে মনস্থির হয় । আপনি স্থির করুন, মতুয়া জীবন কেমন হওয়া উচিত । (চলবে)
No comments:
Post a Comment