হরিচাঁদ ও বাংলার চণ্ডাল বিদ্রোহ-১ম ভাগ
"Tall and large limbed Chandals were the active and
successful enemy of the Aryan inveders".
ভারতবর্ষের চণ্ডাল জাতি সম্পর্কে ১৮৯১ সালের সেন্সাস কমিশনার, সি.জে ওড়নীল দ্ব্যর্থ হীন ভাষায়
একথা ঘোষণা করেছিলেন।
চণ্ডাল একটি প্রাচীন নরগোষ্ঠী। ভারতবর্ষের সর্বত্র বিরাজমান এই নরগোষ্ঠীর শৌর্য-বীর্য প্রাগার্য ভারতের একটি উজ্জ্বলতম অধ্যায়। প্রাচীন পালি ও সংস্কৃত সাহিত্যে চণ্ডাল নরগোষ্ঠীর উল্লেখ আছে। মূলতঃ এই নরগোষ্ঠী প্রোটো-অস্ট্রাল নরগোষ্ঠীর একটি বলিষ্ঠ অংশ। বিবর্তনের ধারায় যে জনগোষ্ঠী পামির, তাকলামাকান হয়ে সমগ্র এশিয়া,আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত জনবিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল।
অসুরভাষী এই জনগোষ্ঠীই প্রাচীণ নগর সভ্যতার আদি প্রবর্তক,ধারক,বাহক ও প্রতিপালক। জ্ঞান,বিজ্ঞান,ব্যবসা,বানিজ্য,শিল্পনীতি ও অর্থনীতির যথার্থ প্রয়োগের সমন্বয়ে ভাবিকালের সম্ভাব্য সভ্যতার সোপান প্রস্তুত করতে পরেছিল এই প্রজ্ঞাবানেরা। এই সভ্যতাগুলি যথাক্রমেঃ
১)ক্যাটাল হউক(85000-9000 BC)
২)মেহেরগড় (7000 BC)
৩)আশিরিয়া/অসুরা/মেসোপটেমিয়া(6000 BC)
৪)ফনেশিয়া/আবেস্তা (5500-6000 BC)
৫)ইজিপ্ট (4500-5000 BC)
৬)ইন্দাস (2500-4500 BC)
৭)চায়না (1500-2000 BC)
অসুর ভাষী জনগোষ্ঠীর প্রচেষ্টা ও অবদানের ফলে প্রাচীণ কলেই গড়ে উঠেছিল একটি সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জ।
সমকালীন সভ্যতার সর্ব উচ্চ শিখরে বিকশিত হয়েছিল তার অনুশাসন এবং পারস্পরিক আদান প্রদান ও সহাবস্থানের নীতি। মেহেরগড়,হড়প্পা,মহেঞ্জোদড়, ধলাভিরা,লোথাল প্রভৃতি অসুর সভ্যতার অবিচ্ছেদ্দ অংশ হলেও শিল্প,সংস্কৃতি, ধম্ম ও দর্শনে একটি সম্পূর্ণ সতন্ত্রতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল। অসুরদের সঞ্চিত সম্পদের লোভেই আর্যভাষী বর্বরেরা আক্রমণ সংগঠিত করেছে যুগে যুগে। ধবংস করে দিয়েছে সভ্যতার স্মারক। নৃশংসতার কৃপাণেই সূচীত হয়েছে আর্যায়ন। অসুর সাম্রাজ্যের অন্যতম বলিষ্ঠ জাতি চণ্ডালেরাই এই আর্যায়নের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তু্লতে সক্ষম হয়েছিল এবং নিজেদের স্বকীয়তা ও স্বধম্ম অক্ষুন্ন রেখে পুনরায় নবকলেবরে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বিস্মৃত প্রাগার্যজনের বেদাতীত জ্ঞান।
লাঙ্গল,জোঙ্গাল,জঙ্গল,ডাঙ্গাল,বোহাল,খেড়ওয়াল,সাঁওতাল,বঙ্গাল প্রভৃতি আদি অস্ট্রাল শব্দগুলির ব্যুৎপত্তিগত বিশ্লেষণ করলেই চণ্ডাল শব্দের গুনগত এবং অর্থগত অভিব্যক্তিটি যথার্থ প্রতিভাত হয়ে উঠবে। ঋকের অনেকগুলি শ্লোকের রচয়িতা বিশ্বামিত্র ছিলেন চণ্ডাল। গুহক চণ্ডাল,রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী অনন্যতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। জাতক কাহিনীতে বোধিসত্ত্বকে সততার প্রতীক হিসেবে চণ্ডাল বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে বহুবার। কার্যসিদ্ধির জন্য সুদাস,মনু,অগ্নী,বরুন প্রভৃতি দাস বা অসুর নেতাদের ও যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হতো বৈদিক সাহিত্যে। অর্থাৎ রক্ষস (পরবর্তী কালে রাক্ষস বলা হয়েছে), অসুর,নাগ,চণ্ডাল শব্দগুলি কোন ভাবেই ঋণাত্মক নয় বরং গুণবাচক এবং ধ্বনাত্মক।
এই ক্ষেত্রে চর্যাপদের কয়েকটি দোহাতে চণ্ডাল শব্দের যে গুণগত এবং অর্থগত ভাব প্রকাশ করেছে তা খানিকটা আলচনা করা যেতে পারেঃ
"কেহো কেহো তোহোরে বিরুআ বোলই
বিদুজণ লোঅ তোঁরে কণ্ঠ ন মেলই।
কাহ্নে গাই তু কাম চন্ডালা।
ডোম্বি ত আগলি নাহি চ্ছিন্নালা" ।। (কাহ্নপাদ ১৮ নং চর্যা পদ)
বা
" কমল কুলিশ মাঝেঁ ভইঅ মিঅলী।
সমতাজো এ জলিঅ চন্ডালী।। (ধামপাদানাম, ৪৭ নং চর্যা পদ)
অথবা
বাজণাব পাড়ী পঁউআ খালে বাহিউ।
অদঅ বঙ্গালে ক্লেশ লুড়িউ।।
আজি ভুসু বঙ্গালী ভইলী।
ণীঅ ঘরণী চণ্ডালী লেলী।। (ভুসুপাদানাম,৪৯ নং চর্যা পদ)
এখানে পদকর্তাগণ চণ্ডালের প্রকৃত স্বরূপ উল্লেখ করে বলেছেন যে, আত্মশক্তি বিকাশের কঠিনতম পথ পরিক্রমার মাধ্যমেই একমাত্র অদ্বিতীয় বঙ্গালে প্রবেশ ঘটে।
এবং চণ্ডালী স্বরূপ স্বশক্তিকরণ হলে বা প্রজ্ঞার আলো প্রজ্বলিত হলে তবেই বাঙ্গালী হওয়া যায়। অর্থাৎ প্রজ্ঞা ও আত্মশক্তি উপলব্ধির সুসংহত এবং সমতা বোধের
অবস্থা প্রাপ্তিই চণ্ডাল মার্গদর্শন। চণ্ডালের স্বরূপ বুঝতে না পেরে অনেকে তাকে বিরুপ কথা বলে। কিন্তু বিদুজন বা গুণীজন তার কন্ঠ ত্যাগ করেন না।
স্মৃতি শাস্ত্র রচনার কালেই আক্রশ বশতঃ চণ্ডাল জাতিকে পঙক্তিচ্যুত করা হয়েছিল এবং রাজ দণ্ডকে ব্যবহার করে টেনে নামানো হয়েছিল সর্ব নিম্ন স্তরে । এই প্রসঙ্গে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা সাহিত্যের প্রসঙ্গে আলোচনাটি প্রনিধান যোগ্য। "বৈদিক কাল ও বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কেও আমরা সেই কাথা বলতে পারি। এই সুদীর্ঘ সময় ছিল ধ্বংসের যুগ,
অনুকরণের কাল। প্রাচীন দেশীয় শব্দ, লিপি, ভাষা আত্মসাৎ করার অন্ধকার যুগ। অর্থাৎ মূলত এদেশের ভাষা ও শব্দ সম্ভার, সাহিত্যরচনার রীতি এবং লেখকদের আশ্রয় করেই বিজয়ী আর্যরা নিজেদের প্রয়োজন সিদ্ধিমূলক বৈদিক রচনা করে নিয়েছিল। বেদ বা বৈদিক সাহিত্য তাই মূলতঃ ঔপনিবেশিক সংবিধান। ...............
এ সাহিত্য তাই উপনিবেশবাদের মূল সুর, ঘৃণা এবং জাত বিদ্বেষ, শোষণ ও পীড়নের কাহিনী কথায় ভরা।
........চূড়ান্ত বর্ণ -বিদ্বেষ চলেছে, ঈশ্বরের নামে ও ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে"।
আর্যরা অসহিষ্ণু । শিকার এবং সংগ্রহ,পরের ধন অপহরণ এবং বর্বরতাকে তারা পরিহার করতে পারেনি কখনো। আর্যদের ধর্ম পালনের কাঙ্খিত কামনায় অধিকাংশ জুড়েই পরিলক্ষিত হয়েছে অর্থ,সম্পদ,নারী,সুরা এবং যৌনতা প্রাপ্তির প্রবল আকুতি। অসুরদের (সুরা পান করে না যারা) ভাগিদারী ওরা কোন কালেই দিতে চায়নি। বরং অসুরদের শ্রম এবং উৎপাদনের উপর গড়ে ওঠা আর্থ-সামাজিক সম্পদের সমস্তটাই আত্মসাথ করার জন্য ধর্মগ্রন্থ ও অনুশাসনগ্রন্থের আশ্রয় নিয়ে বর্ণ ব্যবস্থাকে স্বর্গীয়
মহিমা প্রদান করেছে। ব্রাহ্মন্যবাদকে সর্বগ্রাসী করে তুলেছে এবং শ্রমজীবি মানুষের মুখে গরল ঢেলে দিয়ে সুধা খাওয়ার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেছে। বাংলায় পাল শাসনের পতনের পর একেবারে মুঘল আমলের শেষ পর্যন্ত এই ব্যবস্থার কোন পরিবর্তন সূচিত হয়নি।
হরিচাঁদ ঠাকুরের চণ্ডাল বিদ্রোহ ও মতুয়া ধম্ম তাই ভারতীয় অসুর ধম্ম ও দর্শনের এক বেগবান প্রবাহ।
মানবতার প্লাবনে বেদ,বিধি,শৌচাচারের বৃত্ত ভেঙ্গে ফেলে বুকের মাঝে বিশ্ব লোকের সাড়া পাওয়ার উদাত্ত আহ্বান। প্রজ্ঞা ও স্বশক্তি করণের অনবদ্য উন্মেষ। অজ্ঞানতা দূর করে সমতা প্রাপ্তির সর্ব উচ্চ মার্গে সমবেত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান। অথবা সহস্র বছরের অবজ্ঞার আবর্তে ঘনীভূত এক প্রবল ঘূর্ণিঝড়। বাঁধার গণ্ডি ভেঙ্গে ফেলার অদম্য অভিঘাত।
হরি চাঁদ অনুধাবন করেছিলেন ব্রাহ্মন্যবাদ মানবতাবাদের পরিপন্থী। একে স্বীকার করা মানেই গোলামির শৃঙ্খল পরিধান করা। আত্মপরিচয়, আত্মমর্যাদাকে চিরকালীন বিসর্জন দিয়ে ব্রাহ্মনের বিনম্র দাসে পরিণত হওয়া এবং জাত বেজাতের কলঙ্ক চিহ্ন শিরধার্য করে উচ্ছিষ্টভোগীর মত জীবন ধারণ করা। এর কোন অংশই তিনি স্বীকার করেন নি। বরং বেদ-বিধি, জাগ, যজ্ঞ, তন্ত্র, মন্ত্র, দেব-দ্বিজ প্রভৃতি অনৈতিক অনাচারকে অস্বীকার ও অগ্রাহ্য
করে মতুয়া দর্শনের আত্মপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
"নাহি মানে দেব দ্বিজ আলাহিদা পথ।
ইহারা হয়েছে এক হরি বলা মত।।
...কেহ বলে জাতিনাশা সকল মতুয়া ।
দেশ ভরি শব্দ হল মতুয়া মতুয়া।।
...তাহা শুনি ডেকে বলে প্রভু হরিচাঁন
ভিন্ন সম্প্রদায় মোরা মতুয়া আখ্যান"।।
No comments:
Post a Comment