অর্জুন-উর্বশী
সমাচার
শরদিন্দু বিশ্বাস
গড়িয়া, কোলকাতা, ১৭/১১/২০২৩
উর্বশী
আহা কী মোহিনীরূপ ওগো
প্রিয়তম
মন্মথশরে
বিদ্ধ হৃদয় আমার
গন্ধর্ববিদ্যায়
শ্রেষ্ঠা অমরলোকে আমি
ত্রিদশাধিপতি
তাই পাঠালেন আমায়
স্নিগ্ধ
শীতল জলে স্নান সমাপনে
গন্ধ,
মাল্যে সূক্ষ্ম বস্ত্রে সাজিয়েছি তনু
পরিমিত
সুরা পান করেছি যতনে
কামাতুর
মদনোন্মত্তা সুরসুন্দরী
মেঘমালাসম
এই দীর্ঘ কেশপাশ
শশধর
লজ্জিত হয় বদন দর্শনে
পীনোন্নত
পয়োধর গিরিশৃঙ্গ সম
মনোহর
কটিদেশ হৃদয় হরণী
ঋষিচিত্ত
মনোহারী পৌর কামিনী
অর্জুন
সকাশে আমি গরবী উর্বশী।
অর্জুন
হে
আনন্দময়ী অপ্সরাপ্রবরে
প্রনমি
তোমারে মাতা, আদেশো দাসেরে
কি নিমিত্ত আগমন, বল শীঘ্র করি
পালন করব আমি অবনত শিরে ।
উর্বশী
অদ্ভুত
তোমার এই নম্র সম্ভাষণ
অদ্ভুত
তোমার এই আত্তবিবেচনা!
অর্জুন
আপনি
আমার গুরু, পিতার রক্ষিতা
কুন্তি,
মাদ্রি শচীর ন্যায় আপনিও মাতা।
উর্বশী
দিব্যাস্ত্রের
শিক্ষা নিতে এসেছো এখানে
একে
একে যুদ্ধাস্ত্রের পেয়েছ সন্ধান
মোহিনী,
গন্ধর্বকলা, নৃত্য, বাদ্য, গীত
আমারে
দিলেন ইন্দ্র শিখাতে সে ভার।
অর্জুন
ভুলি নাই সেই দিন, সেই শুভক্ষণ
গন্ধর্ব
চিত্রসেন আয়োজিত সভা
মনোরম সুরলোকে মহেন্দ্র সকাশে
মহোৎসবে
সমাগত ভানু, শশধর
সমাগত
আদিত্য, রুদ্র, অশ্বিনীকুমার
অষ্টবসু,
চারণ, সিদ্ধ, রাজ ঋষিগণ
মোহময়
মোদির আলো ঘেরে চারিধার
সুললিত কন্ঠে গীত সুমধুর গান
বিশুদ্ধ
বীনাবাদন তালবাদ্য যোগে
অপ্সরা শ্রেষ্ঠা তুমি ত্রিলোক বন্দিতা।
উর্বশী
মৃদঙ্গ মন্দ্রিত যেন দ্রিমি দ্রিমি দ্রিমি
ঝংকৃত
তন্ত্রবাদ্য ধমনী প্রবাহে
হাতের
কঙ্কণ করে মৃদু কিঙ্কিণী
ঝনকে
ঝনকে শুনি নুপুর নিক্কন
আমি
যেন বাঁধনহারা মত্ত বিহঙ্গমী
প্রবল
ঝড়ের মুখে মেলে দুই ডানা
ছিন্ন
করে সুক্ষ বস্ত্র দিব্য দেহ ধরি
বিলিয়ে
দিলাম সুখে যা ছিল আমার।
অর্জুন
ভুলিনি ভুলিনি সেই অপূর্ব শবরী
প্রতিটি
বিভঙ্গ আছে মনোলোকে গাথা
তাই
তো শিখেছি আমি গুরুর সকাশে
নৃত্য,
গীত, তালবাদ্য চৌষট্টি কলা।
উর্বশী
গুরুকে ছাড়িয়েছো তুমি, অনায়াস ক্লেশে
প্রতিভার
পূর্ণ প্রকাশ রেখেছ সদনে
আন্দোলিত
অপ্সরাগণ পেতে সন্নিধান
তোমারে
কামনা করে হৃদে অনুক্ষণ!
অর্জুন
শিষ্য কভু বড়ো নয় গুরু কৃপা ছাড়া
যত
বড় হোক শিষ্য ঋণী অনুক্ষণ
আমার
যে সফলতা সে তোমার দান
গন্ধর্বকলায়
তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ মানি।
উর্বশী
তুমি কি অপ্সরা হবে, সুরলোক মাঝে
শাসন
করবে এই অমর কানন
কি
ভাবে জিনিব আমি দেব সুরগ্ণে
অসম্ভবকে যে ভাবে তুমি করেছো সাধন!
অর্জুন
কোন
কাজ অসম্ভব নয় জানি ত্রিভুবনে
যতনে
মননে হয় অসাধ্য সাধন
আমি
শুধু নিবিড় চিত্তে করি লক্ষ্যভেদ
কর্মযোগে
ফললাভ সম্ভব হে দেবী
উর্বশী
কেন তুমি দেবী, দেবী সম্ভাষো আমারে
উর্বশী
আমার নাম। ডাক নাম ধরি
অর্জুন
সম্ভব নয়, সম্ভব নয়, নাম ধরে ডাকা
প্রনম্য,
পূজনীয়া তুমি জননী সমান
উর্বশী
অসম্ভব
নয় কিছু বল কোন মুখে
পারলে না নাম ধরে ডাকতে আমায় !
অর্জুন
শিষ্টাচারের
গণ্ডি অতিক্রম করা
অবাঞ্ছনীয় অপরাধ ও হে দেবাঙ্গনা
আমি
মানব, জন্ম নরকুলে
অমানবীয়
আচরণ সম্ভব নয় দেবী।
উর্বশী
চিত্ত তব চঞ্চলিত, শঙ্কিত যে মন
তেজস্বিতা,
লোকাচার, মান, অপমান
দেবলোকে
শঙ্কা নেই, মরণশীল তুমি,
দেবলোক
অচঞ্চল অমরত্ব বলে
বল,
কি কারণে হৃদে চঞ্চলতা আসে?
চঞ্চল
চিত্তে কি বা হয় ফললাভ ?
অর্জুন
চিত্ত
চঞ্চলিত হয় নতুনের খোঁজে
কিছু
চাওয়া, কিছু পাওয়া নিত্য পথ চলা
এটাই
তো জীবন ধারা দিক নির্দেশিকা
লক্ষ্যে
পৌঁছানোর এই চিরন্তন খেলা
উর্বশী
অসীম লক্ষ্য তোমার,
অনন্ত সে চলা
আমার
লক্ষ্য তুমি, আপন করে পাওয়া
গ্রহণ করো হে নর আমার ভালবাসা
নিবিড়
করে বাঁধ আমায় দু’বাহু বন্ধনে
চিত্রসেন
বারংবার বলেছে আমায়
অর্জুন
না বঞ্চিত হয় স্বর্গফল লাভে
তাইতো
এনেছি দেখো সুধার ভান্ডার
প্রাণভরে
পান করো ওহে প্রিয়তম
অর্জুন
অসম্ভব, অসম্ভব মাতা! অসম্ভব এ কাজ !
উর্বশীঃ
আমি কি যোগ্য নই তোমার হে প্রিয়
আমি কি সুন্দরী নই, নই মনোলোভা ?
অর্জুন
সুন্দর, সুন্দর তুমি অতীব সুন্দর
তপস্যির তপভঙ্গ এমন মাধুরী
আমি তপস্যি নই, প্রেমিকও নই
তোমার কাছে পেতে চাই সুমাতার স্নেহ
উর্বশী
বলছ
কী বারবার? মাতা, মাতা, মাতা
আমি কারো মাতা নই, নই আমি দেবী
অপ্সরা কক্ষনো কারো পত্নী না হয়
দেহ
সৌন্দর্যে বাঁধা আমি অনুভূতি
অমরলোকের
প্রভূ ধেয়ানে সদাই
আমার
সঙ্গ পেতে দীর্ঘ প্রতিক্ষায়
লাইনে
দাঁড়িয়ে থাকেন যত তপধন
স্বর্গের
অস্তিত্ব আমি, আমি স্বর্গসুধা
আমি
ছাড়া স্বর্গলাভ না হয় পুরন
তুমি
মরণশীল, মর্তলোকবাসী
আমাকে
অবজ্ঞা করো কী সাহস বলে!
অর্জুন
তুমি আমার মাতা, পিতার সদনে,
গুরুপত্নী, মাতার সাথে
এমন অজাচার!
এ
অন্যায়, এ অন্যায় ঘোরতর পাপ !
নরলোকে
এই পাপ সবে না কখন
ঘৃণিত, নিন্দিত হবে আমার পৌরুষ
মাতার সাথে কামকেলি বিশ্বাস না হয়!
শিশুকালে
মাতৃক্রোড়ে করি কত খেলা
মাতৃস্তন্য সুধাপান করেছি যতনে
দুর্গসম
দুর্ভেদ্য সে মাতার আঁচল
শিরস্ত্রাণ
হয়ে সদা আশীষে আমারে
এ
হেন মাতার সাথে এমন আচরণ
পুণ্যতোয়া
স্নিগ্ধ জলে কীটের সহবাস
না
জানি কী পরীক্ষায় ফেলেছ আমারে
দংশিছ
মুহুর্মুহু এ অনঙ্গ বানে!
উর্বশী
এ
যে স্বর্গলোক, নরলোক নয়
পৃথিবীর
কোন নীতি শোভেনা এখানে
সুরলোক
জানেনা যে মাতা কারে কয়
কে
বা দুহিতা, কে ভগ্নী পরিচয়
এখানে
শুধুই নারী, শুধুই পুরুষ
পাপ
নেই, পুন্য নেই, নেই কোন গ্লানি
শুধুই
শরীর আছে শরীরের তরে
অমৃতস্য
স্বর্গফল শরীর সাধনে
তৈরি
হও শরীরসুধা বিলাব তোমারে
অর্জুন
অসম্ভব, অসম্ভব হে দেবী, অসম্ভব এ কাজ
উর্বশী
তবে
কেন খুঁজেছিলে আমায়
সুরালোকে
সমাগত শশধর মাঝে
কি দেখেছিলে অনুক্ষণ দুটি চোখ মেলে
কি
অন্বেষণ করছিলে শরীরে আমার
এই
চোখ, এ চিবুক, এই ওষ্ঠাধর
এ নিতম্ব, পয়োধর এ জঘন রেখা
এই
হস্ত, এই বাহু, এই কটিদেশ
কী
মহার্ঘ শরীরবৃত্তে করেছিলে সন্ধান
অর্জুন
পৌরবংশ জননী তুমি হে কল্যানময়ী
উৎফুল্ল নয়নে ছিল অপার বিস্ময়
আপনার
শিস্য হবার ছিল কৌতূহল
অসৎ
অভিসন্ধি ভাবা সমুচিত নয়
উর্বশী
পুরুবংশীয় পুত্রগণ তপবলে বলি
স্বর্গপ্রাপ্ত হয়ে তাঁরা আমাদের সাথে
ক্রিড়া
কৌতুকে মাতে অমর কাননে
তোমার
পৌরুষ আর প্রতিভা প্রভাবে
অভিভূত, কামাশক্ত জর্জরিত আমি
আমাকে
গ্রহণ করো, ধৌত করো তুমি
দুহাতে লুন্ঠন করো স্বর্গ সুধারে।
অর্জুন
সত্য কথা বলছি শুন ও হে সুরধনি
দিগ্বিদিক দিকপালেরা করুন শ্রবণ
কুন্তি,
মাদ্রি শচীর ন্যায় উর্বশীও মাতা
আমার
পরম গুরু পরম রক্ষনীয়
শুনেছি
সাধুর মুখে চিরন্তন বানী
মাতাই
প্রথম আলো স্নিগ্ধ চন্দ্রকলা
মাতাই
প্রথম গৃহ, প্রথম আশ্রয়
মাতা
ভিন্ন সন্তান সে অসহায় দীন
যে
মাতার স্তন্যসুধা আশীর্বাদ সম
আমারে
ঘিরিয়া রাখে স্নেহের বন্ধনে
মূল্যহীন স্বর্গসুধা সে সুধার কাছে
মাতাই
মর্তলোকের মূর্ত মূলাধার।
উর্বশী
আমার গুরু, পরম পুজনীয়া
তাঁর
কাছে পেতে চাই মাতৃ স্নেহ কনা
ঘৃণা
করি এ হেন যৌনদাসী প্রথা
ঘৃণা করি অশিষ্ট এ অনঙ্গ বাসনা
ঘৃণা
করি যূথবদ্ধ ব্যাভিচার নীতি
ঘৃণা
করি বর্বরোচিত এই অজাচার
মাতার
বন্ধন ছিড়ে স্বর্গ উর্বশীরে
পারব
দানিতে আমি নিজের পৌরুষ
নতশিরে আমি তাঁকে প্রনিপাত করি
শান্তচিত্তে
স্বস্থানে করুন প্রস্থান
উর্বশী
হে অর্জুন, হে কৌন্তেয়, হে ধনুর্ধারী
অনঙ্গ
মদনবাণে প্রপীড়িতা আমি
ত্রিদশাধিপতি
ইন্দ্রের ঈপ্সিত আজ্ঞায়
অভিসারিকা আমি তোমার আশায়
কী
লাভ পুরুষত্বে বল, কী লাভ ধরায়
যে অক্ষম এক নারীর পুরাতে বাসনা
কেমন
সে পুরুষত্ব কেমন পৌরুষ
অভিসারিকা
নারীকে যে আশাহত করে
ক্লীব
তুমি, ভীরু তুমি, তুমি কাপুরুষ
স্ত্রীগণ
মধ্যে থেকেও হবে নপুংসক
মানহীন,
বীর্যহীন ষণ্ডের জীবন
বৃহন্নলারূপে
করো বর্ষ যাপন
অর্জুন
দাও
যত অভিশাপ ও হে বরাননে
মাতার সম্ভ্রম যেন থাকে অবিচল
কিছুতে ভুলিনা যেন মর্তলোক সুধা
মর্তনীতি,
মর্তস্মৃতি, মর্তপ্রীতি যত
মায়ের নিভৃত কোল স্নেহঘন ছায়া
আমার
মাতৃভূমি স্বর্গ থেকে দামী
চাইনা স্বর্গসুধা
অনঙ্গ বাসনা
চাইনা
ভাসাতে দেহ বিলাস ব্যাসনে
প্রণিপাত
করি মাতা করো প্রস্থান
অভিশপ্ত
অর্জুন রবে বিস্মিতের দলে।
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteবিস্মিত হতে হয় এই ভেবে যে এজন্যই কি মানুষ স্বর্গে যেতে চায়, কোনো সম্পর্কের বাধাহীনতার মধ্যে অবাধ যৌনাচারের আশায়? হায়!মহাকাব্যিক ভাষাপ্রয়োগের মাধ্যমে সত্যিই এক অনবদ্য সাহিত্য সৃষ্ট হয়েছে। এমন কবি-প্রতিভার পূর্ণ প্রকাশ আমরা দেখতে চাই।
ReplyDelete