( হালখাতার নেপথ্যে রয়েছে চড়ক, বানফোড়, কাটাঝাঁপ, বটিঝাঁপ এবং রাজতন্ত্র এবং জমিদারতন্ত্রের ভয়ঙ্কর নির্যাতন। এটি কাছাখোলা আত্তবিস্মৃত বাঙালীর হুজুগে হুল্লোড়)
শরদিন্দু বিশ্বাস, গড়িয়া, কোলকাতা- ৭০০০৮৪
একালের গবেষকেরা, বঙ্গাব্দ এবং বাঙলার নববর্ষ নিয়ে প্রশ্ন তুলতেই পরস্পর বিরোধী উত্তর নিয়ে হাজির হচ্ছে দুটি যুযুধান পক্ষ। এরা কেউ মুঘল বাদশা আকবরের পক্ষে অন্য দলটি গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের পক্ষে। এই দুটি পক্ষ যে যে যুক্তি উপস্থাপন করছেন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার বিশ্লেষণ করে অবিলম্বে একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি। আমরা এটাও মনে করছি যে এই দুটি সূত্রের মধ্যে যদি ইতিহাসের গোঁজামিল থাকে তবে অবিলম্বে এই ভ্রান্ত প্রচার বন্ধ করে বাঙ্গালীর সুপ্রাচীন ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিলের ভিত্তিতে একটি স্মরণীয় দিবসকে ভিত্তিবর্ষ ধরে বঙ্গাব্দ নির্ণীত হোক এবং তাতে সরকারী শিলমোহর পড়ুক।
আকরব বাদশার পক্ষে যে সমস্ত যুক্তিগুলি তুলে ধরা হচ্ছে সেগুলির দিকে একজন গবেষকের দৃষ্টিকোন নিয়ে তাকালে দেখা যায় যে, মুঘলরা প্রথমে হিজিরি ক্যালেন্ডার অনুসারে খাজনা আদায় করতেন। হিজিরা বর্ষপঞ্জির মাসগুলি যথাক্রমে, মুহাররম, সফর, রবি অল-আওয়াল, রবি অল-থানি, জুম্মাদা অল-আওয়াল, জুম্মাদা অল-থানি, রজব, শাবন, রমদান বা রমজান, সায়াল, দু অল-কাদা এবং দু অল- জিজ্জা। হিজিরি বর্ষপঞ্জির মতে “দু আল-হিজ্জা” হল বছরের শেষ মাস। যে মাসটি ঋন পরিশোধের মাস, মুক্তির এবং উৎসর্গ করার মাস হিসেবে বিবেচিত। প্রচলিত এই ধর্ম বিশ্বাসকে মান্যতা দিয়ে মুঘলেরা “দু আল-হিজ্জা”তে বকেয়া সমস্ত খাজনা পরিশোধ করার রীতিটি চালিয়ে যান।
“হিস্টোরিক্যাল ডিকশনারি অফ দি বেঙ্গালিস” গ্রন্থে কুনাল চক্রবর্তী এবং সুভ্রা চক্রবর্তী লিখেছেন যে, “যেহেতু এই হিজিরি ক্যালেন্ডার চন্দ্রমাস ধরে গণনা করা হয় তাই ভারতীয় পারম্পরিক মাস গণনার সাথে এর গরমিল বাঁধে। দু আল-হিজ্জা আর কৃষিজাত ফসল ঘরে তোলার মরসুমের সাথে গরমিল থাকার জন্য কৃষি নির্ভর মানুষদের খাজনা বকেয়া পড়ে যায়। খাজনা পরিশোধ না করার জন্য ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হতে হয় জনগণকে”।
এদিকে খাজনা আদায় না হলে রাজকোষে টান পড়বে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য আকবর বাদশা কৃষি মরসুমকে প্রাধান্য দিয়ে বর্ষপঞ্জী সংস্কারের জন্য আদেশ করেন। ফতেউল্লা সিরাজি নামে এক বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী বাংলা বর্ষপঞ্জিকে সংস্কার করে হিজরি চন্দ্রসন এবং হিন্দু সূর্যসনের সমন্বয়ে ১৫৮৪ সালের ১০/১১ মার্চে “নতুন ফসলি সন” এর প্রবর্তন করেন। ঘোষণা করা হয় যে আকবর বাদশার সিংহাসনে আরোহণের বছর ১৫৫৬ সাল থেকে এই ফসলি সন গোনা হবে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এই গণনা শুরু হয়েছিল ১৫৫৬ সালের ৫ নভেম্বর থেকে। এই কাহিনীতে আরো বলা হয় যে নতুন ফসলি সন কালক্রমে বঙ্গাব্দ বা বাংলা নববর্ষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ঘোষণা করা হয় যে গ্রামে, গঞ্জে, শহরে বণিকেরা এবং বানিয়ারা তাদের পুরানো খাতা বন্ধ করে “হালখাতা” চালু করবেন এবং চৈত্র সংক্রান্তির আগেই সাধারণ কৃষকেরা তাদের বকেয়া খাজনা পরিশোধ করে বনিক এবং বানিয়াদের বিতরিত মিঠাই গ্রহণ করে পহেলা বৈশাখ এর আনন্দে মেতে উঠবেন! (পহেলা বৈশাখ/বাংলাপিডিয়া/বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ)
আকবর তাঁর প্রচলিত ধর্ম “দীন-এ-ইলাহি” এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দে “তারিখ-এ-ইলাহি” বা ঈশ্বরের বর্ষপঞ্জী নামে একটি ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেছিলেন তাঁর সমর্থন পাওয়া যায় প্রফেসর অমর্ত্য সেনের লেখা “দি আরগুমেন্টাটিভ ইন্ডিয়ান” গ্রন্থে। (Amrtya Sen/The Argumentative Indian/319)
প্রশ্ন উঠতে পারে আকবর বাদশার সিংহাসনে আরোহণের দিন অর্থাৎ ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে যদি বঙ্গাব্দ শুরু হয় তবে ২০২২ খ্রীস্টাব্দের “পহেলা বৈশাক” হবে ৪৬৬ বঙ্গাব্দ। তবে কেন ২০২২ খ্রিস্টাব্দের পহেলা বৈশাখকে ১৪২৯ বঙ্গাব্দ বলা হচ্ছে?
এই প্রশ্নের উত্তরে জানা যায় যে, এই দিনেই হজরত মহম্মদ কুরাইশদের অত্যাচারে জন্মভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় গিয়ে আশ্রয় নেন। এই ঘটনা আরবি ভাষায় “হিজিরা” নামে পরিচিত। হিজিরা কথা অর্থ হল অভিবাসন যা মূল লেটিন শব্দ “হেগিরা” থেকে উৎপত্তি। কথিত আছে যে, হজরত মহম্মদ তাঁর সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিচারধারাকে সুগঠিত এবং সংগঠিত করার জন্য স্থানীয় জাতিসমূহকে নিয়ে “মুসলমান সমাজ” নামে একটি নতুন সমাজ গড়ে তোলেন এবং হিজিরাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের আদলে একটি “ইসলামিক ক্যালেন্ডার” প্রকাশ করেন এবং “মুসলিম আমল” এর সূচনা করেন।
এই “হিজিরা” এর ৯৬৩ বছর পর আকবর সিংহাসনে বসেন। অর্থাৎ আজ থেকে ৪৬৬ বছর আগে ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে আকবর সিংহাসনে বসেন এবং সেটি ছিল ৯৬৩ হিজিরি। এই হিজিরি ৯৬৩ এবং ৪৬৬ মিলে হয় ১৪২৯ সন। অর্থাৎ আকবর বাদশা হজরত মহাম্মদের প্রবর্তিত ইসলামিক ক্যালেন্ডারের পরম্পরা ধরে বাংলা পহেলা বৈশাখে যে “তারিক এ-ইলাহি” বা “ফসলি সন” প্রবর্তন করেছিলেন তা একদিকে ছিল “অর্থনৈতিক বর্ষপঞ্জী” অন্যদিকে “হিজিরি সন”। কালক্রমে আবেগপ্রবণ হুজুকে বাঙ্গালীরা এটিকে বাংলার নববর্ষে রূপান্তরিত করে বঙ্গাব্দের সাথে যুক্ত করে দেন।
বঙ্গাব্দ প্রতিষ্ঠার দ্বিতীয় কাহিনীটি গড়ে উঠেছে গৌড়ের রাজা শশাংককে নিয়ে।
ইদানিং অনেকে দাবী করছেন যে, বঙ্গাব্দ প্রচলন করার মূল কারিগর হলেন গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক। তিনি নাকি ফসল ঘরে তোলার মরসুমকে প্রাধান্য দিয়ে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের ৫৯৪ খৃষ্টাব্দে ১লা বৈশাখকে নতুন বছরের স্বীকৃতি দিয়ে বঙ্গাব্দের সূচনা করেন। দুটি শিব মন্দিরে নাকি এই নিদর্শন পাওয়া গেছে।
এই প্রচার সামনে রেখে মাঠে নেমে পড়েছে সংঘ পরিবার। তাঁরা দাবী করেছেন যে ‘‘ষষ্ঠ শতকের শেষ দশকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সামন্ত রাজা এবং পরে স্বাধীন সার্বভৌম গৌড়ের শাসক শশাঙ্ক নিজের শাসনকালের সূচনাকে স্মরণীয় করে রাখতে সূর্যসিদ্ধান্ত ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি বঙ্গাব্দের সূচনা করেন। তিনি ‘পহেলা’ বৈশাখকে “নববর্ষ” হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং “হাল খতা” চালু করেন। সংঘ পরিবারের এই দাবীর পক্ষে যে একটি রাজনৈতিক অভিসন্ধি লুকিয়ে আছে তা পরিষ্কার। তাঁরা আকবরের বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়াশীল ভাষ্য তৈরি করতে গিয়ে খেয়াল করতে পারেনি যে “পহেলা” এবং “হালখাতা” শব্দ দুটিই আরবি শব্দ। “নববর্ষ” শব্দটিতে সংস্কৃতায়ণ ঘটেছে। তাছাড়া তাদের দাবী অনুসারে শশাঙ্কের গৌড়াধিপতি হবার সময় কালও মেলেনা। নীহাররঞ্জন রায়, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সেন প্রমুখ গবেষকেরা শশাংকের কাল ৬০৬-৭ এর কোন এক সময় বলে অনুমান করেছেন। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সামনে এনে বাংলার ভূমি সন্তানেরা মনে করছেন যে, সংঘ পরিবারের এই দাবীর পক্ষে কোন বাস্তবতা নেই। তাঁরা সম্রাট আকবরের মত শশাঙ্ককেও বহিরাগত দখলদার বলে মনে করছেন এবং বিশেষত শশাঙ্ককে বাংলার শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংসকারী বাঙ্গালী বিদ্বেষী রাজা হিসেবে বিবেচিত করছেন।
শশাঙ্ক সম্পর্কে বিস্তারিত জানার যে চারটি সূত্র আছে তা হলঃ ১) বানভট্টের লেখা হর্ষচরিত ২) হিউএন সাং এর বিবরণী ৩) মঞ্জুশ্রীমূলকল্প এবং ৪) কিছু পট্টোলী।
শশাঙ্কের পরিচয় নিয়ে ঐতিহাসি নিহাররঞ্জন রায় তাঁর “বাঙ্গালীর ইতিহাস” আদিপর্বে লিখেছেন, সম্ভবত, শশাঙ্ক গুপ্তরাজাদের সামন্ত ছিলেন। ৬০৬-৭ এর কোন এক সময়ে তিনি গৌড়ের স্বাধীন রাজা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান এবং মুর্শিদাবাদের রাঙামাটির নিকট কানসোনা বা কর্ণসুবর্ণতে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। ( নীহাররঞ্জন রায়/বাঙ্গালীর ইতিহাস/আদিপর্ব/৩৬৮)
দীনেশ্চন্দ্র সেন তাঁর “বৃহৎ বঙ্গ” গ্রন্থে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে উল্লেখ করে বলেছেন যে, শশাঙ্ক ছিলেন গুপ্ত রাজাদের বংশধর। ইনি রাঙামাটির সামন্ত ছিলেন। কালক্রমে গৌড়, রাঢ়, তাম্রলিপ্ত থেকে শুরু করে সমস্ত বঙ্গদেশে তার রাজ্য বিস্তৃত হয়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটঃ
এই সময় মৌখরী ও গুপ্তদের সাথে কয়েক পুরুষ ধরে যুদ্ধ চলতে থাকে। গৌড় ও মগধের অধিকার বজায় রাখাই এই দীর্ঘ দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ। গ্রহবর্মা থানেশ্বর রাজ প্রভাকরবর্ধনের কন্যা এবং রাজ্যবর্ধন–হর্ষবর্ধনের ভগিনী রাজ্যশ্রীকে বিবাহ করেন। দেবগুপ্ত মৌখরীরাজ গ্রহবর্মার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আগ্রসর হলে শশাঙ্ক দেবগুপ্তের পক্ষে যোগদান করেন। এই যুদ্ধে শশাঙ্ক এবং দেবগুপ্ত গ্রহবর্মাকে হত্যা করেন এবং রানী রাজ্যশ্রীকে বন্দী করে কনৌজে নিয়ে আসেন। দেবগুপ্ত এরপর থানেশ্বরের দিকে অগ্রসর হলে রাজ্যবর্ধন তাকে পরাজিত ও নিহত করেন। রাজ্যবর্ধন নিজ ভগিনীর শৃঙ্খল মোচনের জন্য কনৌজের দিকে অগ্রসর হলে শশাঙ্ক তাকে বাঁধা দেন।
শশাঙ্ক তার সাথে মধুর ব্যবহার করে মনের সমস্ত সন্দেহ দূর করে গৌড়ে নিমন্ত্রণ করে পাঠান এবং রাজধানীতে নিয়ে এসে নিরস্ত্র অবস্থায় গোপনে হত্যা করেন। সাময়িক ভাবে কনৌজের দখল আসে শশাঙ্কের হাতে। স্বল্পকালীন সময়ের মধ্যেই তিনি বঙ্গদেশকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত সমস্ত সৌধগুলি ধ্বংস করতে শুরু করেন। বানভট্টের হর্ষচরিত, হিউ–এন-সাং এর বিবরণী এবং সমকালীন গ্রন্থ মঞ্জুশ্রীমুলকল্পে শশাঙ্কের এই বিদ্বেষ কাহিনীর সমস্ত ঘটনা লিখিত আছে। হিউ–এন-সাং এর বিবরণী থেকে পাওয়া যায় যে, রাজা শশাঙ্ক কুশীনগরের বুদ্ধ বিহার থেকে সমস্ত ভিক্ষুদের বের করে দিয়ে ছিলেন। বুদ্ধের পদচিহ্ন অঙ্কিত পবিত্র পাথর গঙ্গার জলে নিক্ষেপ করেছিলেন। জিঘাংসায় উন্মত্ত হয়ে বুদ্ধগয়ার বোধিবৃক্ষকে সমূলে উৎপাটন করে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন এবং বুদ্ধের মূর্তিকে ধ্বংস করে সেখানে শিবের মূর্তি স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এই গ্রন্থগুলিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, বুদ্ধ বিহার গুলি ধ্বংস করার পর শশাঙ্ক আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েন। বিশেষত হর্ষবর্ধন থানেশ্বররাজ হিসেব অভিষিক্ত হলে এই আতঙ্ক এক বিভীষিকায় পরিণত হয়। হর্ষবর্ধন তাকে ‘গৌড়ভুজঙ্গ’ নামে অভিহিত করেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, ‘যে পর্যন্ত এই গৌড়াধিপ শশাঙ্ককে আমি হত্যা না করিতে পারিব, সে পর্যন্ত আহার বিষয়ে দক্ষিণ হস্তের ব্যবহার করিব না’ (দীনেশ চন্দ্র সেন/বৃহৎ বঙ্গ/ ২২০)। কথিত আছে যে, এই কালান্তক ঘোষণায় ভীত হয়ে শশাঙ্ক রাজ্যশ্রীর বন্ধনমুক্ত করেন। হর্ষবর্ধন কনৌজ মুক্ত করার পর রাজ্য বর্ধনের হত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য গৌড়ের দিকে অভিযান শুরু করেন। শুর হয় দীর্ঘ কালীন যুদ্ধ। শশাঙ্কের রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। খাদযুক্ত স্বর্ণমুদ্রা মুদ্রা প্রচলন করেও তিনি রাজস্বের ঘাটতি আটকাতে অসক্ষম হন। পরিশেষে হতাশা, আতঙ্ক, পরাজয়ের গ্লানি ও রোগভোগে তিনি মারা যান।
শশাঙ্ক শৈব ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রবুদ্ধ বাংলার সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করেন। অনেক বৌদ্ধ বিহার দখল করে বুদ্ধ মূর্তির উপরে ত্রিশূল গুজে দিয়ে তা শিব মন্দিরে রূপান্তরিত করেন। বাঙলার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির নিদর্শনগুলিকে গুড়িয়ে দেন। দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ চালাতে গিয়ে বুদ্ধ শ্রমণ এবং সাধারণ মানুষের উপর চড়া হারে খাজনা ধার্য করেন। খাজনা না দিতে পারলে চলে চরম শারীরিক নির্যাতন। গাজন সন্যাসী এবং চড়ক মেলা এবং বড়শীতে বিদ্ধ করে চরকির মত ঘোরানোর এই অমানবিক সংস্কৃতি শুরু হয় শশাঙ্কের সময় থেকেই। বানভট্ট, হিউএনসাং, শশাংককে দুষ্কর্মকারী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। মঞ্জুশ্রীমূলকল্পতে তাকে ধ্বংসকারী বলা হয়েছে। এই তিনটি সূত্রের কোথাও শশাঙ্ককে বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠাতা বলে উল্লেখ করা হয়নি। শশাঙ্কের কোন পট্টলিতে বঙ্গাব্দ প্রতিষ্ঠার কোন উল্লেখ নেই।
শশাংক এবং আকবরের এই বঙ্গাব্দ প্রতিষ্ঠার দাবী নানা কারণে ভুলে ভরাঃ
প্রথমত, চৈত্রমাস ফসল ঘরে তোলার মাস নয়। বাংলায় আউস ধান আসে আষাঢ়/শ্রাবন মাসে। ভাদ্র এবং আশ্বিন মাসে বাঙলার বিখ্যাত রান্না পূজা এবং গাসি পালিত হয়। দিঘা ধান ওঠে অঘ্রান মাসে। তিন মুঠি ধানের আগ বা আঘন কেটে এনে চাষিরা সেটিকে বীজ হিসেবে ঘরের মটকায় বেঁধে রাখেন। এই সময় পালিত হয় বাঙলার বিখ্যাত পরব নবান্ন।
দ্বিতীয়ত, শশাংকের সময় বঙ্গের পাঁচটি বিভাগ ছিল। এগুলি হল কজঙ্গল, পুন্ড্রবর্ধন, কর্ণসুবর্ণ, তাম্রলিপ্ত এবং সমতট। এই গোটা বঙ্গের উপর শশাঙ্কের অধিকার ছিলনা।
তৃতীয়ত, শশাঙ্ক ছিলেন গুপ্তদের সামন্ত। তাঁর আমলে কোন ধরনের বাংলা ভাষার চর্চা ছিলনা। শশাঙ্কের সমস্ত পট্টলি সংস্কৃত ভাষায় রচিত।
চতুর্থত, তিনি ছিলেন চরম বাঙ্গালি বিদ্বেষী। এরকম একজন বাঙ্গালি বিদ্বেষী রাজা বঙ্গাব্দ প্রতিষ্ঠা করবেন, এই দাবীর পক্ষে কোন বাস্তবতা নেই।
পঞ্চমত, আকবরের “ফসলী সন” বঙ্গাব্দ নয়। এটি একটি অর্থনৈতিক বর্ষপঞ্জী।
ষষ্ঠত, যে নীতি বা নির্দেশিকায় খাজনা দিতে না পারা সাধারণ মানুষকে ১ মাস অনাহারে বা অর্ধাহারে রেখে ভিক্ষাবৃত্তিতে বাধ্য করানো হত, গলায় জুতার মালা পরিয়ে পাড়ায় পাড়ায় ঘরানো হত, কাটায় ঝাঁপ, বটিতে ঝাঁপ দেওয়ানো হত, গায়ে বড়শি বিদ্ধ করে চরকির মত ঘোরানো হত তা নৃশংসতম বর্বরতা। শাসন, শোষণ এবং গোলামীর শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে, কৃষিজীবী, খেঁটে খাওয়া মানুষকে পশুর মত জীবনযাপনে বাধ্য করে রাজা, জমিদার, বনিক এবং ব্যবসায়ীদের এই হাল খাতা বাঙলার নববর্ষ হতে পারেনা।
চন্ডাল সমাজের হুলোই গানে (উলোই গান) নৃশংস ভাবে এই খাজনা আদায়ের চিত্রটি ধরা হয়েছে।
“হুলোই” একটি ব্রতচারী গান। দলবদ্ধ ভাবে এই গান গাওয়া হয়।
বিরূপ প্রকৃতির বিরুদ্ধে মানুষের জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া এবং সুখসমৃদ্ধিশালী সমাজ
গড়ে তোলার বিজয়বার্তা নিয়ে তাগড়া জোয়ান ১০-১২ জনের এক একটি দল গ্রামে গ্রামে, গৃহস্তের আঙিনায় আঙিনায় বিজয় গাঁথা, সুখদুঃখের কাহিনী এবং সমকালীন সামাজিক সমাচার গেয়ে বেড়ায়। হুলোই দলের প্রত্যেক সদস্যের হাতে থাকে মাথা সমান উঁচু বাঁশের লাঠি। মাথায় গামছা বাঁধা পাগড়ি। পৌষ মাসের শুরু থেকে একেবারে সংক্রান্তি পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের গানের ডালি সাজিয়ে, অভয় দেবার জন্য বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে ফেরে এই ব্রতচারী দলটি।
"বাস্তের বর
ধানে-চালে গোলা ভর
এ ঘর ভরে ও ঘর ভর" ...
শরীর দুলিয়ে, ডান’পা, বা’পা নাচিয়ে’ লাঠি দিয়ে মাটিতে তাল ঠুকে সুরু হয় “হুলোই’ গান। দেশের বর্তমান হালচালের বার্তা পাওয়া যায় গানের বাণীতে। পাওয়া যায় প্রাচীন ইতিহাসের সন্ধান।
খাজনা আদায় জনিত অত্যাচারের গানঃ
ওরে, শুন সবে ভক্তি ভাবে করি নিবেদন।
ওরে, নলডাঙ্গার ঐ রাজার কথা শুনো দিয়া মন।।
ওরে, নলডাঙ্গার ঐ রাজার ছিল বহু জমিদারী।
ওরে, সোনা দিয়া বান্ধছে রাজা নলডাঙ্গার কাচারি।।
ওরে, ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছেন রাজা মাথা বান্ধা শাড়ি।
ওরে, সে শাড়িখান উড়ায় নিল চন্দ্রদাসের বাড়ি।।
ওরে, চন্দ্রদাস ও চন্দ্রদাসী বসে ভাবছ কি?
ওরে, তোমার ছেলে মার খেয়েছে সভার মধ্যি।।
ওরে, লাথি মারে, জুতা মারে, পিঠমোড়ায় বান্ধিয়া।
ওরে, ৫০ঘা চাবুকের বাড়ি মারে রইয়া রইয়া।।
ওরে, আর মেরো না আর মেরো না দন্ড হল ভারি।
ওরে, কাল সকালে দিয়া যাব তোমার খাজনার কড়ি।।
(Food Tradition of Chandal Community/ FOOD POWER/Saradindu Biswas/SAGE/298)
রামাই পণ্ডিতের শূন্যপুরাণের সূত্র ধরে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় স্বীকার করেছেন যে, এই চড়ক, আগুন ঝাঁপ, ছুরির উপর ঝাঁপ, বাণফোঁড়, শিবের বিয়ে, আগুন নিয়ে নাচ, বারানো বা হাজরা পূজা( শ্মশানে অনুষ্ঠিত হয়), পশুবলি, নরবলী তুর্কী-বিজয়ের আগে সেন আমলের অবদান। সেন আমল থেকেই এই নিষ্ঠুর প্রথা বাংলার সংস্কৃতিতে আরোপিত হতে থাকে এবং একটি বাৎসরিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়।
কিন্তু বঙ্গাব্দ মনে করে যে বর্ষপঞ্জী গোনা হচ্ছে তা বঙ্গদেশের সুপ্রাচীন ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত নয়। এই বর্ষপঞ্জী অত্যন্ত অর্বাচীন। এটি পরিষ্কার অর্থে হিজিরি সন এবং একটি ইসলামী বর্ষপঞ্জী।
তাই বাংলা নববর্ষের প্রবর্তক হিসেবে শশাঙ্ক এবং আকবরের এই ভিত্তিহীন দাবীকে আমরা ভারতের আদিবাসী-মূলনিবাসী জনগণের পক্ষ থেকে খারিজ করে দিচ্ছি।
আর একটি সূত্র থেকে দেখতে পাচ্ছি যে, ১৯৫২ সালে ভারত সরকার বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহাকে পঞ্জিকা সংস্কারের দায়িত্ব দেন। তিনি শকাব্দকে সংস্কার করে ১৪ই এপ্রিলকে বাংলা নববর্ষ পালন করার পরামর্শ দিয়ে ছিলেন। বাংলাদেশে ১৪ই এপ্রিলে নববর্ষ পালিত হলেও পশ্চিমবঙ্গে ১৫ই এপ্রিলে নববর্ষ পালিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম ২৫শে বৈশাখ। বৈশাখ মাসটি তাঁর কাছে আবির্ভাবের কাল। একাধিক গানে তিনি বৈশাখকে নববর্ষ হিসেবে স্বাগত জানিয়েছেন। এতদসত্ত্বেও বৈশাখ কোন ভাবেই জনপুঞ্জের কাছে উৎসবের মাস নয়। চৈত্র এবং বৈশাখ দুটি মাসই রুক্ষ, শুষ্ক ঝিম মেরে টিকে থাকার মাস। চড়ক, গাজন, নীল নামে যে ধর্মীয় অনুশাসন জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় তা রাজা, জমিদার বা সামন্তদের দ্বারা পরিচালিত হত। বাঙলার প্রবহমান সংস্কৃতির সাথে এর কোন যোগ নেই। পহেলা বৈশাখ সুলতান, রাজা, জমিদার, বনিক, বানিয়া, সামন্ত, আড়ৎদার বা সুদখোর মহাজনদের পুরানো খাতা বন্ধ করে হালখাতার মিঠাই বন্টনের উৎসব হতে পারে, জমি, জায়গা, সোনা, দানা বন্ধক রেখে কৃষক, শ্রমিক, প্রান্তিক মানুষের ঋণ পরিশোধের অর্থনৈতিক বর্ষ হতে পারে বঙ্গাব্দ হয়ে ওঠার মত কোন ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এর নেই।
বঙ্গাব্দ সূচীত হবার প থে সব থেকে জোরাল দাবী রাখে আদিবাসী-মূলনিবাসী সন্তান বিজয় সিংহের লংকা বিজয়ঃ
“বাঘের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া আমরা বাঁচিয়া আছি,
আমরা হেলায় নাগেরে খেলাই, নাগেরি মাথায় নাচি।
আমাদের সেনা যুদ্ধ করেছে সজ্জিত চতুরঙ্গে,
দশাননজয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে।
আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়
সিংহল নামে রেখে গেছে নিজ শৌর্যের পরিচয়।
একহাতে মোরা মগের রুখেছি, মোগলের আর হাতে,
চাঁদ-প্রতাপের হুকুমে হঠিতে হয়েছে দিল্লীনাথে”।
(সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত/আমরা/কাব্য-সঞ্চয়ন/৪০)
সিংহলে প্রাপ্ত প্রাচীন পালিগ্রন্থ দ্বীপবংশম, কুলবংশম এবং মহাবংশম অনুসারে দেখা যায় যে বোঙ্গা দিশমের সন্তান বিজয় সিংহ অত্যন্ত উশৃঙ্খল ছিলেন। প্রজাগণ বিজয়ের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বঙ্গাধিপ সিংহবাহুকে নালিশ জানান। রাজা বিজয়কে নির্বাসন দন্ড দেবার কথা ঘোষণা করেন। রাজা আদেশ করেন যে, এই বালকের সমস্ত দাস, দাসী, মজুর, সহচর এবং তাদের স্ত্রীগণ কেউ যেন এই দেশে না থাকে। এরা অলস, এবং উশৃঙ্খল। এরা দুরাচারী এবং দুর্বৃত্ত। জাহাজে ভাসতে ভাসতে এরা যে দিকে ইচ্ছা চলে যাক।
“বিজয় জাহাজ নিয়ে রওনা হলেই ঝটিকা তাড়িত হয়ে পড়ে। তাঁর জাহাজের যন্ত্রাংশ বিকল হয়ে যায়। পথ হারিয়ে ফেলে তাঁরা ঝটিকা তাড়িত হয়ে প্রথমে সোপর, নগগদ্বীপ এবং পরে দক্ষিণমুখে বাহিত হয়ে লঙ্কায় উপস্থিত হয়। তাম্রপর্ণী নামক এক স্থানে তিনি জাহাজ থেকে অবতীর্ণ হন। দীনেশ চন্দ্র সেন তাঁর বৃহৎ বঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে, বিজয় সিংহ যেদিন লঙ্কায় উপনীত হলেন সেদিন ভগবান বুদ্ধ মহাপরিনিব্বানের জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। বিজয় সিংহ স্থানীয় যক্ষদের পরাজিত করে নিজের বংশের বিজয় পতাকা উড়িয়ে দিয়ে এই দেশের নাম রাখেন সিংহল।( দীনেশ চন্দ্র সেন/বৃহৎ বঙ্গ /৭৫)
রাজ্য অভিষেকের সময় তিনি মাদুরাই এর রাজা পাণ্ডু রাজার কন্যাকে বিবাহ করে প্রাচীন শাদীয় উৎসবের দিনে বিজয় উৎসব পালন করেন। মাদুরাইয়ের রাজা বিপুল পরিমাণে বহুমূল্য দ্রব্য, হাতি, ঘোড়া, লোকলস্কর সহ প্রচুর উপঢৌকন পাঠিয়ে দেন। তিনি বিজয়ের অনুগামীরদের জন্যও কয়েক শত কন্যা দান করেন। (নিঃশঙ্ক মল্লের লিপি, “Epigraphica Zeylanica, Vol. II”)
বঙ্গাধিপ সিংহবাহুর সন্তান রাজকুমার বিজয় সিংহের এই লঙ্কা বিজয়ের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস এখনো ভারতের মহারাষ্ট্র রাজ্যের অজন্তা, ইলোরা গুহায় অসংখ্য চিত্র এবং ভাস্কর্যের মধ্যে ভাস্বর হয়ে আছে। কত সহস্র বৌদ্ধ ভিক্ষু, কারিগর, খোদাইকর, শিল্পী, ভাস্কর ছেনী, হাতুড়ি, রং, তুলি নিয়ে, কত বছর ধরে এই বিস্ময়কর শিল্পকলা রূপায়ন করেছেন ভাবলে সত্যি অবাক হতে হয়।
গোতমা বুদ্ধের মহাপরিনিব্বান ঘটে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৮৩ সালে। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি স্মরণীয় দিবস। আর এই দিনেই বঙ্গাধিপ সিংহবাহুর সন্তান রাজকুমার বিজয় সিংহ লঙ্কায় অবতরণ করে বাংলার বিজয় কেতন উড়িয়ে দেন।
লোহা আবিষ্কারের পূর্বেই বাংলার সওদাগরেরা বেতে বাঁধা নৌকায় চড়ে ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের ফেনিল জল্ধিকে পরাভূত করে নানা দেশে ব্যবসা করতে যেতেন। সেকালে মিশর, রোম, ফিনিশিয় বিত্তশালী বনিকদের মতোই তাঁরা বানিজ্য বিস্তারে সমমর্যাদা ও ক্ষমতাসম্পন্ন ছিলেন। আর্যরা যখন মধ্য-এশিয়া থেকে পাঞ্জাবে এসে উপস্থিত হয়, তখন ‘সপ্তডিঙ্গা মধুকর’ সমৃদ্ধ বাংলার বনিকেরা সমুদ্রের বন্দরে বন্দরে সুদৃশ্য পণ্যের পসরা সাজিয়ে বিদেশি ক্রেতাদের চিত্তবিনোদন করতেন। মিশর, রোমীয় বনিকেরা সেই সব পণ্য সংগ্রহ করে আরব সাগর ও নীলনদের মধ্য দিয়ে ভূমধ্য সাগরের পথে প্রেরণ করতেন। বাংলার বনিক এবং সওদাগরদের মধ্যে রোমাঞ্চকর ভ্রমণ এবং নতুন দেশ আবিস্কারের আবেগ ছিল প্রবল। (শরদিন্দু বিশ্বাস/সোনার দাঁড় পবনের বৈঠা/গণশক্তি/১৯৯৮)
বিজয় সিংহ বাংলার এই পরম্পরাকে মান্যতা দিয়ে সিংহল বিজয় করেন। রাজ্যাভিষেকের পরে তিনি যে পালি ভাষাকেই রাজ ভাষা হিসেবে মর্যাদা দিয়েছিলেন তা সেই সময়ে রচিত মহাবংশ, দ্বীপবংশ এবং কুলবংশ থেকে জানা যায়। বিজয় সিংহের সাতশত সৈন্য এবং দাসদাসী যে সংস্কৃতি এবং ভাষা নিজেদের সাথে বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন তা নিশ্চিত ভাবে সমকালীন বাংলা ভাষা। ভিন্সেন্ট স্মিথ, অধ্যাপক সহিদুল্লা এবং দীনেশ চন্দ্র সেনের মত গবেষকেরা সিংহলী এবং বাংলা ভাষার তুলনামূলক আলোচনা করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে বর্তমান কালের সিংহলী ভাষার সাথে বাংলা ভাষার নিকট সম্পর্ক রয়েছে। যেমন ভাবে ভারতের পশ্চিম প্রান্তে গুজরাটি এবং মারাঠি ভাষার সাথেও বাংলা ভাষার নিকটতম সম্পর্ক বিদ্যমান। ঐতিহাসিক কালে বাঙ্গালীর এমন গর্বের অধ্যায়কে মান্যতা না দেবার কোন কারণ দেখিনে। আমরা মনে করি যে প্রামাণ্য বেশ কয়েকটি গ্রন্থ যখন এই স্মরণীয় ইতিহাসকে সাক্ষ্য প্রমান হিসেবে বিশ্বের দরবারে হাজির করেছে তখন খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৩ সাল বঙ্গাব্দের প্রতিষ্ঠা কাল হিসেবে ঘোষিত হওয়া বাঞ্ছনীয়।
জনপুঞ্জের পারম্পরিক সংস্কৃতির বিচারে ১লা মাঘই ভারতীয় নববর্ষ।
শ্রম এবং উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত মানুষের দৈনন্দিন জীবন যখন একটি স্বতন্ত্র রূপ পরিগ্রহ করে তখন অর্জিত অভিজ্ঞতাগুলি ঐতিহ্য মণ্ডিত হয়ে লোক সংস্কৃতির ভান্ডারে সঞ্চিত হয়। মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি জনগণের হৃদয়াবেগে জারিত হয়ে ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সার্বজনীন হয়ে ওঠে। বিবর্তনের পথে লড়াই, সংগ্রাম এবং টিকে থাকার অধীত জ্ঞানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানুষের পরম্পরা। আর এই পারম্পরিক জ্ঞানের বাচিক শিল্পই ভাষা। ভাষার মাধ্যমেই মূর্ত এবং বিমূর্ত চেতনাগুলি রুপময় হয়ে উঠেছে। যা অব্যক্ত ছিল তা ব্যক্ত হয়ে উঠেছে ভাষার মাধ্যমেই। প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ, সময়, কাল এবং ঋতুর সমন্বয়ে অভিজ্ঞতাগুলি ভাষার বর্ণমালায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে বার বার।
আমরা জানি যে, উত্তর থেকে দক্ষিণ ভারত জুড়ে পৌষ মাসই ফসল ঘরে তোলার মরসুম। এই সময় বার্ষিক গতি অনুসারে ২২শে ডিসেম্বর থেকে সূর্যের উত্তরায়ণ শুরু হয়। এই উত্তরায়ণ কালেই সারা ভারত জুড়ে পালিত হয় পৌষ পরব যা মকর সংক্রান্তি নামে পরিচিত। এই মকর পরবের সাথে সাঁওতাল আদিবাসীদে সাঁক্রাত ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। ভারতের আদিবাসী-মূলনিবাসী সমাজ পৌষ সংক্রান্তি শেষে মাঘ মাসকেই বছরের প্রথম মাস হিসেবে গণনা করে এসেছে। উত্তরবঙ্গ, পূর্ববঙ্গ এবং দক্ষিণ বঙ্গ জুড়ে জনপুঞ্জের লোকায়ত সংস্কৃতিতে যে বারোমাসিয়া সঙ্গীতটি পাওয়া যায় তা শুরু হয়েছে শীতকাল থেকে।
“শীত গেল বসন্তরে আইল
সামনে ফালগুণ মাস
বিরহিণীর মনের দুঃখ রে
জ্বলে বারো মাস”।
এক সময় গোটা বাংলা জুড়ে গরু রাখালী, হালুয়া, মৈসাল, মাহুত, খেয়া পারানীর মত পেশাগুলি বেশ প্রচলিত ছিল। ধানের বিনিময়ে একটি বাৎসরিক চুক্তির ভিত্তিতে চলত এই পেশাগুলি। ১লা মাঘ থেকে পৌষ পার্বণ পর্যন্ত এই চুক্তি সাধিত হত যাতে বছর শেষে ধান নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারে রাখাল, হালুয়া, মৈসাল, মাহুত এবং মাঝি। এই ধানই ছিল পৌষ সংক্রান্তির মহার্ঘ সম্পদ। রাঢ়বঙ্গে যারা গরু, মোষ, ভেড়া চরায় তাঁদেরকে বাগাল বলে। নানা সাঁওতালী সঙ্গীতে (সেরেং) এবং ঝুমর গীতে আজো এই বাগাল খাটার করুণ কাহিনী ধ্বনিত হয়।
“পৌষ পরব হল বাসি
আর বাগালখাটা বাজে আসি
তিন মণ ধান দিলেক ছোট সেরে
মিনার মা, আর না থাকিব পরের ঘরে”।
অর্থাৎ পৌষপরব এবং ১লা মাঘ, জনগণের জীবনযাত্রার সঙ্গে এমন ভাবে সম্পৃক্ত ছিল যে তাতে যোগদান না করতে পারলে জীবনটাকে ব্যর্থ মনে হত। আজো ভারতের অধিকাংশ আদিবাসী-মূলনিবাসী জনগণ তাঁদের মাস গণনায় মাঘ মাসকেই প্রথম মাস হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। সাঁওতাল মাসগুলি নিম্নরূপঃ
মাঘ, ফাগুন, চৈত, বেসাক, ঝাইট, আসাড়, সান, ভাদর, দাসাঁয়, আঘন এবং পুস। সাঁওতাল সমাজ এখনো তাঁদের ভাষা, সংস্কৃতির সাথে এই বর্ষপঞ্জিটি ধরে রেখেছে।
গোটা ভারত জুড়ে বিভিন্ন নামে পালিত হয় মকর সংক্রান্তি। তামিলনাড়ুতে এঁকে বলা হয় পোঙ্গল, গুজরাটে উত্তরায়ণ, আসামে ভোগালি বা মাঘ বিহু, কর্ণাটকে মকর সংক্রান্ত , কাশ্মীরে সায়েন-ক্রাত। মকর সংক্রান্তিতে ভারতের বহু জায়গায় পালিত হয় মকর স্নান। গর্বের সাথে আমরা দাবী করতে পারি যে পূর্ব জনপদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান, হেতুবাদী দর্শনের প্রবক্তা কপিলের কর্মক্ষেত্র সাগরদ্বীপে বৎসরের শেষ উৎসব হিসেবে এই মকর স্নান পালিত হয়ে আসছে। শত ধারায় প্রবাহিত নদীগুলি গঙ্গার বেগবান ধারার সাথে মিলিত হয়ে এই খানে মিলে গেছে সাগরের সাথে। তাই এর আর এক নাম গঙ্গাসাগর। এই মোহনা আসলে পূর্ব জনপদের উপর দিয়ে প্রবাহিত নদীসমূহের সঙ্গম। সাগর সঙ্গম। এখানে গঙ্গা, যমুনা, রূপনারায়ন, বা কাঁসাই নদীর জলের আলাদা অস্তিত্ব নেই। সবাই যেন তাঁর ক্ষুদ্র পরিচয়ের অহংকার বিসর্জন দিয়ে বৃহতের সাথে একাত্ত হয়ে গেছে। সম্ভবত এটাই ছিল বাংলার আদি দর্শন এবং কপিলের শিক্ষা। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আগত স্নানযাত্রীদের ভীড় দেখে বঙ্গের এই সাম্যবাদী সংস্কৃতির গ্রহণযোগ্যতা সহজে অনুমিত হয়।
এই সময়ে বঙ্গজনের ঘরে ঘরে পিঠে পুলির ধুম লেগে যায়। সুগন্ধি চালের পায়েসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে চারদিক। খেজুরের রস। নলেন গুড়ের মিষ্টি সুবাস খাদ্য রসিকের রসনাকে আরো রসসিক্ত করে তোলে। দিগন্ত জোড়া সর্ষে ফুলের সোনালী ঝলকে উতলা হয়ে ওঠে মৌমাছির দল। মধু আর মননের মধু বিতরণে সেও আজ সমান অংশীদার। আত্তিয় স্বজনের মধ্যে গড়ে ওঠে অন্তরঙ্গ মেলবন্ধন। এক অনাবিল আনন্দের মুক্তধারায় স্নাত হয়ে বাংলার শ্যামল শোভন রূপটি আরো অপরূপা হয়ে ওঠে।
রাজা যায়, রাজা আসে। তাঁদের নীতি নির্ধারণের জন্য অর্থনৈতিক বৎসর পাল্টে যেতে পারে। জনগণ ধরে রাখে তাদের পরম্পরা।
“ওরা চিরকাল
টানে দাঁড়, ধরে থাকে হাল;
ওরা মাঠে মাঠে
বীজ বোনে, পাকা ধান কাটে।
ওরা কাজ করে
নগরে প্রান্তরে। ( রবীন্দ্রনাথ/ওরা কাজ করে/ আরোগ্য)
আজো সারা ভারতের আদিবাসী-মূলনিবাসীরা সযত্নে আগলে রেখেছে তাদের আবিষ্কৃত কর্ম ও ঘর্মের প্রবাহমান সংস্কৃতি। পৌষ সংক্রান্তি, সাক্রাত, মকর পরব, মকর সংক্রান্তি জনগণের ক্যালেন্ডার। তাই ১লা মাঘই পারম্পরিক ভাবে শুধু বাংলার নয় সমগ্র ভারতের নববর্ষ।