প্রসঙ্গ সাঁকরাতঃ
একটি সাঁওতালী লোককাহিনী
সেই ছোট্ট বেলার কথা মনে পড়ে। রাতে ঘুমাতে গেলেই দিদিমা এসে পাশে বসতেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে শুনাতেন চম্পক নগরের রাজ কন্যার কাহিনী। কুচবরণ কন্যার মেঘবরণ চুল। আকাশের মুখ ভার হলে সেই মেয়ে বারান্দায় এসে কৌটার মুখ খুলে দিয়ে ছড়িয়ে দিত সোনাঝরা রোদ্দুর! আকাশ হেসে উঠত। বাতাস খুশি হয়ে ফুলের সুগন্ধ ছড়িয়ে দিত। দিদিমার হাতের আলতো ছোঁয়ায় কখনো তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে পৌঁছে যেতাম নতুন দেশে। আবার কখনো শঙ্খমালা, কাঞ্চনমালার স্বপ্ন দেখতে দেখতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তাম। মূলত মা, ঠাকুরমা, দিদিমার মুখে এই রূপকথার গল্পগুলিই ছিল আমাদের কিশলয়ের প্রথম পাঠ। তাঁদের মুখ থেকেই শুনেছি নিষাদ, ব্যাধ, কিরাত, চন্ডাল রাজাদের গল্প। শুনেছি বহিরাগত দস্যুদের আক্রমণ এবং লুটতরাজের কাহিনী। শুনেছি কি ভাবে রাক্ষসীরা রূপবতী কন্যার বেশ ধারণ করে রাজপুরিতে ঢুকে পড়েছে। আর গভীর রাতে ঝোপে ঝাড়ে লুকিয়ে থাকা রাক্ষস, খোক্কসদের নিয়ে গবাদি পশু সহ সমস্ত মানুষকে ভক্ষণ করে রাজ্যকে শ্মশান ভূমিতে পরিণত করে দিয়েছে। শুনেছি বহিরাগত রাক্ষস, খোক্ষসেরা চম্পাবরণ কন্যাকে বন্দি করে রেখেছে রাজপ্রাসাদের কোন নিভৃত অন্তরালে। তাঁকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় রুপার কাঁঠির পরশে। সোনার কাঁঠির পরশ পেলে আবার সে জেগে ওঠে। রাজপুরির বিশাল দিঘির গভীর জলে একটি চোঙার মধ্যে লুকিয়ে আছে এই রাক্ষস, খোক্কশদের প্রাণ ভোমরা। সেই ভোমরাকে মারতে পারলেই রাক্ষস, খোক্কশ মারা পড়বে। বিদেশি নরখাদকদের হাত থেকে মুক্ত হবে জন্মভূমি। মা, ঠাকুরমা, দিদিমার এই কাহিনী আমাদের এমন উৎসাহিত করত যে, এই বিদেশী সর্বভুক রাক্ষস, খোক্কশদের প্রতিহত করার জন্য কাঠের তরোয়াল বানিয়ে, হাতে তীর ধনুক নিয়ে লালকমল, নীলকমল সেজে আমরা রাক্ষস, খোক্কশদের সাথে লড়াই করতাম এবং তাঁদের হত্যা করে রাজ্যবাসীকে অভয় দান করতাম।
আমাদের ছোটবেলার
শোনা এই কাহিনীগুলির মধ্যে যে একটি পারম্পরিক অভিজ্ঞান রয়েছে সে কথা বুঝতে পেরেছি অনেক
পরে। পালামৌ, হাজারিবাগ, রাঁচি, চাইবাসা, ময়ূরভঞ্জ, সরাইকেলা, সিংভূম, ধলভূম, মানভূম,
দুমকা, দেওঘর, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা, আসাম, মনিপুর এবং মেঘালয়ের আদিবাসীদের সাথে
নিবিড় ভাবে কাজের সূত্রে বুঝতে পেরেছি যে, বৈদেশিক আক্রমণ, নারীকে বন্দি করা, লুন্ঠন
করা এবং নারীকে দিয়ে রাজাকে হত্যা করার এই কাহিনী জনপুঞ্জের প্রত্যেকটি গোষ্ঠীর লোককাহিনীর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। সাঁকরাত (সংস্কৃতে
সংক্রান্তি) বা মকর পরবের সাথে যে কাহিনীটি যুক্ত হয়ে আছে তা বর্ণনা করছি। এটি সাঁওতালী
জোম-সিম-বিন্তির একটি শাখা কাহিনী। কাহিনীটির নাম প্রথমে উল্লেখ করলে গল্পটির মাধুর্য
নষ্ট হবে বলেই নামকরণ করা থেকে বিরত থাকলাম।
চাইচাম্পাগড়।
ফুলে, ফলে পরিপূর্ণ বির বুরু। স্বচ্ছ সলিলা সাত নদীর দেশ। সুশীতল বাতাস। জনগণ ভালবেসে এর নাম রেখেছে “ইয়ায় নায়ে দিশম চাম্পা”।
চাম্পাগড়ের রাজা বীর যোদ্ধা। যেমনি সুগঠিত শরীর তেমনি তাঁর শৌর্য। দিকুরা
বারবার আক্রমণ করেও পর্যুদস্ত হয়েছে তাঁর হাতে। একটি নারীকেও লুন্ঠন করতে পারেনি তাঁরা।
সুশিক্ষিত সোরেন বাহিনী বীরের মত লড়াই করে দেশকে সুরক্ষিত রেখেছেন।
রানী রূপবতী।
রূপে, গুনে অনন্যা। লাবণ্যের ছটায় একেবারে মোহিত করে রেখেছে রাজাকে। রাজ্যের সুশিক্ষিত
নারী বাহিনীর তিনিই প্রধান পরিচালিকা এবং তিনিই রাজার পরামর্শদাত্রী। রাজা কোন দিকে
শিকার করতে যাবে তারও নির্দেশিকা তৈরি করে রাখেন রূপবতী রানী। রাজা রানীকে যেমন ভালবাসে
তেমনই বিশ্বাস করেন। কিন্তু কিছু দিন থেকে রানীর আচরণের মধ্যে এক অদ্ভুত ঔদাসিন্য দেখতে
পাচ্ছেন রাজা। লক্ষ্য করছেন এই ঔদাসিন্যের কারণেই তাঁদের মধ্যে তাঁদের মধ্যে যে নিবিড়
সম্পর্ক ছিল তা ফাটল ধরছে। রানী প্রতিদিনের কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করলেও তাঁর মন যেন
অন্য কোথায় পড়ে থাকে! রাজা লক্ষ্য করেছেন যে রানী প্রায়ই রজাকে উত্তর দিকে শিকারে যেতে বারণ করেন এবং
উত্তর দিকে শিকারে গেলে তাঁর মৃত্যু হতে পারে বলে সাবধান করেন!
বীর যোদ্ধা রাজা রানীর এই নিষেধাজ্ঞা শুনে মর্মাহত হন। এ যেন তাঁর পৌরুষে আঘাত! এ যেন
তাঁর বীরত্ব নিয়ে বক্রোক্তি! রাজা মনে মনে স্থির করেন যে রানীকে না জানিয়েই তিনি উত্তর
দিকের জঙ্গলে শিকারে যাবেন। দেখবেন কি রহস্য লুকিয়ে আছে এই উত্তরের জঙ্গলে। সঙ্গী যোদ্ধাদের
নিয়ে শিকারে যাওয়াই রাজার অভ্যাস। কিন্তু রহস্য ভেদ করার জন্য পরের দিন একাই গেলেন
শিকারে। রানী যাতে বুঝতে না পরেন তাঁর জন্য বেশ কিছুক্ষন পূবের জঙ্গল ঘুরে তিনি দ্রুত
গতিতে চলে এলেন উত্তরের জঙ্গলে।
ঘন অরণ্য। পাহাড়ের গায়ে লতাগুল্মের খুনসুটি। রাজা দূর থেকে লক্ষ্য করলেন সেই লতাগুল্মের
আড়ালে একটি সৈন্য শিবির। শিবিরের সামনে পতপত করে উড়ছে দিকুদের নিশান। রাজার বুঝতে দেরি
হলনা যে দিকুরা তাঁর রাজ্য আক্রমণ করার জন্য তৈরি হচ্ছে। শক্তি সঞ্চয় করে যে কোন মুহূর্তে
ঝাঁপিয়ে পড়বে তাঁরা। রাজা ভাবতে লাগলেন, এই কারণেই কি রানী তাঁকে উত্তরের জঙ্গলে শিকারে
আসতে দিতে চান না! এই কারণেই কি রানী এত উদাসী! এত নির্লিপ্ত!
নিজেকে সামলে
নিলেন রাজা। আবেগ, দুর্বলতা নিমেষে ঝেড়ে ফেলে দিলেন। ধনুকে টঙ্কার দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে দিকুদের সেনা শিবিরের সামনে এসে মাটিতে
বামপদের আঘাত করে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “এই মাটি, এই জল, এই বির বুরু সব হামদের।
তোরা দিকু দূর হ তোরা”।
ঝোপঝাড়ে লুকিয়ে থাকা দিকু সোইন্যরা পিল পিল করে বেরিয়ে এল। নিমেষে সমস্ত দিকু সৈন্যদের
বিষাক্ত তীরে বিদ্ধ করে ধরাশায়ী করে দিলেন রাজা। নিজের সৈন্যদের এই ভাবে মরতে দেখে
ভয়াল বিষধর সাপের মূর্তি ধারণ করে খড়্গ হাতে বেরিয়ে এল দিকু সেনাপতি। তুনে রাখা অবশিষ্ট
তীর দিয়ে সর্পবেশী এই দিকু সেনাপতিকে বিদ্ধ করতে লাগলেন রাজা। অবশেষে কোমরবন্ধ থেকে উন্মুক্ত করলেন ক্ষুরধার তরোয়াল। বিদ্যুতের মত
ঝলসে উঠে সেই তরোয়ালের এক কোপে সর্পবেশী দিকু সেনাপতির ধড় থেকে মাথাটা নামিয়ে দিল রাজা। যুদ্ধ ক্ষেত্রকে
নমস্কার করে দিকু সেনাপতির মুণ্ড এবং ধড়টাকে টেনে নিয়ে এসে গোপনে রানীর ফুলের বাগানে
মাটির নিচে পুতে দিলেন। কাউকে কিছু না বলে রাজ কার্যে ডুবে গেলেন তিনি।
রাণীর আচরণে
বেশ পরিবর্তন দেখতে পেলেন রাজা। বেশ পাল্টে গেছে রানী! যে লাবণ্যময়ী, লাস্যময়ী রানীকে
পেয়ে তিনি খুশি ছিলেন, যে রানী তাঁকে মাধুর্য দানে বিমোহিত করে রাখতেন সেই রানীই কেমন
রহস্যময়ী, ক্ষিপ্র এবং বিরক্ত! রাজা এবং রানীর সম্পর্কের মধ্যে এই ফাটল ক্রমশ তিক্ততায়
পরিপূর্ণ হয়ে যায়। অজানা কোন অনিষ্ঠ যেন রাজ পরিবারের আনাচেকানাচে দীর্ঘশ্বাস ফেলতে
থাকে।
এইভাবে কেটে
যায় বেশ কয়েকটা মাস। রানী দেখতে পান ফুলের বাগানে পরিচিত চিহ্ন নিয়ে একটি ফুল ফুটেছে।
রানী বুঝতে পারেন যে তাঁর প্রেমিক সর্পরূপী সেনাপতিকে হত্যা করে রাজা এই ফুলের বাগানে
পুতে রেখেছে এবং সেই মৃতদেহই এখন ফুল হয়ে রানীর বাগানে ফুটে উঠেছে। প্রতিহিংসায় জ্বলে
ওঠে রানী। তিনি ঠিক করলেন রাজাকে ফাঁদে ফেলতে হবে। এমন ভাবে তাঁকে হত্যা করতে হবে যাতে
রাজ্যের মধ্যে বিদ্রোহ না হয় এবং রানীকে সকলে বুদ্ধিমতী হিসেবে গ্রহণ করে।
পরদিন প্রাত
ভ্রমণে রাজা এবং রানী এলেন ফুলের বাগানে। লাস্যময়ী রানী। রাজা খুশি হলেন! বিদ্যুতের ঝিলিক দেখে ময়ূরের মন যেমন নেচে ওঠে, গুমোটবাঁধা
মেঘ সরিয়ে বাতাস যেমন গাছের ডালে আছড়ে পড়ে তেমনি দূরত্বের বাঁধন ঘুচিয়ে দিয়ে রাজাও রানীর প্রণয়ে মত্ত হয়ে পড়েন। হায় নারী! রহস্যময়ী!
রাজার এই পাগলপনা দেখে রানী বুঝতে পারেন যে এবার তাঁকে ফাঁদে ফেলতে কষ্ট হবেনা। আর ফাঁদের
মধ্যে এক সহজ পদ্ধতি আনার জন্য তিনি রাজাকে বাগানের ফুলগুলির নাম জিজ্ঞাসা করতে থাকেন।
রানী বলেন, সমস্ত ফুলের নাম বলতে পারলে রাজা যা আদেশ করবেন রানী তাই পালন করবেন। আর
কোন ফুলের নাম না বলতে পারলে রানী যা আদেশ দেবেন তাই রাজাকে এবং রাজ্যবাসীকে পালন করতে হাবে। রাজি হয়ে যান রাজা। কারণ তিনিই রানীকে
খুশি করার জন্য দেশ বিদেশ থেকে ফুল এনে নিজের হাতে রচনা করেছেন এই ফুল বাগান। এক এক করে
ফুলের নাম জিজ্ঞাসা করেন রানী। রাজা ফুলের নামগুলি জানিয়ে দেন। রানী এবার বাগানের মাঝখানে
ফুটে ওঠা একটি ফুলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, “ওটার নাম কি”? রাজা হকচকিয়ে যান!
রানী বলেন, “বল এটার নাম কি”?
অচেনা ফুল! নাম বলবেন কী করে! পরাজয় মেনে নেন রাজা। রানীর দিকে তাকিয়ে বলেন, “আমি হেরে গেছি। আজ থেকে তুমি যা আদেশ করবে, তাই পালন
করব আমি”।
চতুর রানী। গোটা রাজ্যের মানুষও যাতে তাঁর আদেশ পালন করে সেই ব্যবস্থাই তিনি চান।
তিনি সিপাহীদের ডাকলেন। পাত্র, মিত্র সকলকে ডেকে বললেন, “তোমাদের রাজা আমার কাছে
হার স্বীকার করেছে। তিনি নিজের রাজ প্রাসাদের ফুলের বাগানের ফুলের নাম বলতে পারেন
না, দেশের মানুষের খোঁজ রাখবেন কি করে? এমন অপদার্থ রাজার মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিৎ।
তা ছাড়া তিনি মেনে নিয়েছেন যে, আজ থেকে
আমি যা আদেশ করব তাই তিনি এবং তার রাজ্যের সব প্রজারা মেনে নেবেন”।
অসহায় রাজা। আবেগের বশে রানীর রহস্যের জালে
ধরা পড়ে গেছেন। উপায় না দেখে অধোবদনে ফুলের দিকে তাকিয়ে থাকেন তিনি।
রাণী গর্জে উঠে বলেন, “একদিন, এক রাত তোমাদের সময় দিচ্ছি। এর মধ্যে তিনি ফুলের নাম
বলতে পারলে বেঁচে যাবেন। আর না বলতে পারলে আমার নারী বাহিনী তাঁকে হত্যা
করবে। আগামী কাল থেকে আমিই হব এই দেশের রানী”।
ঘোষকরা প্রতিটি নগরে, প্রতিটি গ্রামে কাড়া,
নাকাড়া বাজিয়ে ঘোষণা করে দিল,
“রাজার বাগানে এ কোন ফুল?
জানাতে কেউ করোনা ভুল
ভুল হলে মরবে রাজা
নিজেই রানী দেবেন সাজা”।
সর্বনাশ! শক্তিশালী, বীর রাজার এমন করুণ পরিণতি শুনে দেশের মানুষ ছুটে আসতে লাগল।
তাঁরা দেখতে চাইল কী এমন ফুল, যার নাম বলতে পারছেন না স্বয়ং রাজা। পাত্র, মিত্র,
সিপাহীদের মাথায় হাত! মালিরা নিজেদের মাথা ছিড়তে লাগল। আক্ষেপ করে বলতে লাগল, “এমন
হবে জানলে ঐ ফুলের গাছ আমরা উপড়ে ফেলতাম। হায় হায়! রাজ্যের এ কী পরিণতি হল”?
বিকেল বেলায় হাট ফেরত মানুষদের কাছে খবেরটা জানতে পারল রাজার ছোট বোন পারুল। শুনেই
দুই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে দাদাকে শেষবারের মত দেখার জন্য জঙ্গলের পথ দিয়ে হাটা শুরু
করল সে। একটু পরেই গাঢ় অন্ধকার নেমে এলো জঙ্গলে। বাঁশের লাঠিতে মশাল জ্বালিয়ে নিল পারুল।
পথের শেষ নেই। গভীর জঙ্গল। পৌষের শেষ রাত। হূহূ করে হাওয়া বইছে। কনকনে ঠাণ্ডায় হাত পা জমে কাঠ। দূরে শিয়াল
ডাকছে। পায়ে পায়ে জড়িয়ে পড়ে লতাপাতা, মাকড়সার জাল। তবুও হাঁটতে হবে। ভোরের আলো
ফোটার আগেই পৌঁছে যেতে হবে রাজ বাড়ি। ফুলের নাম বলতে পারলে বেঁচে যাবে তার দাদা।
ছোট নদীটা পাড় ধরে আবার কিছুক্ষন হেঁটে চলে তারা। একটা বিশাল অশ্বত্থ তলায় এসে খানিকটা
জিড়িয়ে নিতে চায়। ছেলেরা শুকনো পাতা কুড়িয়ে আগুন জ্বালে। অশ্বত্থ গাছের গুড়িতে
হেলান দিয়ে হাত পা সেঁকে নেয় তারা। চাদরের মধ্যে দুই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বুকের
যন্ত্রণা জুড়িয়ে নিতে চায় পারুল। ক্লান্ত শরীরে কখন যে চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে টের
পায়না।
পাতার আগুন নিভে গেছে অনেকক্ষণ। অন্ধকারে
ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ রাতকে আরো গাঢ় করে তুলেছে। হঠাৎ শকুন ছানার কান্নার আওয়াজে ঘুম
ভেঙ্গে যায় পারুলের। পারুল বুঝতে পারে অশ্বত্থ গাছের মগডালে বাসা বেঁধে আছে একটি
শকুনি। তার দুই বাচ্চা। এখনো উড়তে শেখেনি তারা। বহুদিন খাবার জোটেনি তাঁদের। তারা কাঁদতে কাঁদতে
পাখা ঝাপটায়। মায়ের কাছে আবদার করে “মাগো বড্ড খিধে পায় মা। আর কতদিন ভখে মুরব মা”?
শকুনি মা আশার কথা শুনিয়ে বলে, “আর এই রাতটুকুস ভখটা চাপে রাখ বাপ। আজ সকালেই এই রাজ্যের রাজাটা মইরবে। ওর শরীরটা নদীতে ভাসায়
দিলে আমি তুয়াদের তরে মাংস আনে দিব।
ছেলেরা সুধায়, “ রাজাটা মরবে কেনে?”
মা বলে, “রানী উয়াকে মাইরবে।
“বাগানে ফুটেছে বাহা
নাম কি তা জানা নাই
নাম না জানালে পরে
রাজাটা মুরবে তাই।“
ছেলেরা সুধায়, বাহাটা কুথাকে ছিল? কি করে
বাগানে আইলো?
শকুনি মা বলল, “দিকু সেনাপতি কালিনাগিন ছিল
উত্তরের জঙ্গলে। এই রানীটা ছলনাময়ী।
কালিনাগিনের চর। রাজাটাকে উত্তরের দিকের জঙ্গলে যাতে দিত নাই। একদিন রাজা
উত্তরের জঙ্গলে যায়। লড়াই করে কালিনাগিনটাকে মারে। তারপর গোপনে নাগিনটাকে রাণীর
বাগানে পুঁতে দেয়। আর এই কালিনাগিনের হাড় থেকে এই বাহার জন্ম হয়।
ছেলেরা সুধায়, “এই বাহাটার নাম কি মা?”
শকুনি চুপি চুপি জানায়, এই বাহাটার নাম বুলতে পারলি রাজাটা বাঁচে যাবে। আর রানীটা
মইরবে। আর বুলতে না পারলি রাজাটা মুরবে। তাই কানে কানে বুলছি শুন।
পারুল এতক্ষণ দম বন্ধ করে, কান খাড়া করে
শুনছিল শকুনির কথা। বাহাটার নাম শুনার সাথে সাথে উঠে পড়ে। দুই ছেলেকে টেনে তোলে।
জঙ্গলের পথ দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাঁটতে থাকে। মাঝে মাঝে দৌড়ে যায়। যে করে হোক ভোরের
আলো ফোঁটার আগে দাদার কানে পৌঁছে দিতে হবে বাগানের মাঝে ফুটে থাকা ফুলের নাম।
সকাল হতে না হতেই রাজ বাড়িতে থমথমে মানুষের ভিড়। রাত জেগে ছুটে এসেছে দূরদূরান্তের
মানুষ। তদের প্রিয় রাজাকে শেষ দেখা দেখতে চায়। পাত্র, মিত্র, সিপাহীদের মাথা হেঁট।
রানীর বাহিনী এসে রাজাকে ঘিরে ফেলে।
বাগানের এক পাশে অসহায় ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন চাইচাম্পাগড়ের রাজা।
রানী এলেন। দর্পিত বিজয়িনীর বেশে। এতদিনে
নির্বাপিত হবে প্রতিহিংসার আগুন। রাজাকে হত্যা করেই উড়িয়ে দিতে পারবেন ক্ষমতার
নিশান। গোটা রাজ্যটাকেই মুঠোর মধ্যে পুরে ফেলতে পারবেন তিনি।
বেজে উঠল নারী বাহিনীর তুরি ভেরি। শুরু হল তুমুল উল্লাস। রানী হাতের ইশারায় রাজার
বক্ষকে বিদীর্ণ করার জন্য তুনে টান দিল তীরন্দাজের দল। ধীরে ধীরে মাথা উঁচু করলেন
রাজা। তীরন্দাজ নারীদের দিকে বা’হাত দিয়ে নির্দেশ দিলেন। ডান হাতের তর্জনীকে দৃঢ়
করে রানীর প্রতি জলদ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন, “এটা আমার দেশ। এই দেশে রানীকে
মহিষীরূপে সম্মান করা হয়। প্রজাদের কাছে তিনি মা। রাজ্যের গরিমা তিনি। রাজা তাঁর
সমস্ত ভালবাসা দিয়ে, সমস্ত পৌরুষ দিয়ে যে রানীকে রাজ্যের ভার অর্পণ করেছেন, যে
রানীকে স্বাধীন ভাবে নিজের বাহিনী নির্মাণ করতে স্বীকৃতি দিয়েছেন সে রানী যদি
বিশ্বাসঘাতিনী হয় তবে তাঁর কি সাঁজা হওয়া উচিৎ। যে নারী নিজের স্বামীর হন্তারক হতে
চায় সেই নারীকে কি ধরণের শাস্তি দেওয়া উচিৎ?
চিৎকার করে ওঠেন রানী, “রাজা! কি করে তাঁকে
রাজা বলি, যিনি পাশা খেলায় হেরে যান? কি করে
তিনি রাজা থাকেন যিনি বাক্য যুদ্ধে
এবং যুক্তিজালে পরাজয় স্বীকার করেন? আপনাদের এই রাজা আমার কাছে বাক্য যুদ্ধে হেরে
গেছেন। নিজের বাগানে ফোটা ফুলের নাম তিনি বলতে পারেন নি। তাঁকে আমি একদিন সময়
দিয়েছিলাম। তিনি সেই সময়ের মধ্যে ফুলের নাম বলতে পারেননি। এখনো যেটুকু সময় আছে,
আমি নিশ্চিত তাঁর মধ্যেও তিনি এই ফুলের নাম বলতে পারবেন না। সুতরাং আমি
তীরন্দাজদের নির্দেশ দিচ্ছি তারা এই রাজাকে হত্যা করার জন্য প্রস্তুত হোক।
এইবার দুই হাত তুলে প্রজাদের উদ্দেশ্য করে
রাজা বলে উঠলেন, “হে আমার প্রজাগণ, হে আমার কন্যাসম তীরন্দাজ নারীবাহিনী, এতদিন
আমি কুল, বংশ এবং রাজ্যের মর্যাদার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেই বহু যন্ত্রণা নিঃশব্দে
নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছি। আজ কুল, বংশ এবং রাজ্যের মর্যাদা ধ্বংস হবার আশঙ্কা
দেখে আমি মুখ ফুটে সমস্ত কথা আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাইছি। আমি কাল নষ্ট করতে
চাইছিনা। এই নারী যে ফুলের নাম শুনতে
চাইছে তার যথাযথ উত্তর দিচ্ছি। শুধু তার আগে জানাতে চাই যে এই দেশের রাজা
হিসেবে আমি গর্বিত এই কারণেই যে দেশের প্রতিটি গাছপালা পশু পাখিও রাজার হিতাহিতের
খবর রাখে। গত রাতে এমনি একটি পাখির কাছ থেকে এই ফুলের বার্তা নিয়ে এসেছে আমার বোন
পারুল। এই ফুলের নাম “ কালিনাগিন হাড় বাহা”। যে কালিনাগিন আমাদের দেশকে দখল করার
জন্য এই নারীকে প্রেরণ করে ছিল। আমি উত্তরের জঙ্গলে সেই কালিনাগিনের বাহিনীকে
ধ্বংস করে, নিজে হাতে কালিনাগিনকে হত্যা করে রানীর ফুলবাগানের মাটির নিচে পুঁতে
দিই। আর সেই হাড় থেকে উৎপন্ন হয় এই ফুল যার নাম “কালিনাগিন হাড় বাহা”।
রাজার মুখে ফুলের নাম উচ্চারিত হতে দেখে
রাণীর মুখ ফ্যাঁকাসে হয়ে যায়। রানী বিকট মূর্তি ধারণ করে। মুহূর্তের মধ্যে সিপাহী
এবং তীরন্দাজ বাহিনীর নিক্ষিপ্ত ঝাঁকে ঝাঁকে তীর এসে তার বক্ষ বিদীর্ণ করে দেয়।
রানী নিহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সিপাহীরা তাঁর পায়ে দড়ি
বেঁধে নদীতে নিক্ষেপ করে এবং মকর স্নান করে বাড়ি ফিরে আসে।
পুরাকালে ঘটিত এমন কোন কাহিনীর সাথে মকর
স্নান জড়িত কিনা তা গবেষণার দাবী রাখে। গোতমা বুদ্ধ জন্মাবার বহুপূর্বে কপিলমুনি
কেন গঙ্গাসাগরে এই মকর স্নানের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন সেটাও আমাদের কাছে অজানা।
সাঁকরাত একটি বছরের শেষ রাত যার সাথে কালিনাগিন হাড় বাহার এই কাহিনীটি ওতপ্রোত
ভাবে জড়িত। সাঁওতাল আদিবাসী যুবকেরা এই
দিনে কলাগাছে তীর মেরে তাঁকে বিদ্ধ করে। যিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন তাঁর মাথায়
গ্রামের মাঝি একটি সাদা নতুন কাপড়ের পাগড়ী বেঁধে অভিষিক্ত করেন। গ্রামের নারীরা এই
বিজেতাকে পা ধুইয়ে বরণ করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। তারপর চলে পান ভোজনের অনুষ্ঠান।
হতে পারে এই কাহিনীটির মধ্যে একটি ব্যাঞ্জনা আছে। হতে পারে কাহিনীটির মধ্যে আছে
একটি রূপক। তবুও আমার ছোটবেলায় শোনা মা, কাকিমা, দিদিমার রূপ কথার সাথে এর অপূর্ব
সাদৃশ্য খুঁজে পাই। এই গল্পের বাঁধন এবং বুনন থেকেই এর অকৃত্রিমতা চোখে পড়ার মত।
তাই বারবা শহর জীবনের বেড়াটাকে ভেঙ্গে আদিবাসীর আঙিনায় গিয়ে ঢুকে পড়ি। কারণ আমার
প্রাণভোমরাটা সেখানেই বাঁধা পড়ে আছে।