.......”আদর্শ অর্থনীতির ভিত্তি হল স্বাধীনতা ও কল্যাণ। পুঁজিপতিদের দ্বারা পরিচালিত সামজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীন উৎপাদনের পরিসমাপ্তি ঘটাতেই হবে”। (Ambedkar/ Evidence before the Hilton
Young Commission in 1925.)
প্রেক্ষাপট
১৭৫০ থেকে ১৮৫০ সময়কালে ঔপনিবেশিক ব্যবসাবানিজ্য, বিপুল পরিমাণ পুঁজি ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের ফলে ইংল্যান্ড
সহ গোটা ইউরোপ এবং সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে এক বিস্ময়কর পরিবর্তন সূচীত হয়েছিল। এই সময় থেকেই রাষ্ট্রগুলি প্রচলিত কৃষিকাজ থেকে ক্রমশ শিল্পায়নের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে। শিল্পের হাত ধরেই সূচনা হয় পুঁজিবাদের। শিল্পায়নের শর্ত হিসেবে পর্যাপ্ত পুঁজি এবং কাঁচামাল সাথে সাথে প্রয়োজন হয় সস্তা শ্রমিকের যোগান। ফলে শিল্প কারখানা স্থাপনের সাথে সাথে উৎপাদক বা শ্রমজীবী মানুষেরও সমাগম ঘটতে থাকে। পুঁজিবাদ যেহেতু মুনাফার নিরিখে বাঁধা তাই শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থের থেকে উপর্যুপরি উৎপাদন এবং অধিক পরিমাণে মুনাফা হয়ে ওঠে পুঁজিপতিদের প্রধান লক্ষ্য। সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক
পরিবর্তনের এই সন্ধিক্ষণে ভারত ব্রিটিশের অধীনে থাকার জন্য শিল্পায়নের ঢেউ ভারতেও
আছড়ে পড়ে।
বিংশ শতকের গোড়া থেকেই ভারতের অর্থনীতি ও মুদ্রা ব্যবস্থা একটি ভয়ঙ্কর সমস্যার সম্মুখীন হয়। অসম
বন্টন ব্যবস্থা, অনিয়ন্ত্রিত কর ব্যবস্থা এবং জমিদারতন্ত্রের অমানবিক শোষণের জন্যই
শ্রম এবং উৎপাদনের সাথে জড়িত মানুষ বঞ্চনার শিকার হতে থাকে। জমিদার এবং ছোটবড় রাজ
পরিবার ব্রিটিশদের সন্তুষ্ট করার জন্য সাধারণ প্রজাদের উপর চরম নিপীড়ন নামিয়ে আনে।
জমিদারতন্ত্র প্রশাসন এবং অর্থনৈতিক পরিকাঠামোর নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠায় চরম অর্থনৈতিক অব্যবস্থার
সম্মুখীন হয় ব্রিটিশ সরকার।
এই সমস্যা সমাধান করার জন্য
ব্রিটিশ সরকার
১৯২০ সালে “Royal
Commission on Indian Currency and Finance” গঠন করেন। এই কমিশন Hilton Young Commission নামে
পরিচিত। এই কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন এডওয়ার্ড হিল্টন ইয়াং এবং অন্য
সদস্যরা হলেন রেজিনাল্ড মান্ট, জর্জ আর্নেস্ট সুস্টার এবং জে এই ওল্ডম্যান।ভাতের
অর্থনীতির গতিমুখ নির্ণয় করা এবং একটি ব্যাংক গঠন করাই ছিল এই কমিশনের প্রধান
উদ্দেশ্য।
১৯২৬ সালে এই কমিশন যখন ভারতে আসে তখন কমিশনের সদস্যদের হাতে হাতে অর্থনীতির দুটি বই ঘুরতে দেখা যায়। একটি গ্রন্থের নাম “The Problem of the Rupee – Its origin and its
solution.” এবং অন্যটি “Evidence before the Royal Commission on Indian
Currency and Finance” ।
এই দুটি গবেষণামূলক গ্রন্থের রচয়িতা
হলেন বাবা সাহেব ডঃবিআরআম্বেদকর। হিল্টন কমিশনের কাছ থেকে জানা যায় যে, ১৯২৫ সালে ডঃ বিআর আম্বেদকর কমিশনের সামনে ভারতীয় অর্থনৈতিক সমস্যা এবং তার সমাধানের উপর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেশ করেন। তিনি তার গবেষণা গ্রন্থ “The Problem of the Rupee – Its origin and its
solution.” থেকে বক্তব্য রাখেন। অকপটে বলেন যে,
“অর্থনৈতিক ও সামাজিক শোষণের অন্তরায় সমস্ত উপাদানগুলিকে দূর করতে হবে। আমরা জমিদারতন্ত্রের দখলদারী ও ভূমিহীন সর্বহারা শ্রমিক দেখতে চাইনা। আদর্শ অর্থনীতির ভিত্তি হল স্বাধীনতা ও কল্যাণ। পুঁজিপতিদের দ্বারা পরিচালিত সামজিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীন উৎপাদনের পরিসমাপ্তি ঘটাতেই হবে”।
ভারতীয় অর্থনীতির এই সমস্যা সমাধানের
জন্য বাবা সাহেব আম্বেদকর “Rserve Bank of India (RBI)” গঠন করার পরামর্শ
দেন। ১৯৩৪ সালে The Central Legislative Assembly এই বক্তব্য গ্রহণ
করে এবং হিল্টন ইয়াং কমিশনের প্রস্তাব পাশ করে। এই আইনের নাম RBI Act-1934।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে
অর্থনৈতিক ও মূদ্রা ব্যবস্থার গতিমুখ পুঁজিপতি কেন্দ্রীক প্রবণতা থেকে জনমুখী বাস্তবতায় পরিণত হয়। এমন জনমুখী অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণের ফলেই সমস্ত রাষ্ট্রীয় সম্পদের ভাগীদার হয়ে ওঠে জনগণ। রাষ্ট্র হয়ে ওঠে নিয়ন্ত্রক শক্তি। এখানে বলে রাখি যে আম্বেদকর তাঁর মাষ্টার ডিগ্রীর জন্য
Ancient Indian Commerce’ এর উপরে থিসিস করেন এবং এমএসসিতে থিসিস করেন
‘The Evolution of Provincial Finance in British India’ এর উপর । এর পর ডিএসসি তে
“The Problem of the Rupee – Its origin and its solution.” নিয়ে গবেষণা পূর্ণ করেন।
আজও উপেক্ষিত আম্বেদকরঃ
বিশ্ব অর্থনীতির এমন এক অধ্যায় শুরু করার পরও বাবা সাহেব আম্বেদকর ভারতের বাবু
সমাজের কাছে থেকে গেলেন উপেক্ষিত! বিশ্ব অর্থনীতির ধারণা বদলে দেবার পরেও এখনো
ভারতের পক্ষ থেকে নোবেল পুরষ্কারের জন্য ডঃ আম্বেদকরের নাম বিবেচনা করা হয়নি! স্বাধীন
ভারতের মূদ্রায় ছাপানো হচ্ছে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর ছবি!
আশার কথা বিশ্বের অর্থনীতিতে
যারাই নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই শ্রদ্ধাবনত চিত্তে বাবা সাহেব
আম্বেদকরকে তাঁদের পথপ্রদর্শক হিসেবে মেনে নিচ্ছেন। এই প্রসঙ্গে সুবিখ্যাত
অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য। নোবেল পুরস্কার পাবার পর তিনি
বলেছিলেন, “Dr. Ambedkar is my Father
in Economics. He is true celebrated champion of the underprivileged. He
deserves more than what he has achieved today. However he was highly
controversial figure in his home country,though it was not the reality. His
contribution in the field of economics is marvellous and will be remembered
forever…”
(সহস্রাব্দের সেরা মনিষী নিবন্ধের অংশ বিশেষ)
তথ্যসূত্রঃ
1. The Less Known Side of B. R Ambedkar/ The Navohind Times/Goa/2011
2. Financial Institutions and
Management/ Book 4
3. “Evidence before the Royal
Commission on Indian Currency and Finance/Dr. B.R.Ambedkar/1825
4. Father of
the Economics/ The Hindu/2018
5. Royal
Commission on Indian Currency and Finance/1926