Pages

Saturday, 15 March 2014

হোলি উৎসবের নেপথ্য কাহিনী


তুংদার “দা দা দাতালারে বাহু তিং” “আর টমাকের “হুগডা গুডাং” এই যুগল বন্দীর তালে আগামিকাল সকাল থেকেই জেগে উঠবে আদিবসি পাড়াগুলি। গাও মাঝি, গড়েত, পারানিক, নাইকে, কুডাম নাইকে প্রকৃতর পরিবর্তনকে স্বাগত জানাতে জড়ো হবেন পবিত্র জাহের থানে। মঙ্গলাচারের সাথে সাথে মেয়েরা গাইতে থাকবেন
“কাড়া কাডায় জবে আকান গাং নাইরে,
গাং নাইরে হালে জোড়া সামুদ্রে”
এর পরেই চলবে জল খেলা আর বসন্ত ঋতুকে আবাহনের সুরেলা সেরেং,    
“বাহাবোঙ্গা মুলু এনা সারজোমদারে রে বাহাবোঙ্গা মুলু এনা”......।
মাঝি জাহের এরাকে সন্তুষ্ট করবেন নতুন পল্লব নতুন ফুল দিয়ে। তারপর সারাদিন রাত ধরে নাচ আর গান। প্রকৃতির সাথে নিজেদের একাত্মতা অনুভব করার এই উৎসব বাহা। কোন কোন কৌমিক সমাজে এটিই আবার শারুল বা শারুল পরব।  

কিন্তু এই উৎসবই এখন হোলি উৎসব নামে এক জিঘাংসার উৎসব হয়ে দাড়িয়েছে এবং জাতপাত ও ধর্ম ব্যবসায়ীদের  স্বেচ্ছাচারে পরিণত হয়েছে। পাশাপাশি ব্রাহ্মন্যবাদীরা হোলি উৎসবের মধ্যে এমন কিছু আচার ঢুকিয়ে দিয়েছে যা মূলনিবাসীদের কাছে অত্যন্ত অমর্যাদাকর ও তাদের প্রতি ঘৃণার প্রতীক। এর একটি আচার হল দোল বা হোলির আগের দিন বুড়ির ঘর জ্বালানো।
কী আছে এই বুড়ীর ঘর জ্বালানোর নেপথ্যে?
কে এই হোলি বা হোলিকা?
বাঙালীর জানার দরকার নেই। কারণ জানতে পারলে আকন্ঠ মদ্যপান করা যাবেনা অথবা   বাধ সাধবে তার আক্রান্ত বিবেক। বিবেকহীন বাঙালীর এই ভীমরতি আজ তার আত্তপরিচয় ও আত্তগৌরব ফিরে পাওয়ার পথে সবচেয়ে কঠিন অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।    
শোনা কথায় বিশ্বাস করা মূলনিবাসীদের এক দুরারোগ্য ব্যাধি। এবিষয়ে তারা কাছাখোলাও বটে। ফলে গালগল্পের জাল বুনে এই কাছাখোলাদের সার্বিক বেড়ি পরাতে পেরেছে বামুনেরা। নিপুন দক্ষতায় মূলনিবাসীদের উপর প্রতিটি আক্রমণকে তারা পরিবর্তিত করেছে ধর্মীয় আখ্যানে। এবং মূলনিবাসীদেরই কোন বড় উৎসবের দিনে তাদের বিজয়বার্তা কে প্রতিষ্ঠিত করে একদিকে ধ্বংস করে দিয়েছে লোকায়ত সংস্কৃতি অন্যদিকে হাইজ্যাক করে নিয়েছে প্রবাহমান প্রম্পরা। বেদ, উপনিষদ, রামায়ন, মহাভারত বা পুরাণগুলি এই চুরি বিদ্যার সংকলিত গুপ্তধন। 
হোলিকা এই গুপ্তধনের অন্যতম কাহিনী। যা মহাভারত ও পুরাণগুলিতে সংকলিত হয়েছে।

মূলনিবাসী লোক কাহিনী অনুসারেঃ  হিরন্যকশ্যপ এক পরাক্রমী রাজা ছিলেন। ব্রাহ্মন্যবাদীরা তাদের পাপাচারের নীতি বেদ, বিধি, শৌচাচার বা পুরানের নীতিগুলিকে চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করলে রাজা হিরন্যকশ্যপ তা পরিত্যাগ করেন এবং পারম্পরিক প্রজ্ঞা পারমিতার নীতিকেই মানব কল্যাণের নীতি হিসেবে পালন করেন। তিনি ব্রাহ্মন্যবাদিদের বিরুদ্ধে নিজের মাতৃভূমি রক্ষা করার জন্য প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এতে বর্বর আর্যরা ভারতের অনেক রজ্য কব্জা করতে বিফল হয়। তারা ছলনা ও বহুরূপী নীতি গ্রহণ করে এবং রাজা হিরন্য কারশ্যপের পুত্র প্রহ্লাদকে কব্জা করে ফেলে। সুজোগ বুঝে ব্রাহ্মণ সেনাপতি নর সিং হের মূর্তির ছদ্মবেশ ধারণ করে রাজা হিরণ্য কশ্যপকে হত্যা করে। হিরণ্য কশ্যপের নাবাল পুত্র প্রহ্ললাদ কে সিংহাসনে বসিয়ে বামুনেরা তাদের নীতি রুপায়নের ষড়যন্ত্র শুরু করে। তাদের ধারনা ছিল যে এই ব্যবস্থায় প্রজারা মনে করবে যে প্রহ্ললাদই শাসন করছে। ব্রাহ্মন্যবাদ কায়েম হলে প্রহল্লাদকেও হত্যা করা হবে।   
রাজা হিরন্যকের বোন ছিলেন হোলিকা। এই ষড়যন্ত্রের কথা তিনি জানাতে পেরে যান এবং প্রহল্লাদকে বাঁচানোর জন্য তাকে নিয়ে তিনি সুরক্ষিত স্থানে চলে যান। কিন্তু  আর্য দস্যুদের কুটিল নজর এড়িয়ে যেতে তিনি ব্যর্থ হন। দস্যুরা তাঁকে ঘিরে ফেলে। তাঁকে ধর্ষণ করে। তার রক্ত নিয়ে খেলতে থাকে এবং গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলা হয়।     

লোকায়ত সংস্কৃতির মধ্যে এই পুরাতনী বার্তা গভীর ভাবে প্রথিত হয়। জনগণ মহান রাজা হিরন্যক ও হোলিকার এই মৃত্যু দিনকে শোক দিবস হিসেবে পালন করার এক পরিক্রমা শুরু করে। তারা চিতা জ্বালিয়ে তার উপর গোলাপ জল ছিটিয়ে মূলনিবাসীদের প্রাচীন সভ্যতা ও ধম্ম রক্ষা করার জন্য রাজা ও হোলিকার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে। এই শোকপালনরে অনুষ্ঠানের একটি পারম্পরিকতা তৈরি হলে বামুনেরা তাদের কাল্পনিক বিষ্ণুর নরসিংহ অবতারের কাহিনী তৈরি করে প্রাচীন ঐতিহাসিক তথ্য ধ্বংস করে দেয় এবং আমাদের মহান রাজাদের অসুর, দৈত্য, দানব, রাক্ষস সাজিয়ে খুনি, ধর্ষক ও বর্বরদের দেবতা ঈশ্বর বানিয়ে তোলে।

এই  ভাবে বামুনদের দ্বারা প্রতিটি হত্যা ও জিঘাংসাকে ঐশ্বরিক মহিমায় অলংকৃত করা হয়েছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে আমাদের সংস্কৃতি। মিথ্যাচারীদের ধাপ্পায় বিভ্রান্ত হয়ে আমরা প্রকৃতি ও নিজেদের সংস্কৃতি থেকে দূরে চলে গেছি।