ফতিমা
শেখ মুসলমান বলেই তাঁর অস্তিত্ব মুছে দিতে চাইছে সংঘ পরিবারঃ
শরদিন্দু বিশ্বাস, কোলকাতা-৮৪
ভারতে সার্বজনীন শিক্ষা আন্দোলন থেকে মুসলিম সমাজের প্রথম শিক্ষিকা ফতিমা শেখের নাম মুছে দেবার পরিকল্পনা নিয়েই কি ভারত সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের অন্যতম উপদেষ্টা দিলীপ মণ্ডল তার ট্যুইটার ব্যবহার করেছিলেন! নাকি হিন্দুত্ববাদী ঝান্ডা উড়িয়ে মূলনিবাসী-বহুজন ঐক্যে ফাটল ধরাতে চাইছিলেন তিনি ! আমি বাজি রেখে বলতে পারি উদ্দেশ্যটি ছিল হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটি বিভ্রান্তি তৈরি করা এবং হিংসার বাতাবরণ তৈরি করে একে অন্যের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া।
গত ৩রা জানুয়ারী সারা দেশে পালিত হয়েছে সাবিত্রীবাই ফুলের ১৯৫তম জন্মদিন। একই ভাবে ৯ই জানুয়ারী বহুজন সংগঠনগুলি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রতীক এবং সাবিত্রীবাই ফুলের সহযোদ্ধা ভারতে মুসলিম সমাজের প্রথম শিক্ষিকা ফতিমা শেখের জন্মদিন পালন করেছে। পশ্চিমবঙ্গে এই সম্প্রীতির বন্ধনকে মজবুত করতে জয় ভীম ইন্ডিয়া নেটওয়ার্কে মুখপত্র ভয়েস অফ বহুজনের পক্ষে থেকে কোলকাতা প্রেস ক্লাবে সমাজ সেবায় অনন্য অবদানের জন্য বীরভুম কন্যা আয়েশা খাতুনকে প্রথম সাবিত্রী-ফতিমা উৎকর্ষ সম্মান প্রদান করা হয়। এই সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী এবং সাহিত্যকেরা। বহু পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এই খবর। আর ঠিক এরকম সময়ে ভারতের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের উপদেষ্টা দিলীপ মণ্ডল তার ট্যুইটারে ফতিমা শেখকে অবাস্তব চরিত্র বলে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করে।
তিনি তাঁর ট্যুইটে
লেখেন, “আমি একটি গল্প বা বানানো চরিত্র নির্মাণ করেছিলাম এবং তাঁর নাম দিয়েছিলাম ফতিমা
শেখ। আমাকে মার্জনা করবেন। সত্য হল, এই ফতিমা শেখ বাস্তবে ছিলেন না। তিনি কোন ঐতিহাসিক
চরিত্র নয়। কোন বাস্তব মানুষ নয়।
এটা আমার ভুল যে জেনেবুঝেই কোন এক পরিস্থিতিতে আমি এই চরিত্রটি
নির্মাণ করে আলতো ভাবে ছেড়ে দিয়েছিলাম। আপনারা গুগল সার্চ করে এর আগে ফতিমা সম্পর্কে
একটি তথ্যও পাবেন না। তাঁর সম্পর্কে কোন বই নেই। কিচ্ছু নেই। জিজ্ঞাসা করবেন না কেন
আমি এই চরিত্র নির্মাণ করেছিলাম। এটা ছিল সময় ও পরিস্থিতি অনুসারে একটি নির্মাণ। তাই
আমি ফতিমা চরিত্রটি তৈরি করেছিলাম। হাজার হাজার মানুষ এই কাহিনী মেনে নিয়েছিলেন এবং
তাঁরা আমার কাছ থেকেই প্রথমে এই নাম শুনেছিলেন। কি করে একটি কাহিনী এবং একটি ছবি নির্মাণ
করতে হয় আমি জানি। আমি এই বিষয়ে পারদর্শী হয়ে উঠেছিলাম। সুতরাং এটা আমার কাছে দুঃসাধ্য
ছিল না। একটি কাল্পনিক ছবি আঁকা হয়েছিল, কারণ ফতিমার কোন পূরানো ছবি ছিলনা। আমি নানা ধরণের
কাহিনী ছড়িয়েছিলাম জন্য ফতিমা বাস্তবায়িত হয়েছিল। সাবিত্রিবাই ফুলে এবং জ্যোতিরাও ফুলেকে
নিয়ে যে রচনা সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে ফতিমার নাম উল্লেখ নেই। এমনকি বাবাসাহেব
আম্বেদকরও তাঁর তাম উল্লেখ করেননি। ব্রিটিশ ডকুমেন্টে জ্যোতিরাও ফুলে এবং সাবিত্রীবাই
ফুলের নাম উল্লেখ থাকলেও ফতিমার নাম উল্লেখ নেই। এমনকি কোন মুসলিম স্কলার তাঁর নাম
উল্লেখ করেনি। সে কোথাও নেই, কোত্থাও নেই”।
একদা আম্বেদকরবাদী বলে সুপরিচিত একজন সাংবাদিকের এ হেন ট্যুইট দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন
বহুজন আন্দোলনের মানুষেরা। দিলীপ মণ্ডলের ট্যুইটারেই তাঁকে নাস্তানাবুদ করা হয়। এই
মিথ্যার জবাব দিতে উঠে আসে নানা প্রকাশিত সত্য এবং ফতিমাকে নিয়ে সাবিত্রীবাই ফুলের
নিজের চিঠি।
এক ঢিলে দুই পাখি মারার কৌশল নিয়েই সংঘ পরিবার দিলীপ মণ্ডলের
মত একজন প্রতিষ্ঠিত দলিত ইন্টেলেকচুয়ালকে দিয়ে ভারতের প্রথম মুসলমান শিক্ষিকা ফতিমা
শেখের উপর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। উদ্দেশ্য সার্বজনীন শিক্ষায় ফতিমার মত একজন মুসলমান
নারীর অস্তিত্ব এবং অবদান মুছে ফেলা এবং দলিত-মুসলিমদের মধ্যে একটি চিরস্থায়ী বৈচারিক
দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করা। ইতিমধ্যেই সংঘ পরিবার বুঝে নিয়েছে যে দলিত-মুসলিম জনাধারই ভারতের
রাজনৈতিক উত্থান পতনের নিয়ন্ত্রক। মণ্ডল কমিশনের মতে এরাই সংখ্যায় ৮৫ শতাংশ। এদের ঐক্যমতকে
ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বহুজন বিচার ধারা। আর এই বহুজন বিচার ধারাই হিন্দুরাষ্ট্র গঠনের
সব থেকে বড় বাঁধা। এই জনাধার অটুট থাকলে ১৫ শতাংশ ব্রাহ্মণবাদীরা কোনদিনই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা
অর্জন করতে পারবেনা। ফলে যে ভাবেই হোক না কেন দলিত-মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরাতে হবেই। পোষমানা কুনকি হাতি দিয়ে জঙ্গলের হাতিদের বশ করতে হবে। দিলীপ
মণ্ডল সেই কুনকি হাতি যাকে দিয়ে দলিত জনাধারকে বাগে আনতে চাইছিল বিজেপি বা সংঘ পরিবার।
১৯৯১ সালে ইংরেজীতে প্রকাশিত হয় থারু এবং ললিতকা সম্পাদিত
খ্রীস্ট পূর্ব ৬০০ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত ভারতীয় নারীদের লেখা সমগ্র। একাডেমিক স্তরে
এটাই ভারতের নারী সমাজের লেখালিখি নিয়ে প্রথম কাজ। এই রচনা সমগ্রে ফতিমা শেখকে সাবিত্রীবাই
ফুলের সহকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। থারু এবং ললিতা লিখেছেন যে, জ্যোতিরাও ফুলে এবং
সাবিত্রীবাই ফুলে পুনেতে পিছিয়ে রাখা ছেলেমেয়েদের জন্য যে সব বিদ্যালয়গুলি শুরু করেছিলেন,
তাঁদের সহকর্মী ছিলেন ফতিমা শেখ।
২০১০ সালে বিখ্যাত ব্রিটিশ স্কলার “A Cry for Dignity:
Religion, Violence and the Struggle of Dalit Women in India” নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ
করেন। এই গ্রন্থে তিনি উল্লেখ করেন যে, “Savitribai
graduated from her Training College with flying colours (along with a Muslim
woman Fatima Sheikh), with her husband, she opened five schools in and around
Pune in 1848…”
সাবিত্রীবাই ফুলে এবং ফতিমা শেখের একমাত্র ছবি যাকে দিলীপ
মণ্ডল সন্দেহজনক অংকন বলে উড়িয়ে দিতে চাইছিলেন সেই ছবি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল “মজুর”
নামে একটি মাসিক পত্রিকায়। ১৯২৪-৩০ সাল পর্যন্ত এর সম্পাদক ছিলেন রানা লাড।
এই সমস্ত লিখিত গ্রন্থ এবং তথ্য প্রমাণ করে যে বিজেপি এবং
সংঘ পরিবার তাঁদের পালিত দিলীপ মণ্ডলকে দিয়ে যে পদ্ধতিতে ভারতের প্রথম সার্বজনীন শিক্ষায়
মুসলমান নারী ফতিমা শেখ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন তা মুছে ফেলতে চায়। কিন্তু এটা ব্যর্থ
হয়েছে জাগ্রত বহুজন সমাজের জোরালো প্রতিরোধে।
আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে মুসলিম সমাজের মধ্যে
ফতিমা শেখের মত মহিয়সী নারীকে এখনো সেই ভাবে সম্মানিত করা হয়নি। আয়োজন করা হয়নি কোন
আলোচনা সভা। এই নীরবতার সুযোগ নিয়েই বিজেপি এবং সংঘ পরিবার ভারতের ইতিহাস থেকে ম্যসলমানের
অবদান মুছে ফেলার বা নিদর্শনগুলি ধ্বংস করার সাহস পাচ্ছে। আদিবাসী-মূলনিবাসী ঐক্য মজবুত
হলে এবং ৮৫ শতাংশ মানুষের ঐক্য এবং প্রতিনিধিত্ব সুনিশ্চিত হলে বিভ্রান্তিকারীরা আর
মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেনা।